নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনে স্বীকৃতি পেলেন চট্টগ্রামের এজাহারুল

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৩ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১০ জুন ২০২৩ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনে স্বীকৃতি পেলেন চট্টগ্রামের এজাহারুল

মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের বাইরে থাকা অনেক প্রবাসী আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। এদের কেউ কেউ স্বীকৃতিও পেয়েছেন। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে যুদ্ধকালে অর্থ, অস্ত্র ও পোশাক পাঠানো এজাহারুল হক ওসমানীকে স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করতে হলো দীর্ঘ ৫৩ বছর। স্বীকৃতির দাবিতে মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে সময় পার করেছে তার পরিবার।

এজাহারুলের বয়স এখন প্রায় ৯০ বছর। তিনিও তার শেষ ইচ্ছা হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে এই স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। বেশকিছু তথ্য, প্রমাণপত্র ও দলিল থাকা স্বত্ত্বেও কেবল সাক্ষীর অভাবে তার এই স্বীকৃতি আটকে ছিল দীর্ঘ সময়। অবশেষে গত সোমবার (৫ জুন) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশ্ব জনমত গঠনে অবদান রাখায় এজাহারুল হক ওসমানীকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

এই বিষয়ে গেজেটও পাস করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। উপ সচিব (গেজেট) মুহাম্মদ রেহান উদ্দিনের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিনি এই স্বীকৃতি লাভ করেন।

এজাহারুল হক ওসমানীর বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের দক্ষিণ গহিরা এলাকায়। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি আমিরাতের দুবাইয়ে ছিলেন। দুবাই থেকে তার পাঠানো আর্থিক সহায়তার দলিল ও সরকারি ধন্যবাদপত্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে নিজের কাছেই আগলে রেখেছেন তিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি পাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সেই আশা ছেড়ে দেন এজাহারুল হক।

এজাহারুল হকের সংরক্ষিত প্রমাণপত্রে দেখা যায়, সেই সময় প্রবাস থেকে দেশের পক্ষে কাজ করার জন্য তিনি ‘ফ্রেন্ডশিপ মুভমেন্ট অব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন করে তার সভাপতি এবং ‘মিত্র সংঘ’ নামে আরেকটি সংগঠন করে সেটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এই দুটি সংগঠনের মাধ্যমে তিনি মুক্তিবাহিনীর জন্য বেশ কয়েকবার আমিরাত থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ ও জাহাজে করে অস্ত্র, বেল্ট ও পোশাক পাঠান। ওই সময় তার পাঠানো টাকা, অস্ত্র, পোশাক ও বেল্ট পাওয়ার জবাবে মুজিবনগর সরকারের চিঠিসহ বিভিন্ন তথ্য তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

সংরক্ষিত কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে- মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করায় ধন্যবাদ জানিয়ে তার কাছে পাঠানো ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি হাইকমিশনার এ মোমেন চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠি। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য পাঠানো টাকার প্রাপ্তি স্বীকার ও ধন্যবাদ দিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান আনোয়ারুল করিম চৌধুরীর চিঠি।

১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল সহযোগিতার জন্য আরেকটি ধন্যবাদপত্র পাঠান আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। এরপর একই বছরের ২৩ মে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে আরেকটি ধন্যবাদপত্র পাঠানো হয়। ওই বছরের ১৫ এপ্রিল দুবাই ন্যাশনাল ব্যাংক এজাহারুল হককে বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ দিয়ে চিঠি দেয়। সেই চিঠিও সংরক্ষিত রয়েছে।

এজাহারুল হক জানান, ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে দেশের অবস্থা বেশি খারাপ হতে থাকলে পাকিস্তান থেকে নৌপথে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে যান তিনি। পরে দুবাইয়ে মডার্ন ফার্মেসি নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যান হিসেবে যোগ দেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ফ্রেন্ডশিপ মুভমেন্ট অব বাংলাদেশ ও মিত্র সংঘ প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতার কাজ শুরু করেন। ওই সময় জাহাজে করে ২০ কার্টন অস্ত্র, ১০ কার্টন কাপড় ও বেল্ট দেশে পাঠান। একই সময় কয়েক দফায় আবুধাবি ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য অর্থ তুলে (তখনকার কয়েক লাখ টাকা) দেশে পাঠান তিনি।

১৯৭৪ সালে প্রবাস থেকে ঢাকায় ফেরেন এজাহারুল হক। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার একান্ত সচিবকে চিঠি লেখেন। এরপর প্রাইভেট সেক্রেটারি অব প্রাইম মিনিস্টার ফরাসউদ্দিন চিঠির উত্তরে জানান, বঙ্গবন্ধু ব্যস্ত। পরে যোগাযোগের অনুরোধ করেন তিনি। কিন্তু ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে মনোবল ভেঙে যায় এজাহারুল হকের। এরপর এসব কাগজপত্র নিজের কাছেই রেখে দেন তিনি।

এজাহারুল হকের ছেলে আরব আমিরাত প্রবাসী ওসমান হক জানান, প্রবাসে থেকেও বাবা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। সেসব দলিল আমাদের কাছে রয়েছে। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য নয়, শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের হয়ে বাবা যে কাজ করেছেন সেই স্বীকৃতিটুকুর জন্য আমরা বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেছি। একাধিকবার বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো জবাব আসেনি। জেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই শুরু হলে সেখানেও আমরা আবেদন করি।

জেলা পর্যায়ে সেই আবেদন করা হলে সশরীরে সাক্ষী চান তৎকালীন রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে অবদান থাকলেও বাবার স্বীকৃতি আটকে যায়। কারণ প্রবাসে বাবার এসব কাজের একমাত্র সাক্ষী ছিলেন দুবাইয়ের ব্যবসায়ী কবির আহম্মদ সওদাগর। তিনি মারা গেছেন। তবে আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, কোনো একদিন বাবা মুক্তিযুদ্ধে দেশের পক্ষে কাজ করার এই স্বীকৃতি পাবেন।

তার আরেক ছেলে ফোরকান হক জানান, সর্বশেষ ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যুদ্ধকালীন প্রবাসে জনমত গঠনে সক্রিয় সংগঠক ও সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ করে এজাহারুল হকের স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে তারা। সবকিছু বিবেচনা পর অবশেষে মন্ত্রণালয় তাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। গত সোমবার (৫ জুন) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তার এই স্বীকৃতির বিষয়টি প্রকাশ করে। এই স্বীকৃতিতে রাষ্ট্রের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন এজাহারুল হক ওসমানী ও তার পরিবার। সুত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ

সুমি-পরিচয়

শেয়ার করুন