নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ন্যাটো ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া কি জিততে চলেছে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৩:২৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৩:২৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ন্যাটো ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া কি জিততে চলেছে

স্টিফেন ব্রায়েন : ইউক্রেনের সঙ্গে যুক্তরাজ্য একটি নৌচুক্তি করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এর মধ্য দিয়ে ভলোদিমির জেলেনস্কির নেতৃত্বে ডুবতে বসা একটি দেশকে সামরিক সহায়তার পরিমাণ দ্বিগুণ করছে তারা। জার্মানিও ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও বাস্তবে তাদের অস্ত্রের মজুত খালি হয়ে এসেছে। যুক্তরাজ্য ও জার্মানি তাদের অর্থভান্ডার ও অস্ত্রভান্ডার খালি করে ফেলছে।

যুক্তরাষ্ট্রও একই চেষ্টা করে চলেছে। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত বিল গার্টেজ-এর একটি নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে, তাইওয়ানকে সহায়তা করার জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টি-সংক্রান্ত হাউস সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান মহৎ একটি ধারণা হাজির করেছেন। ধারণাটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রভান্ডার থেকে তাইওয়ানকে বাতিল অস্ত্র দেওয়া। এর কারণ হলো, তাইওয়ানকে নতুন অস্ত্র দেওয়া প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।

নিবন্ধটিতে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার জন্য তাইওয়ান ২ বিলিয়ন ডলার দিলেও সেই অস্ত্র তাদের দেওয়া হয়নি। তিন বছর আগে এসব অস্ত্র কেনার চুক্তি করলেও ২০২৯ সালের আগে সেগুলো তাইপের কাছে পৌঁছাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাশিল্পের এই দুর্বলতা ও সমস্যার কারণ হলো তীব্র জনবলসংকট। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ন্যাটোর দেশগুলোও একই সংকটে পড়েছে।

জার্মানির বর্তমান সরকার খুব দ্রুত তাদের রাজনৈতিক সমর্থন হারিয়ে ফেলছে। এ পরিস্থিতিতে জার্মান পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের জন্য কোনো ভোট হলে সেটা তাদের জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যা হবে। জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিসটোরিয়াস সমস্যাটি বুঝতে পারলেও জনসমর্থন ফিরে পাওয়া যায়, এমন কোনো সমাধান তাঁর হাতে নেই।

জার্মানির রাজনীতি দ্রুত ডানপন্থার দিকে ঘুরে যাচ্ছে। জার্মানির ডানপন্থী দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) পক্ষে ভোটারদের সমর্থন বেড়ে চলেছে। এএফডি এখন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক নিয়োগের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো অবস্থান নেয়নি। কিন্তু রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষে তারা। এ ছাড়া ইউরোপের প্রতিরক্ষার জন্য ব্যয় বাড়ানোর উদ্যোগের বিরুদ্ধে এএফডি।

জার্মানির সেনাবাহিনীতে লোকবল কমতে কমতে এখন ১ লাখ ৮১ হাজার ৩৮৩ জনে পৌঁছেছে। হাজার হাজার পদ শূন্য রয়ে গেলেও তা পূরণ করা যাচ্ছে না।

জার্মান ট্যাবলয়েড বিল্ড জানাচ্ছে, দেশকে রক্ষা করার মতো সেনাবল কিংবা অস্ত্রবল—কোনোটাই নেই জার্মানির সেনাবাহিনীর। সেনাবাহিনীর এই সংকট যখন উঠে আসছে, সেসময়ে লিথুনিয়ায় পাঁচ হাজার সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি।

লিথুনিয়ার সঙ্গে বেলারুশের যে সীমান্ত, তার মাত্র ২০ কিলোমিটারের মধ্যে জার্মান সেনারা অবস্থান করবেন। ২০২৪ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেখানে সেনা পাঠানো শুরু হবে। ব্রিগেডটি পুরোপুরি প্রস্তুত হবে ২০২৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। অথচ জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিছুদিন আগেও বলেছিলেন, ‘একটা নিষ্ঠুর আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি দেশকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো সেনাবাহিনী আমাদের নেই।’ বোঝাই যাচ্ছে, এর চেয়ে স্ববিরোধিতা আর কি হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীও বড় সমস্যায় পড়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা বিষয়ের ওয়েবসাইট ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি মনিটরের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ‘যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বমানের সেনাবাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এখন তারা লোকবলের বড় সংকটে ভুগছে।’

স্কাই নিউজের বরাতে ‘দ্য ডিফেন্স পোস্ট’ যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনীর একগাদা সমস্যা চিহ্নিত করেছে। তারা বলছে, যদি কারও সঙ্গে যুদ্ধ বেধে যায়, তাহলে যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্র-গোলাবারুদ কয়েক দিনের মধ্যে ফুরিয়ে আসবে। আজকের দিনের যুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের যে রকম আধুনিকায়ন ঘটছে, তার তুলনায় আকাশ যুদ্ধের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে যুক্তরাজ্যের।

এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান পুরোনো হওয়ায়, সেগুলো আধুনিকায়ন করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।

আজকের যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীর যে আকার, সেটা ১৭৭৫ সালের যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবের সময়ের চেয়েও ছোট। সে সময়ে পুরো যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীর জনবল ছিল ১ লাখ ৪২ হাজার ৫৬০ জন। এখন যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীতে লোকবল মাত্র ৭৭ হাজার ৫৪০ জন। এর অর্থ হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীতে লড়াইয়ে সক্ষম সেনাসংখ্যার আরও অনেক কম। সেটা ৩০ হাজারের মতো।

ইউরোপের মধ্যে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাজ্য। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে দিতে দিতে যুক্তরাজ্য তাদের হাই-টেক অস্ত্রভান্ডার প্রায় খালি করে ফেলেছে।

ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর দুরবস্থা নিয়ে বলতে গেলে তালিকা ফুরিয়ে যাবে। আমরা জানি যে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্রান্সের অস্ত্রশস্ত্র খুব ভালো কাজ করেনি। ফ্রান্সের সিজার ট্যাংক ইউক্রেন যুদ্ধে সবাইকে হতাশ করেছে। রাশিয়ান ড্রোনের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়েছে সিজার ট্যাংক। মার্কিন থিঙ্কট্যাংক র‌্যান্ড করপোরেশনের একটি সমীক্ষা বলছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্রান্সের সেনাবাহিনী সবচেয়ে অনির্ভরযোগ্য মিত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীও জনবল নিয়োগ-সংক্রান্ত সংকটে পড়েছে। শুধু পদস্থ কর্মকর্তাদের শূন্য পদ পূরণেই তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না, নন-কমিশন্ড অফিসার (এনসিওএস) নিয়োগেও ক্ষেত্রেও ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। নন-কমিশন্ড কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অপরিহার্য অংশ, সেনাবাহিনী সচল রাখেন তাঁরাই।

মিলিটারি.কম জানাচ্ছে, কেনটাকি ফোর্ট নকে আট সপ্তাহের সেনা নিয়োগ কোর্সে কমপক্ষে ২ হাজার ৪৬৬ শিক্ষার্থীর প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। কিন্তু ২০২৩ সালে সেখানে মাত্র ১ হাজার ৩৩৬ জন স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। সৈন্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও এ বছর ও আগের বছর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে।

এ বছর যেখানে ৬৫ হাজার নতুন সেনা নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল, সেখানে ১০ হাজার সেনা কম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর গত বছরে ৬০ হাজার সেনা নিয়োগের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৫ হাজার কম নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

শুধু জনবল ও সরবরাহের ঘাটতি নয়, ন্যাটো বাহিনীর লড়াইয়ের অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। যদিও ন্যাটোর দেশগুলোর অসংখ্য উপদেষ্টা ইউক্রেনে গিয়ে যুদ্ধের পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতার মধ্যে সেনাদের পড়তে হচ্ছে, সেই বাস্তব অভিজ্ঞতা বিশেষজ্ঞদের কখনো মোকাবিলা করতে হয় না।

ইউক্রেনও তাদের সেনাবাহিনীর জন্য ব্যাপক জনবলসংকটে পড়েছে। সংকট মোকাবিলায় সরকার যে কঠোর নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তা শেষ পর্যন্ত জেলেনস্কিকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে।

রাশিয়া যেমনটা চাইছে, ইউক্রেন এখন যদি আত্মসমর্পণ করে, তাহলে ন্যাটো একটি বড় পরাজয়ের মুখে পড়বে। এই পরাজয় হবে ১৯৪৯ সালে জোট গঠনের পর সবচেয়ে বড় পরাজয়। স্টিফেন ব্রায়েন, সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো, এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

শেয়ার করুন