নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ১০ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ওয়াশিংটন ডিসি সফরকালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বড় অঙ্কের চুক্তি হতে পারে

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:১৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৭ মে ২০২৩ | ০১:২৫ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ওয়াশিংটন ডিসি সফরকালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বড় অঙ্কের চুক্তি হতে পারে

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াশিংটন সফরে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বড় অঙ্কের ঋণ চুক্তি হতে পারে। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পে ১২৫ কোটি (১.২৫ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। আরও তিনটি প্রকল্পে প্রায় ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলারের ঋণের বিষয়টি নিয়েও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই পাঁচ প্রকল্পের জন্য সব মিলিয়ে ২ দশমিক ২০ থেকে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সই হতে পারে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিস সূত্রে জানা গেছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী পালন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ১ মে সংস্থার ওয়াশিংটন সদর দপ্তরে এই অনুষ্ঠান হবে।চার দিনের সফরে ২৫ এপ্রিল জাপান যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি জাপানে থাকবেন। ২৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী জাপান থেকে সরাসরি ওয়াশিংটন যাবেন বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে একটি বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অনেক আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস।’

২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ চুক্তি প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠান বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ও বিশ্বব্যাংকপ্রধান উপস্থিত থাকবেন। সেখানে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে অবশ্যই ভালো কিছু হতে পারে।’এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান গত বুধবার (১৯ এপ্রিল) বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উন্নয়ন অংশীদার। তাদের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প চলমান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরে কোনো ঋণচুক্তি হবে কি না- সে বিষয়ে কিছু বলার মতো অবস্থা এখনো আসেনি। বিষয়টি পিএমও ফরেন মিনিস্ট্রি দেখছে। তারা ভালো বলতে পারবে।’

প্রায় ১০ বছর আগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দেয়। দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ সহায়তার অনুরোধ প্রত্যাহার করে নেয়ার পর নিজস্ব অর্থে এই সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। গত বছরের জুনে চালু হয়েছে সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সেতুটি একদিকে যেমন বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে; তেমনি পুরোপুরি নিজস্ব অর্থে এই সেতু নির্মাণ করে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ না নিলেও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের তেমন অবনতি হয়নি। উন্নয়ন সংস্থাটি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন অব্যাহত রেখেছে। এমনকি পদ্মা সেতুতে যে অর্থায়ন করার কথা ছিল, তার চেয়েও বেশি অর্থ অতিরিক্ত হিসেবে অন্য প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে।

এদিকে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বসন্তকালীন বৈঠক শেষ হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল। ১০ এপ্রিল ওয়াশিংটনে দুই সংস্থার সদর দপ্তরে শুরু হয় ওই বৈঠক। বৈঠকে বাংলাদেশের ছয় সদস্যের দলের নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গভর্নরের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান, অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ও অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রেহানা পারভীন এতে যোগ দেন।

প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘বৈঠক চলাকালে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফর নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা শেখ হাসিনাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আশা করছি, এর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের নতুন এক মাত্রা যোগ হবে।’

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একাধিক প্রকল্পে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণসহায়তার চুক্তি হতে পারে। সফরের সময় ঋণচুক্তি হতে পারে, এমন দুটি প্রকল্পের বিষয় প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এই দুটি প্রকল্পের একটি হলো আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ করে নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে সড়কসহ অন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। এই প্রকল্পে ৭৫ কোটি ডলার ঋণ দিতে পারে বিশ্বব্যাংক।

অন্যদিকে ভাঙন থেকে নদীতীর রক্ষা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের আরেকটি প্রকল্পে ৫০ কোটি ডলার দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এই প্রকল্পের আওতায় মূলত প্রকল্প এলাকায় বন্যাসহ অন্যান্য দুর্যোগ থেকে মানুষ বাঁচাতে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। জানা গেছে, আরও দুই-তিনটি প্রকল্পে ঋণসহায়তা নিয়ে আলোচনা চলছে। দর-কষাকষি চূড়ান্ত হয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এসব ঋণচুক্তি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সহায়তার পরিমাণ আরও বাড়বে।

ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠান : আগামী ১ মে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে দুই দেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির সমাপনী অনুষ্ঠান হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে গত জানুয়ারিতে ঢাকায় প্রথম পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়।

সমাপনী অনুষ্ঠানের দিন সকালে একটি আলোচনা সভা হবে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বক্তব্য দেবেন। আলোচনা সভায় বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া দুই পক্ষের মধ্যে একাধিক ঋণচুক্তি হতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রা নিয়ে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে। এর বাইরে মূল অনুষ্ঠানের পাশাপাশি একাধিক সাইডলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা এখন প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি চূড়ান্ত করছেন।

গত ৫০ বছরে ৩৮ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে বিশ্বব্যাংক : গত ৫০ বছরে বাংলাদেশকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮০০ কোটি (৩৮ বিলিয়ন) ডলার দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এই অর্থ কাজে লেগেছে দারিদ্র্যবিমোচনে। রাস্তাঘাট, ভবনসহ বড় অবকাঠামো নির্মাণেও অর্থ দিয়েছে এই বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন খাতে বিশ্বব্যাংক দশকের পর দশক অর্থ দিয়ে আসছে। বর্তমানে ৫৭টি চলমান প্রকল্পে ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে বিশ্বব্যাংক।

সত্তরের দশকে মূলত পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন প্রকল্পেই বেশি অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক। আশির দশকে কৃষি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে তারা। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে সংস্কারে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশে দুটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প হয়। এ দুটি প্রকল্প হলো বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু (যমুনা সেতু) এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (দুই লেন) নির্মাণ। এ ছাড়া তাদের সহায়তায় ২৬টি জেলায় মোট ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার পল্লি সড়ক নির্মাণ করা হয়।

বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে গত পাঁচ দশকের সম্পর্ক সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে। পদ্মা সেতুতে তাদের ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল। পদ্মা সেতুই হতে পারত কোনো একক প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে বড় অর্থায়ন। কিন্তু দুর্নীতি হতে পারে- এমন অভিযোগ এনে ২০১১ সালে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় সংস্থাটি। সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও কানাডার আদালত, কোথাও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ৩২ হাজার কোটি টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে।সুত্র : দৈনিক বাংলা

সুমি/পরিচয়

শেয়ার করুন