নিউইয়র্ক     বুধবার, ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাদেকুর রহমান

প্রবাসীরা কেন রোমানিয়া থেকে ইউরোপে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
প্রবাসীরা কেন রোমানিয়া থেকে ইউরোপে

বাংলাদেশের অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের মধ্যে বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশের মতো রোমানিয়ায় যাওয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে দুই শ্রেণির লোক দেখা যায়। একটি শ্রেণি হলো, তারা ইউরোপের স্বপ্ন-সাধ রোমানিয়া গমনের মাধ্যমে পূরণ করে থাকেন। আরেক শ্রেণির অভিবাসনপ্রত্যাশী হলো, যারা ফ্রান্স, পর্তুগাল, ইতালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ইত্যাদি সেনজেনভুক্ত দেশে পাড়ি জমানোর প্রথম ধাপ হিসেবে রোমানিয়া যান। আলোচ্য শেষোক্ত শ্রেণির অভিবাসীরাই রোমানিয়ার শ্রমবাজারকে হুমকির মুখে ফেলেছেন।

বলকান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রোমানিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকার সফল কূটনৈতিক তৎপরতার কল্যাণে ২০২০ সাল থেকে ফের কর্মী নেয়া শুরু করে দেশটি। তখন থেকে দেশটিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কর্মীরা যাচ্ছেন। রোমানিয়া বাংলাদেশিদের জন্য ২০২০ সালে ৫৮০টি, ২০২১ সালে দুই হাজার ৮৬৯টি আর ২০২২ সালে ১২ হাজার ৯৬০টি ভিসা দিয়েছে। তবে সেখানে এখন অবস্থান করছেন মাত্র তিন হাজার ৯৬ জন বাংলাদেশি কর্মী। বেশির ভাগই রোমানিয়া থেকে তাদের কাজের মেয়াদ শেষ না করেই অন্য দেশে, বিশেষ করে ইউরোপের তৃতীয় কোনো দেশে প্রবেশ করছেন। কেউ কেউ রোমানিয়ায় গিয়ে ১০-২০ দিন কিংবা এক-দুই মাস পরেই ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানিতে পালাচ্ছেন।

সবাই যে নিরাপদে পালাতে সক্ষম হন তাও নয়। অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে দেশে ফেরত আসছেন শূন্য হাতে। পালিয়ে যাওয়া কর্মীরা ধরা পড়লে সাজা হিসেবে পাঁচ বছর পর্যন্ত কালো তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই ঢাকাকে তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছে বুখারেস্ট। সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসও এর সত্যতা স্বীকার করেছে, ঢাকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি এসেছে।

রোমানিয়ার ছয় সদস্যের একটি কনস্যুলার প্রতিনিধিদল গত ৫ মার্চ ঢাকায় এসেছে। তারা ৭ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজও শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করবে প্রতিনিধিদলটি। এ সময় দেশটি ১৫ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশিকে ভিসা দেয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত বছর (২০২২) রোমানিয়া থেকে একটি কনস্যুলার প্রতিনিধিদল ঢাকায় তিন মাস অবস্থান করে প্রায় ৫ হাজার ৪০০ ভিসা দেয়। এর ধারাবাহিকতা হিসেবেই নয়া কনস্যুলার দলের ঢাকায় আগমন। প্রতিনিধিদলটি রোমানিয়া থেকে যারাই ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে আসবে তাদের ভিসা দেবে। বাংলাদেশে রোমানিয়ার স্থায়ী দূতাবাস নেই। রোমানিয়াগামী শ্রমিকদের ভিসা স্ট্যাম্পিংয়ের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের আগে দিল্লিতে যেতে হতো।

সাবেক এ কমিউনিস্ট দেশটি চলতি ২০২৩ সালে ১ লাখ বিদেশি কর্মী নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী নেবে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু তাদের ভিসা ও বিশ্বাসের মর্যাদা দলিত-মথিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বড় অংশ একটা অসদুদ্দেশ্য নিয়েই রোমানিয়া গিয়ে নামকাওয়াস্তে কাজে যোগ দিয়ে বা কাজ না করেই সেখান থেকে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এতে রোমানিয়া সরকার যেমন ভিসা দিয়েও কর্মী না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের ইমেজও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশের কর্মীদের পক্ষ থেকে মোটা দাগে কয়েকটি ‘অভিযোগ’ তোলা হয়- রোমানিয়ায় বেতন কম, শ্রম আইনের লঙ্ঘন করে খারাপ ও বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করানো, থাকার পরিবেশ আরামদায়ক না হওয়া, চুক্তি অনুযায়ী বেতন না পাওয়া ইত্যাদি। কর্মীদের এসব ‘অভিযোগ’ অমূলক না হলেও বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কোনো কর্মী সরকারি বা বেসরকারি যে মাধ্যমেই রোমানিয়া গমন করুন না কেন, তাকে সতর্কতার সঙ্গে ও সচেতনভাবে ওয়ার্ক পারমিট দেখে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাংলাদেশ ত্যাগ করা প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ইউরোপের অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে রোমানিয়াকে তুলনা করলে চলবে না। যদিও অনেকে আবেগের বশবর্তী হয়ে রোমানিয়া সম্পর্কে না জেনেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আবার অনেকের সুপ্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে রোমানিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে স্বপ্নের কোনো দেশে চলে যাওয়ার। অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি, দালাল-সিন্ডিকেটও রোমানিয়া সম্পর্কে প্রলুব্ধমূলক কথাবার্তা বলে থাকে। এতে বিদেশ গমনেচ্ছু, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বিভ্রান্তি ও প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে।

যেসব বাংলাদেশি কর্মী জীবন ও সম্মানের ঝুঁকি নিয়ে রোমানিয়া থেকে ইউরোপের অন্য দেশে চলে যান তাদের বেশির ভাগকেই কর্মহীন বা ফেরারি জীবনযাপন করতে হয়। করোনাভাইরাসের তাণ্ডব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে চলমান বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে অনেক দেশই বিদেশি কর্মী নেয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের কর্মী প্রেরণের গন্তব্য দেশগুলোর অনেকেই মুখে না বললেও আরোপিত শর্তের বেড়াজালে কর্মী পাঠানো যাচ্ছে না। এমন সময়ে রোমানিয়ার শ্রমবাজার নতুন আশার আলো বৈকি!

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো ব্যবহার করে ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে প্রবেশের প্রবণতা বাড়ছে, যেটা ‘নিয়মিত অভিবাসন’ নয়। এটা রীতিমতো ‘মানব পাচার’। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের চেয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকেই বেছে নেয়া হচ্ছে। রোমানিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে কাজের সুযোগ খুব একটা থাকে না। এমনকি এসব দেশে দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ দুই, চার কিংবা পাঁচ বছর মেয়াদে ভিসাও দেয়া হয় না। রোমানিয়ায় প্রাথমিকভাবে সাধারণত তিন মাসের ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া যায়। তারপর স্থায়ী ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করতে হয়।

ইউরোপ মহাদেশের দ্বাদশ বৃহত্তম রাষ্ট্র রোমানিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হলেও এখনো সেনজেনভুক্ত হয়নি। অথচ একশ্রেণির এজেন্সি রোমানিয়াকে ‘খুব শিগগির সেনজেনভুক্ত হয়ে যাবে এবং তখন প্রসেসিং চার্জ বেড়ে যাবে’ বলে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। প্রকৃত সত্য হলো, সেনজেনভুক্ত অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের কারণে রোমানিয়া আটকে আছে। ২০২৪ সালে রোমানিয়া সেনজেনভুক্ত হতে পারে বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে আভাস দেয়া হলেও চূড়ান্ত অনুমোদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। ইইউয়ের অনুমোদনের পরও অন্য সেনজেনভুক্ত সদস্যের শর্ত ও স্বার্থের কারণে বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে পারে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ক্রোয়েশিয়া। গত ডিসেম্বরে ইইউ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে অনুমোদন মিললেও কিছু সংস্কার সাপেক্ষে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ক্রোয়েশিয়া ২৭তম সেনজেনভুক্ত দেশ হিসেবে নবযাত্রা শুরু করতে পারে। সেনজেন চুক্তি অনুযায়ী, এসব দেশের আন্তসীমানা অকার্যকর হয়ে গিয়ে সেনজেনভুক্ত সব রাষ্ট্রের মানুষ অবাধে যাতায়াত করতে পারে।

ইউরোপ মহাদেশের অন্য দেশগুলো থেকে রোমানিয়া তুলনামূলকভাবে কম সচ্ছল অর্থনীতির দেশ। আর এ কারণে এ দেশের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানও ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষের চেয়ে নিম্নমানের। তবে রোমানিয়ার মানুষেরা খুবই পরিশ্রমী এবং এ কারণেই দেশটি খুব দ্রুত উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

রোমানিয়ার মানুষ তাদের বন্ধুসুলভ আচরণ এবং অতিথি আপ্যায়নের জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে খুবই সমাদৃত। এসব বিবেচনায় রোমানিয়া বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো শ্রমবাজার হতে পারে। বাংলাদেশি কর্মীরা রোমানিয়ায় গিয়ে চুক্তি অনুযায়ী কাজ করলে সে দেশে দেশের ইমেজ ভালো থাকবে। আর সেটা হলে, বাংলাদেশ থেকে আরও কর্মী রোমানিয়া যাওয়ার সুযোগ পাবেন।

দুই দেশের কর্তৃপক্ষের উচিত, নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ম মেনে হলেও বাংলাদেশে রিক্রুটিং এজেন্সির কথা এবং রোমানিয়ায় বাস্তবতায় কোনো মিল না থাকার বিষয়টি প্রয়োজনীয় তদন্ত সাপেক্ষে জরুরিভিত্তিতে ন্যায্য সমাধান করা। রিক্রুটিং লাইসেন্স ছাড়াই কিছু ব্যক্তি ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে লোক পাঠানোর চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে কর্মীদের প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এসব প্রতারক নামধারী ব্যবসায়ীদের দ্রুত চিহ্নিত করতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

দেশটিতে দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করার পাশাপাশি অবশ্যই কর্মী পালানো বন্ধ করতে দূতাবাসের মাধ্যমে রোমানিয়া অভিবাসীদের তালিকা সংরক্ষণ ও মনিটরিংসহ সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকেও অভিবাসন খাতে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠিত করতে আন্তরিক হতে হবে। আর বিদেশগমনেচ্ছু ও অভিবাসীদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে রোমানিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে সে দেশটিতে অবস্থানকাল পর্যন্ত। প্রবাসীরা অতি লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিহার করে রোমানিয়াতেই থাকুন। এর সঙ্গে দেশের অর্থনীতি ও মানমর্যাদা দুটোই নিবিড়ভাবে জড়িত। কোনো কারণেই যেন রোমানিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ না হয়! সাদেকুর রহমান সাংবাদিক ও গবেষক। দৈনিক বাংলা-র সৌজন্যে

শেয়ার করুন