নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোস্তফা হোসেইন

স্ববিরোধিতার রাজনীতি

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ০২:৩০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২৩ | ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
স্ববিরোধিতার রাজনীতি

বিদ্যমান উত্তপ্ত রাজনীতির হাওয়া কোন দিক থেকে এসে কোথায় ধাক্কা দেয়, আর কোন দিকেই বা যায় বলা যাচ্ছে না। এবার জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক এই ঝড়োহাওয়া একটু আগেই বইতে শুরু করেছে। ছোট দলগুলো রাজপথে মানববন্ধনসহ কিছু কর্মসূচি দিচ্ছে বড় দলগুলোকে কাছে পেতে। বড় দলগুলো ঘুটি হাতে ঘুরঘুর করছে, কোন ঘরটাকে দখল করবে সেই আশায়। ফলে পুরো রাজনীতিই এখন ছাড়াচুলের কিশোরীর পথচলার মতো। এর মধ্যে বৃহৎ বিরোধী দল জোট ও সমমনা রাজনীতিবিদদের বগলদাবা করে নতুন চমক দেওয়ার চেষ্টা করছে। কখনও ৫৪ দল, কখনও ৩০ দল, কখনও ২০ দল—এমন শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে তাদের থেকে। কোনো দলের নিবন্ধন আছে কিংবা কার নেই, এ প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, এরা অধিকাংশই ‘আউলা বাতাসে’ ভেসে বেড়ানো রাজনৈতিক দল। শুধু তাই নয়, তারা জানে শরিক দল হিসেবে তারা যদি একটি আসনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগও পায়, তাতেই তাদের পাহাড় পাওয়া হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বড় দলগুলো কি ‘আউলা বাতাসে’ ভেসে বেড়ানো ক্ষুদ্র দলগুলোর প্রত্যেকটিকে একটি করে আসন ছাড়বে? ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কোনো নেতার নিজ এলাকাতে হয়তো কিছু ভোট আছে। তবে নিজ দলীয় নামে প্রার্থী হলে জামানতও অনেকের টিকবে না। সেই জন্য তারা পরনির্ভরতায় উৎসাহী। এর মধ্যে যারা বুঝেছেন আগের আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তারা ইতোমধ্যেই যে দল কিংবা মার্কার কল্যাণে সংসদ সদস্য হয়েছেন সেই মার্কা ও দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনাও শুরু করেছেন।

এ প্রসঙ্গে এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মো. মনসুরের কথা বলা যায়। গত নির্বাচনে তিনি বিএনপিদলীয় প্রতীক ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্যরা সম্প্রতি পদত্যাগ করলেও তিনি পদত্যাগ করেননি। সিলেট থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন গণফোরামের মোকাব্বির খানও। তিনিও সুলতান মনসুরের মতো সংসদে বহাল আছেন। জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচিত হলেও আইনগতভাবে তাদের সদস্যপদ বিলুপ্তি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তাদের জোটগত পরিচিতি বিলুপ্ত হয়নি। তারা এখনও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের এমপি হিসেবেই পরিচিত। অথচ তারা নিজ জোট সম্পর্কে এখন তীব্র সমালোচনায় মুখর। সুলতান মনসুরের বক্তব্য অনেক প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে, আসলে যে দলটি তার এত অপছন্দ; সেই দলের মনোনয়ন নিয়ে তিনি কীভাবে নির্বাচন করলেন? একই সঙ্গে প্রশ্ন আসে, আজকে বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে তিনি কি আওয়ামী লীগের মন জয় করতে চেষ্টা করছেন? সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে মেরামত করতে হবে। কাদের থেকে শুনছি? ’৭৫ সালের খুনিদের কাছ থেকে শুনছি। মেরামত শব্দটি সাধারণত পরিবারের সঙ্গে ঘর মেরামত বোঝায়। তারা কী সেই মেরামত করতে চায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটিয়ে। তারা কি সেই মেরামত করতে চান যেমনিভাবে পাকিস্তানের দালাল জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সে রকম পরিবর্তন ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন? জিয়ার দুঃশাসনে যে কারফিউর গণতন্ত্র, তারা কি সেই স্বৈরতন্ত্র করতে চান? তাদের কথা শুনলে মনে হয় ওই দিকেই যাচ্ছেন।’

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর যখন ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচনী মাঠে লড়াই করছিলেন তখন কি ১৫ আগস্টের ঘটনার কথা মনে আসেনি? আজ ‘রাষ্ট্র মেরামত’ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি খুনি হিসেবে বিএনপিকে দোষারোপ করছেন, সেই বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার সময় নিশ্চয়ই তিনি সেটা ভুলে যাননি। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসন্ন উপনির্বাচনে উকিল আব্দুস সাত্তার সংসদ সদস্য হিসেবে পদত্যাগ করলেন এবং বিএনপির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে উপনির্বাচনে প্রার্থী হলেন। শুধু তাই নয়, সেই আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী দাঁড় না করিয়ে তার বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগও তৈরি হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতা হয়েছে এমনটাও প্রকাশ হয়েছে। তিনি বলেছেন, বিএনপি তাকে কখনও মূল্যায়ন করেনি বলে তিনি প্রার্থী হয়েছেন। যে মুহূর্তে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিএনপিকে তুলাধুনা করতে শুরু করেছেন।

সুলতান মোহাম্মদ মনসুর কিংবা উকিল আব্দুস সাত্তারের ভূমিকাকে কি স্ববিরোধী বলা যায় না? সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের এমন বৈপরীত্য সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার জন্য নয়, এটা যে কেউ জানে। তা হলে কি আগাম নির্বাচনে ধানের শীষ ত্যাগ করে নৌকায় চড়ার প্রত্যাশা করছেন? আর উকিল সাহেব উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আগামী নির্বাচনেও নৌকা পাওয়ার কথা ভাবছেন কি? সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের বক্তব্য এবং উকিল আব্দুস সাত্তারের সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ আলোচনায় আনার কারণÑ জাতীয় নির্বাচনের আগে আমাদের রাজনীতিতে ছোট ছোট অনেক ঘটনাই ঘটবে এবং ঘটতে শুরু করেছে, যা আমাদের রাজনীতিতে স্ববিরোধীতারই প্রকাশ। আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন স্ববিরোধী ভূমিকা আগেও ছিল। সংসদের মধ্যেও এক সময় নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে নিজ দলকে বিপাকে ফেলার ইতিহাস আছে। হয়তো সেই চিন্তা করেই আমাদের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়েছে।

রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবে কিন্তু এমন কিছু করা ঠিক নয় যা বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে। বিএনপি তাদের ২৭ দফা রূপরেখায় ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের ঘোষণাও দিয়েছে। যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তারা যদি ৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে, তা হলে আজকে যেভাবে সুযোগ বুঝে রাজনীতিবিদরা নিজ জোটের বিরুদ্ধে কথা বলেন আগামীতে তারা কী করতে পারেন সহজেই অনুমান করা যায়। ছোট দলগুলোর নেতারা এ জোট ভেঙে ওই জোটে নাম লেখাবেন দরকার হয় টেম্পো পার্টি ভেঙে রিকশা পার্টি করবেন এমন খেলা চলতেই থাকবে। কিন্তু তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণই থেকে যাবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এই ধারা কতটা সহায়ক সেই প্রশ্নটিও থেকে যাচ্ছে।মোস্তফা হোসেইন শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। প্রতিদিনের বাংলাদেশ এর সৌজন্যে

শেয়ার করুন