নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ১৪ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ড. ফরিদুল আলম

ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের গুরুত্ব কেন বাড়ছে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৩ | ০৩:১৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৭ জুন ২০২৩ | ০৩:১৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের গুরুত্ব কেন বাড়ছে

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানোর বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে। আমরা দেখছি বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী কিংবা তাদের কোনো ফোরামে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি আমাদের দেশে দায়িত্ব পালনরত কোনো কোনো কূটনৈতিক কথা বলছেন। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কর্তৃক বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত নতুন ভিসা নীতির পর তা আবার অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। দিন যতই যাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে বিএনপির উদ্বেগও যেন ততই বাড়ছে।

তাই তারা বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন বিদেশি মিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার মধ্য দিয়ে নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে। যদিও বিএনপির রাজনীতিতে এটি নতুন নয়, বরং সরকারবিরোধী কর্মসূচিতে মাঠের ব্যর্থতা পুষিয়ে নিতে তারা এমনটিই করে আসছে। বিএনপির প্রতিনিধিরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন এবং অস্ট্রেলিয়ার দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে দেওয়া তাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের মাধ্যমে তারা এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে চায়।

ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন দেশের দায়িত্বশীল পর্যায়ের ব্যক্তিসহ বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিক্রিয়াও কমবেশি দেখছি। গত ৮ জুন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আগামী নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তার দেশ হস্তক্ষেপ করাকে সমীচীন মনে করে না।

ভারতের তরফেও কিছু প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরে মোদি সরকারের ৯ বছরের সাফল্য তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বিদেশি হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না এবং বাংলাদেশের জনগণই নির্ধারণ করবে কোন ধরনের সংস্কার প্রক্রিয়া তারা চায়।

সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষিত নীতি নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে মোদি সরকারের কাছে। বিষয়টি ভারত সরকার যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে দেখছে বলে জানা যায়। প্রধানমন্ত্রী মোদির ওয়াশিংটন সফরে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে বিষয়টি মোদি উত্থাপন করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত সরকার মনে করে, কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং ভারত- যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বাস্তবায়নে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ।

এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নীতি এবং অবস্থান তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সম্মেলনে যে ১৫ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছেন, সেখানে এই অঞ্চলের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি উদার, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথাই বলা হয়েছে।

একদিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারতের মোদি সরকারের সুসম্পর্ক, অন্যদিকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সাম্প্রতিক টানাপড়েনÑ এ সবকিছু মেরামতে ভারত সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, ভারত সরকারের তরফ থেকে এর বাইরে খুব একটা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে বলা হয়নি। তবে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের এবং সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের প্রতিক্রিয়া থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশের গুরুত্ব তাদের জন্য ধীরে ধীরে বাড়ছে।

আর এর অবশ্যম্ভাবী কারণ হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ে, ক্রমবর্ধমান রুশ-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের সম্ভাবনা ইত্যাদি। এও লক্ষণীয়, এ সবকিছুর ক্ষেত্রে যে অভিন্ন উদ্বেগ, তা হছে চীনকে নিয়ে। বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান উন্নতিকে উল্লিখিত দেশগুলো সহজভাবে নিতে পারছে না।

বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ এবং বাংলাদেশের তরফে বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলাকে আমাদের সক্ষমতাকেই ইঙ্গিত করে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমাদের দরকষাকষি বৃদ্ধির পাশাপাশি ২০৩৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে চীনের বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে আরও এগিয়ে নিতে পারে। এই শক্তিগুলোর শঙ্কা হচ্ছেÑ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তারা নিজেদের মতো করে প্রভাবিত করতে পারছে না, বরং বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষায় জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন শেখ হাসিনা।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য চীন সমর্থন করে। তবে এ সবকিছুকে ছাপিয়ে ভারতের উপলব্ধির জায়গাটি হচ্ছেÑ কোনোভাবে বিদেশি হস্তক্ষেপ যদি বাংলাদেশে জেঁকে বসে তা হলে এ দেশে মৌলবাদী শক্তির নতুন বিকাশ ঘটবে, যা এ অঞ্চলের সন্ত্রাসবাদকে একটি নতুন মাত্রা দেবে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি তথা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়কে সামনে এনে তাই এখানে কার্যত এক ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার প্রবণতাই লক্ষণীয়। বিশ্বের অনেক দেশেই অনেক বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে কোনো বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সোচ্চার দেখা না গেলেও এক্ষেত্রে তারা মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করতে চাইছে এই ভেবে যে, এর ফলে বিরোধী শক্তির নির্দিষ্ট জনমত সরকারকে ভীত করে তাদের সঙ্গে আপসে যেতে বাধ্য করবে।

আর এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ প্রশ্রয় পাচ্ছে, যা বিএনপি অনেকটা আমন্ত্রণ করেই আনছে। এক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মানের রাষ্ট্রদূত ১৭ মার্চ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যান। সেখানে দলটির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।

সাক্ষাৎ শেষে জার্মান রাষ্ট্রদূত বেরিয়ে গেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানান, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জার্মান রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সংবাদমাধ্যমের বরাতে বিষয়টি জার্মান রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি তার হতাশা প্রকাশ করে জানান, এ ধরনের কোনো বিষয় নিয়ে তিনি তার উদ্বেগের কথা বিএনপি নেতাদের জানাননি। বরং এমন কিছু বলার থাকলে তিনি নিজেই তা স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে পারতেন। প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল জানান, রাষ্ট্রদূত বিএনপিকে ‘মিসকোট’ করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যৎসামান্য জ্ঞান থেকে যে বিষয়টি উদ্ধার করতে পেরেছি সেই জায়গা থেকে বলতে পারি, বিদেশি কোনো দূত বা প্রতিনিধি দল যখনই সরকারের কোনো স্তরে অথবা প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তখনই রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে বিদেশিদের কাছে নানা ধরনের অভিযোগ করে থাকে। আমাদের রাজনীতির এটাই হচ্ছে নেতিবাচক দিক। বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করতে চাওয়ার আগেই আমরা তাদের সেই সুযোগ করে দিই।

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির চালচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলটি ২০০৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার ভারত এবং এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি চীনের সঙ্গে যেভাবে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। এতে করে দুটি দেশই তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে বাংলাদেশকে পাশে চাইছে।

এর বিনিময়ে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক হারে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে অভাবনীয় চাঞ্চল্য। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের দিকে বিদেশি অনেকের দৃষ্টিই গভীর হয়েছে।বাংলাদেশ নিজের অবস্থান শক্ত করেছে।

কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো অচলাবস্থা যদি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতিকূলে যায়, তাহলে সঙ্গত কারণেই অপরাপর দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত কিছু মানদণ্ডের ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্তের আগে অবশ্যই পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলোকে মাথায় রাখতে হয়।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সৃষ্ট উদ্বেগ নিরসনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে মাত্র, যা বাংলাদেশ সরকারকে তাদের দিক থেকে একটা বার্তা দেওয়া। আর এর মূল কারণ যতটুকু না তাদের নিজস্ব বিশ্লেষণ থেকে এই সিদ্ধান্ত, এর চেয়ে বেশি ভূমিকা হচ্ছে আমাদের বিরোধী কোনো এক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দীর্ঘসময় ধরে লবিং করে তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করা। এর মধ্য দিয়ে আসলে আমরা প্রকারান্তরে আমাদের নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছি।

বর্তমানে এ দেশে তাদের নিজস্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মতো অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তন ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে সরকার পরিবর্তন কেবল আমাদের নিজেদের নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্যও সুখকর হবে না।

দেশের সরকার, নির্বাচন এবং সংবিধান নিয়ে আজকাল তারা যেভাবে সরব হয়েছে, আমরাও চাই সরকারকে সঠিক এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনতে শক্তিশালী বিরোধী দলসহ রাজনীতি সরব থাকুক। তবে যারা সরকারের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনছেন তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড কতটুকু যৌক্তিক , তা-ও ভেবে দেখা দরকার। কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সুত্র প্রতিদিনের বাংলাদেশ

সুমি/পরিচয়

শেয়ার করুন