নিউইয়র্ক     সোমবার, ২৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

বিএনপির ২৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০৩:৩৫ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ০৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বিএনপির ২৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা

বিএনপির সমাবেশের চিত্র। ছবি : নিউইয়র্ক টাইমস

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ৫০ লাখ সদস্যের প্রায় অর্ধেক (২৫ লাখ) নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে এসব নেতাকর্মীকে আন্দোলনের চেয়ে কোর্টে হাজিরা ও মামলা চালানো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস বিষয়টি নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কালবেলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির চৌম্বক অংশ তুলে ধরা হলো…

১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে শ্বাসরোধ করা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন বিরোধীদলের হাজারো নেতাকর্মী, সদস্য ও সমর্থকদের আদালতে বিচারকের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। তাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগই ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং দুর্বল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কয়েক মাস আগে এ অচলাবস্থার প্রভাব স্পষ্ট।

প্রধান বিরোধীশক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রায় ৫০ লাখ কর্মীর অর্ধেকই (প্রায় ২৫ লাখ) রাজনৈতিক মামলার শিকার। সবচেয়ে সচল নেতা ও সংগঠকরা ডজন এমনকি শত শত মামলার শিকার হয়েছেন। যাদের এখন মিছিলে থাকা অথবা মধ্যরাত অবধি বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে চিন্তাভাবনার কথা ছিল- তাদের উকিলের চেম্বার, কোর্টরুমের চার কোনা খাঁচা এবং এ দুটি জায়গার মধ্যে তীব্র যানজটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এভাবেই তাদের দমিয়ে রাখা হয়েছে।

সম্প্রতি এক সকালে বিএনপির নেতা সাইফুল আলম নিরবকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাতকড়া পরিয়ে তোলা হয়।নিরবের নামে ৩১৭ থেকে ৩৯৪টি মামলা রয়েছে। তার উকিলরাও মামলার সংখ্যা নিয়ে নিশ্চিত নন। আদালতের বাইরে আরও ডজনখানেক সমর্থক ছিলেন যাদের বিরুদ্ধে ৪০০টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। তারা একটি গলিতে অপেক্ষা করছিল যেটি বৃষ্টিতে স্যাঁতসেঁতে হয়েছিল। নতুন রাজনৈতিক বন্দিদের জায়গা দিতে সেখান থেকে পুলিশ বারবার বাঁশি বাজিয়ে তাদের সরিয়ে দিচ্ছিল।

আবদুল সাত্তার নামের এক সমর্থকের নামে ৬০টি মামলা রয়েছে। সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন কোর্টেই সময় কাটে তার। তিনি বলেন, ‘একটা থেকে আরেকটা মামলার কাজে দৌড়ানো আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে উঠছে না।

সম্প্রতি বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের কথা আমরা জানি। গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির কারণে ডলারের প্রবাহ বেড়েছে। অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। আমেরিকান কর্মকর্তারা যে দেশটিকে দুর্ভিক্ষ আর রোগের ঝুড়ি হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং কয়েক দশক ধরে ক্যু এবং পালটা ক্যু চলেছে। হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে প্রত্যাশিত নির্বাচনের আগে আরেকটি বিস্ফোরণের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। বিএনপি আগামী নির্বাচনকে তাদের শেষ লড়াই হিসেবে দেখছে। আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন, আমরা কোনোভাবেই বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দিতে পারি না। তারা ক্ষমতায় আসলে আমাদের মেরে ফেলবে।

বিএনপি নেতারা দাবি করেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের প্রায় ৮০০ নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং ৪০০ জন গুম হয়েছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনুরূপ কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এ সময় তিনি হাজারো নেতাকর্মীদের জেল এবং হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, এটা তারা শুরু করেছে।

৭৫ বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার এবং পাকিস্তানের কাছ থেকে ১৯৭১ সালে তিনি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়া জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি বিদ্রোহী সেনাদের হাতে নিহত হন। বলা চলে তখন থেকেই দুই নেত্রী লড়াইয়ের চক্রে আবদ্ধ হয়েছেন।

শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার লক্ষ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।’ খালেদা জিয়ার স্বামীর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘বিএনপি সেনা ছাউনি থেকে সৃষ্টি হয়েছে।’ খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের পর থেকে জেলে রয়েছেন। বর্তমানে তিনি গৃহবন্দি এবং তার স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটছে। তিনি বর্তমানে টেলিভিশন ও পত্রিকা পড়ে সময় কাটান।

২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার অভিযোগ রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। বর্তমানে তিনি লন্ডনে রয়েছেন। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৯৩টি মামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি যতটা পারেন দলকে টেনে নিচ্ছেন।

করোনা মহামারি ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের অর্থনীতিতে এটা বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্যমূল্য ও বিদ্যুতের ঘাটতি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। যখন শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই নির্বাচন করার কথা বলছেন তখন বিরোধীদল জনমনে সৃষ্ট সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার ভয়, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুতের ঘাটতির মতো সমস্যাকে কাজে লাগাতে চাইছে।

কিছুদিন আগে বড় একটি র‍্যালির আয়োজন করে বিএনপি। সেখানে তারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন এবং আটক দলীয় রাজনৈতিকদের মুক্তি দাবি করে। তবে তারা ঢাকার দিকে যতই এগিয়ে আসতে থাকে স্লোগানগুলো ততই উত্তেজনাকর হয়ে পড়ছিল।

একই সময়ে পুলিশের বাধাহীন অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে একটি মিছিলের আয়োজন করা হয় যেখানে নেতারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সমালোচনা করেন। তাদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কথা স্বীকার করেন। সম্প্রতি আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে তারা।

তার কয়েক সপ্তাহ পর বিএনপি আরেকটি মিছিলের আয়োজন করতে গেলে সরকার শক্তি প্রদর্শন করে। এ সময় ৫০০টি নতুন মামলা করা হয়। এতে এটাই প্রমাণ হয় যে পশ্চিমারা যতই নিষেধাজ্ঞা দিক না কেন সরকার তাতে খুব বেশি প্রভাবিত হবে না।

জনগণের ওপর সরকার খড়গহস্ত বলে মন্তব্য করেন নির্বাসিত আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী আশরাফ জামান। তিনি বর্তমানে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, পুলিশ একই মামলায় অনেক মানুষকে অভিযুক্ত করছে। এসবের ভেতর রয়েছে- রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড অথবা পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার মতো মামলা। এসব মামলায় নাম পরিচয়হীন অনেকের কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে যাতে নতুনদেরও যেকানো সময় এসব মামলায় অন্তর্ভুক্ত ও গ্রেফতার করা যায়।

মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, অভিযুক্তরা মাসের পর মাস জেলে থাকেন, সেখানে নানা হয়রানির শিকার হন। আইনজীবীরা বলেন, রাজনৈতিক মামলায় জামিন পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশরাফ জামান আরও বলেন, অবস্থা এমন যে বিবাদীপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে বলেন, ‘আমার মক্কেলের একটি পরিবার রয়েছে। তিনি ইতোমধ্যেই অনেকসময় জেল খেটেছেন, আদালত যদি তার মক্কেলের জামিন মঞ্জুর করে তাহলে খুব ভালো হয়… ’

রাজনৈতিক মামলার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট একটি ব্যস্ত জায়গা। এখানে বিএনপি নেতা নিরবকে ৩শ’রও বেশি মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। জুনের এক সকালে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার আইনজীবী সৈয়দ নজরুল জানান, নিরবের নামে ঢাকার প্রতিটি থানায় অন্তত একটি মামলা রয়েছে।

আদালতে তোলা হচ্ছে তিনশোরও বেশি রাজনৈতিক মামলার আসামি সাইফুল আলম নিরবকে। ছবি : দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।

বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগে প্রতিদিন ২০৫ নম্বর কক্ষে আইনজীবীদের ভীড় জমে। এখানে সৈয়দ নজরুল শেষবারের মতো ফাইলপত্র যাচাই করে নেন। জুনের ১২ তারিখে অফিসটির নথি থেকে জানা যায়, আইনজীবীদের দলটি ৩৩টি মামলা নিয়ে কাজ করছিল যার ৩২টিই বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা সংক্রান্ত।

নজরুল আরও জানান, ‘শুনানি বড়জোড় ২০ মিনিটের জন্য চলে। তবে সারাদিন এটুকু সময়ের জন্য এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়িয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়। ’ যারা রাজনৈতিক এ দুই পক্ষের নোংরা দ্বন্দ্বের কোনোদিকেই নেই তাদেরকেও বিভিন্ন আন্দোলনের কারণে জন্য চরম মূল্য দিতে হয়।

দিদারুল ভূইয়া একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী। অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা শেষ করে তিনি বাংলাদেশে ফিরেছেন। তিনি একটি ছোট সফটওয়্যার কোম্পানিও খোলেন এবং বিয়ের পর সন্তানের পিতা হন। তবে একটি প্রশ্ন তাকে কুড়ে খাচ্ছে, তিনি কি দেশে ফেরত এসে সঠিক কাজটি করেছেন? দিদারুল নাগরিক সমাজের আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন এবং দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, যখনই কেউ ক্ষমতা পায় তখন তারা আইনের উর্ধ্বে চলে যায়।

করোনা মহামারি চলাকালে দিদারুল ও তার সংগঠন যখন রিলিফ ফান্ডের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করেন তখন সাদা পোশাকে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা কালো কাঁচে ঢাকা গাড়িতে করে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে পাঁচ মাস জেল খাটতে হয়। দিদারুলের স্ত্রী দিলশাদ আরা বেগম বলেন, ‘গুম হওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে। আমরা চিন্তিত ছিলাম আমার স্বামীর ভাগ্যেও এমনটা ঘটেছে কিনা।’ আদালত থেকে আদালতে স্বামীর জামিনের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। দিদারুল বলেন, ‘বিচারক শুধু নাম পড়তেন এবং মামলার দিকে তাকাতেন এবং এরপর বলতেন, দুঃখিত আমি পারব না।’

পাঁচ মাস জেলে কাটানোর পর দিদারুল জামিন পান। পুলিশ এক বছর পেরিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দেয়নি। তবে তার বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রমাণ হিসেবে একটি ফেসবুক পোস্ট দেখানো হয়েছে যা দিদারুল তার মুক্তি পাওয়ার কয়েকমাস পরে লিখেছেন।

তার মতোই আরেক আন্দোলনকর্মী মুশতাক আহমেদ। তাকেও দিদারুলের মতো একই সময়ে আটক করা হয়েছিল। তিনি জেলেই মারা যান। দিদারুল ভূইয়ার অফিসে মুশতাক আহমেদের একটি বড় ছবি টাঙানো আছে। দিদারুল বলেন, ‘১০ মাস বিচার ছাড়া কাউকে কারাবন্দি রাখা তার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট।’ মুজিব মাশাল : নিউইয়র্ক টাইমসের সাউথ এশিয়ার ব্যুরোপ্রধান। ভাষান্তর : সরকার জারিফ।

শেয়ার করুন