নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাপলু রহমান

অভিবাসন আকাঙ্ক্ষা ও দুঃসহ বাস্তবতা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৩ | ১১:০৪ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩ | ১১:০৪ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
অভিবাসন আকাঙ্ক্ষা ও দুঃসহ বাস্তবতা

বর্তমানে সন্তানদের বিদেশ পাঠানোর ব্যাপারে পরিবারের আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অভিভাবকরা সন্তানকে অন্য একটি দেশে পাঠাতে চান। এ প্রবণতা দেশের শিক্ষিত (নিম্ন) মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে বেড়েছে। তারা বিশ্বাস করে, বিদেশে সন্তানরা তাদের স্বপ্ন ও চাহিদা পূরণ করতে পারবে। কয়েক বছর আগেও গ্রাম থেকে ঢাকায় স্থানান্তর হওয়া বিশাল ব্যাপার ছিল। কিন্তু যানজট, দূষণ, চাকরির অনিশ্চয়তা, ক্রমাগত ব্যয় বৃদ্ধি ও আবাসন সমস্যার কারণে ঢাকাই অনেককে দেশ ত্যাগে ব্যাকুল করছে। বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখলেও অনেকে জানেনও না সেখানে গিয়ে তারা কী করবেন? কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়াই স্নাতক শেষে বিদেশ চলে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছেন তরুণরা। জীবন নিয়ে তাদের সহজ ও নিরাপদ ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে অভিবাসন। তাদের ধারণা, বিদেশে যেতে পারলে পড়াশোনা, কর্মসংস্থান সবই করতে পারবেন। অনেকের বিশ্বাস, বাংলাদেশে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

দেশ থেকে এখন মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদেশ যাওয়ার ট্রেন্ড চলছে। শুধু রাজধানীতে নয়, ছোট-বড় প্রায় সব শহরের দেয়ালে, ওভারব্রিজে, বাসস্টেশন ও রেলস্টেশনে এমনকি যানবাহনেও বৃত্তি কর্মসূচি, ভিসা পরামর্শ কেন্দ্র ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধির বিজ্ঞাপনে সজ্জিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরে আইইএলটিএস বা টোফেল কোর্সের প্রচারপত্রও চোখে পড়ার মতো। পত্রিকার পাতাগুলোও বৃত্তি, স্টুডেন্ট ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট এমনকি বিভিন্ন দেশে স্থায়ী অভিবাসনের রমরমা তথ্যের জোগান দিচ্ছে। বর্তমানে এমন কোনো শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না, যার পরিচিত কেউ বিদেশে পড়াশোনা করছেন না।

বাংলাদেশের জন্য অভিবাসনের প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব নিশ্চয়ই রয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের রেমিট্যান্সের পরিমাণ বছর বছর বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত দ্য গ্লোবাল নলেজ পার্টনারশিপ অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (নৌম্যাড) ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ২২০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। তার ৩০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯০ সালে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। নৌম্যাডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশী অভিবাসী সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭৪ লাখ ৪৭ হাজার ১১৪ জন।

বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অভিবাসন ঘটে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়। বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় বাংলাদেশী নবীন ও শিক্ষিতদের অভিবাসন ঘটছে। গত মার্চে শিক্ষার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার (এফ১ ক্যাটাগরি) ভিসা ইস্যু হয়েছে ২৭২টি। আর শিক্ষার্থীর স্বামী/স্ত্রী অথবা সন্তানদের (এফ২ ক্যাটাগরি) জন্য মোট ভিসা ইস্যু হয়েছে ২১৭টি (বণিক বার্তা ২৭ মে, ২০২৩)। এছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার (সূত্র: বণিক বার্তা, ১৮ মে, ২০২৩)।

দেশে আগে শুধু উচ্চবিত্তের সন্তানরা বিদেশে পড়তে যেত। কিন্তু এখন তা দ্রুতগতিতে মধ্যবিত্ত (নিম্ন) ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিবারগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। বিদেশে পাঠাতে না পারলেও সন্তানদের অন্তত ঢাকায় বা অন্য শহরে পাঠাচ্ছেন তারা। অধিকাংশ পরিবার সন্তানের শিক্ষালাভকে ভালো চাকরি ও বেতনপ্রাপ্তির পথ হিসেবেই দেখছেন। কিন্তু বেশির ভাগের কপালে মানানসই পেশা ও বেতন জুটছে না। শহরে পড়ালেখার ফলে অনেকে সামাজিক মর্যাদা ও ভিন্ন জীবনাচরণের কারণে গ্রামে ফিরতে পারছেন না। সেজন্য অনেকে বাধ্য হয়ে শহরের নির্জীব পরিবেশেই আবদ্ধ থাকছেন। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আলাদা কমিউনিটি, আলাদা সার্কেল গড়ে তুলছেন। সেখান থেকে তারা তাদের স্বজন, বন্ধু ও পরিজনদের টানছেন।

সরকার শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিলেও ডিগ্রি শেষ করে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী চাকরি পান না। বহুল প্রচলিত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অব্যবস্থাপনায় বেকারদের কপালে চাকরি জুটছে না। অথচ বহির্বিশ্বে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাকালীন চাকরি পেয়ে যান। এসব বিষয় তরুণদের মনে হতাশার জন্ম দিচ্ছে। ছোট্ট একটি দেশের স্থানীয় সুযোগ-সুবিধার মধ্যকার পার্থক্য, দুর্মূল্যের বাজারে দৈনন্দিন বাস্তবতা, পরিবারের প্রত্যাশা ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাহীনতার কারণে তরুণরা হতাশ। তাই বিদেশ যাওয়াটাই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলছেন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ, আর্থসামাজিক পরিবর্তন ও আধুনিক জীবনাচরণের আকাঙ্ক্ষাও এজন্য দায়ী। অনেকে ভাবছেন, তারা দেশে যা অর্জন করতে পারছেন না, বিদেশ গেলে তা অর্জন করতে পারবেন। সেখানে বেশি ভালো থাকবেন এবং পরিবারকে ভালো রাখতে পারবেন।

তবে ব্যক্তির শুধু অভিবাসন আকাঙ্ক্ষা থাকলেই চলবে না, এজন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা মাথায় নেয়া উচিত। অপরিকল্পিত বা অস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশী অনেক বাংলাদেশী জীবনকে মৃত্যু ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলছেন। উদাহরণ হিসেবে মাদারীপুরের ঘটনা বলা যায়। সংসারে সচ্ছলতা আনার আশায় জেলাটি থেকে প্রতি বছর শত শত তরুণ ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। অবৈধ পথে গিয়ে অনেকের মৃত্যু হয়। কেউ দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার, কেউবা কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলার ৪৫ জন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেছেন। একই সময়ের মধ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছেন অন্তত সাড়ে তিনশ তরুণ। নিখোঁজ আছেন তিন শতাধিক ব্যক্তি। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত জেলায় মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে ১০০টি। এসব মামলায় সাধারণত আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। কাউকে কাউকে আইনের আওতায় আনা হলে উপযুক্ত বিচার না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে (সূত্র: প্রথম আলো, ২৭ মে, ২০২৩)।

আধুনিক বিশ্বায়নের ফলে মানুষের অবাধ গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনিয়োগ, পণ্য, শিক্ষা ও শ্রমের আদান-প্রদান বেড়েছে। নিজ দেশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না মিললে মানুষ অন্য দেশেই পাড়ি দেবে। কাজেই মেধাবী শিক্ষার্থী ও দক্ষ শ্রমিক ধরে রাখতে সরকারকে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও ন্যায্য মজুরির যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকার যে জ্ঞানভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে, তাতে নবীন ও শিক্ষিতদের দেশে ধরে রাখার দরকার আছে। একই সঙ্গে অভিবাসী যেসব শিক্ষার্থী ও কর্মী রয়েছেন, তাদের দেশে ফিরে আসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাতে দেশে শিক্ষা ও কর্মের মান বাড়বে।

দেশ ত্যাগে যারা বিভোর, স্বপ্নের দেশটিকে তারা বৈষম্যহীন, সংঘর্ষহীন ও দুর্নীতিহীন হিসেবে বিবেচনা করেন। ভাবেন, সেখানে কোনো দারিদ্র্য নেই, কষ্ট নেই। যুক্তরাষ্ট্রের কথা আবারো বলি, সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের সবার অবস্থা যে ভালো, তা নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশীদের ১৯ শতাংশই দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে (সূত্র: বণিক বার্তা, ১৮ মে, ২০২৩)। এছাড়া সেখানে মানুষের চেয়ে বন্দুক বেশি। তাই সেখানে সহিংসতার ঘটনাও বেশি। বর্তমানে সরকার অভিবাসনকে উৎসাহিত করলেও আগ্রহীদের পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এগোতে হবে। তাদের ভাবতে হবে, জমিজমা শেষ করে, সুদের ওপর ঋণ নিয়ে পরভূমে মালি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তাকর্মী ও নির্মাণ শ্রমিকের মতো পেশা বেছে নেবেন নাকি নিজভূমে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী বা কৃষিকাজ করে আপনজনের সঙ্গে জীবন কাটাবেন? পাপলু রহমান: সাংবাদিক। বণিকবার্তার সৌজন্যে

এসএ/এমএএস/এমইউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন