নিউইয়র্ক     সোমবার, ১৩ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মফিদুল হক

পঙ্কজ ভট্টাচার্য : সন্ত ও যুবরাজ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:২১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:২১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : সন্ত ও যুবরাজ

পঙ্কজ ভট্টাচার্য : জন্ম ৬ আগস্ট ১৯৩৯ – মৃত্যু ২৩ এপ্রিল ২০২৩

তাঁকে প্রথম দেখি ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, আমাদের কলেজ জীবনে। ছাত্র আন্দেলনের ঢেউ সদ্য-তরুণদের তখন আলোড়িত করছে, আমরা পথ খুঁজছি, ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে অগ্রজরাও আমাদের ওপর নজর রাখছেন কাদের কীভাবে দলে টানা যায়। মফস্বল থেকে আসা ছাত্র হিসেবে ভেসে বেড়ানোর সময় তখন। কোন দিকে ঝাঁপ দেব বুঝতে পারছি না। বন্ধুবর মাহ্‌ফুজউল্লাহ আয়োজন করে হোস্টেলে গোপন সভার, হায়দার আকবর খান রনো এসে বোঝান সশস্ত্র বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা, তাঁর কাছেই প্রথম শুনি রনদীভে থিসিসের কথা, মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। তারপর এক সন্ধ্যায় বসি গোপন বৈঠকে, আলোচনা যিনি করবেন তিনি সদ্য শেষ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট, মাথায় হুলিয়া নিয়ে কাজ করছেন গোপনে। তিনি এলেন, কথা বললেন, চলে গেলেন। আমাদের মুগ্ধতার সীমা-পরিসীমা রইল না। দীর্ঘদেহী ছিপছিপে কন্দর্পকান্তি তরুণ, যেমন দেখতে তেমনি তাঁর ভরাট গলা, ব্যারিটোন বুঝি একেই বলে– যেন অন্ধকার থেকে উঠে এসেছিলেন এক যুবরাজ, আমাদের আলোর বার্তা শুনিয়ে আবার মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে। যৌবনের সূচনায় সেই যে দেখা পেয়েছিলাম যৌবরাজ্যের অধীশ্বর পঙ্কজ ভট্টাচার্যের, সেই স্মৃতি তো কখনও ভুলবার নয়।

যৌবনের আইডল তো তাঁদের জীবনভর আইডল হয়ে থাকেন না; জীবনের চলার পথে কেউ ছিটকে পড়েন, কেউবা পথভ্রষ্ট হন, কেউ হারিয়ে ফেলেন উদ্যম। আমার সেই যুবরাজকে তারপর থেকে অদ্যাবধি দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের, তাঁর সান্নিধ্যে তরুণদেরই দেখি বেশিরভাগ সময়, আর দেখি তাঁর উদ্যম, বাধা-বিঘ্ন, বয়স কিছুই তাঁর কর্মস্পৃহা দমিয়ে রাখতে পারে না। মাত্র এক মাস আগে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম করোনাকানীন দুঃসময়ে প্রয়াত জীবনসঙ্গী রাখী দাশ পুরকায়স্থ স্মারকগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। শরীর তাঁর রোগজর্জর, কিন্তু মন একইভাবে কর্তব্যনিষ্ঠ, কষ্টকর হলেও বসেছিলেন গোটা সময়, সবার জন্য অশেষ ভালোবাসা নীরবে স্পর্শ করছিল সকলের অন্তরে। আমার বাসনা ছিল তাঁকে বলি আমার যৌবনের স্মৃতি, অজান্তেই তিনি আমাকে যে দানে সমৃদ্ধ করেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে হুইল চেয়ারে বসা পঙ্কজদার কাছে গিয়েছিলাম, কিছুই বলতে পারিনি, কেবল তাঁর হাত দুটো আমার হাতে নিয়ে কপালে ছুঁইয়েছিলাম। তাঁকে দেখে মনে হয়েছিল, আমি এক সন্ত পুরুষের সামনে দাঁডিয়ে আছি, চেহারায় কন্দর্পকান্তি, মাথার চুল ধবধবে সাদা, কর্মের ক্ষেত্র হয়তো পাল্টেছে, তবে মানবমুক্তির সাধনায় একইভাবে অবিচল ও উদ্যমী।

যুবরাজ যে হয়েছেন সন্ত পুরুষ, সে জন্য কঠিন তপস্যা করতে হয়েছে তাঁকে। প্রথমে তাঁকে হতে হয়েছে গৃহত্যাগী, তবে কোনোভাবেই দেশত্যাগী নন। ষাটের দশকে সেই যে তিনি ঘর ছেড়ে এসেছিলেন বাইরে, দীক্ষা নিয়েছিলেন দেশমুক্তি ও সমাজমুক্তির ব্রতে, আজীবন তা পালন করেছেন পরম নিষ্ঠা সহকারে। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন পরিবারের সদস্যরা, কিন্তু তিনি তাঁদের অনুগামী হননি কখনও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষে কোনো পেশায় যুক্ত হননি, যদিও তেমন সুযোগ তাঁর ছিল পুরোপুরি। পাকিস্তান আমলেই তাঁকে করতে হয়েছে কারাবরণ।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা জীবনস্মৃতি ‘আমার সেই সব দিন’। এ বইয়ে তিনি লিখেছেন: ‘চট্টগ্রাম কারাগার থেকে আমাকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়ার দিন যথারীতি পুলিশ পরিবেষ্টিত হয়ে চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। ঢাকাগামী গ্রিনঅ্যারো ট্রেনটি তখন সেখানে অপেক্ষারত। দ্বিতীয় শ্রেণির কম্পার্টমেন্টে ওঠার আগে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছি। হঠাৎ বিপরীত দিকের চাঁদপুরগামী ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে এক অভাবিত দৃশ্যে চোখ আটকে গেল। দেখলাম বাবা-মা-বোনেরা চাঁদপুরগামী ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওই ট্রেনে ওঠার অপেক্ষায়। অনুমান করতে পারি, তাঁরা চাঁদপুর থেকে লঞ্চে যাবেন প্রথমে গোয়ালন্দে। সেখান থেকে ট্রেনে দর্শনা হয়ে ভারতের গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পরে ট্রেনযোগে যাবেন আসানসোলের কাল্লায়, বড় ভাই পরিতোষ ভট্টাচার্যের বাড়িতে। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে পুলিশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় এই মর্মস্পর্শী দৃশ্য আমি দেখলাম। অদূরে আমার পাশে দাঁড়ানো নজরুলসংগীত শিল্পী সোহরাব হোসেন। তাঁর জিজ্ঞাসার জবাবে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল একটি বাক্য, ‘বাবা-মা-বোনেরা দেশ ছেড়ে দেশান্তরে যাচ্ছেন, আমি যাচ্ছি জেল থেকে জেলান্তরে।’

জীবনে চারবার জেল খেটেছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৬৭ সালে আনা হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা’র অভিযোগ। বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য পেয়েছিলেন তিনি জেলখানায়। তাঁর জেলজীবনের অভিজ্ঞতার কথাও তিনি লিখেছেন তাঁর বইয়ে: “অবশেষে জামিন পেয়ে ছাড়া পেলাম জেল থেকে। মুজিব ভাই মহাখুশি। বললেন, ‘গোছগাছ করে নে, তোকে আমি গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেব।’ তিনি গেটের কাছে এসে হাঁক দিলেন, ‘জেলার সাহেব কোথায়? তাকে বল আমার ভাই ছোট গেট দিয়ে মাথা নিচু করে জেল থেকে বের হবে না। মুজিব মাথা নিচু করে জেলে ঢোকে না, জেল থেকে বেরও হয় না।’ অবাক কাণ্ড! তড়িঘড়ি ছুটে আসলেন ডেপুটি জেলার নির্মল সিনহা (অভিনেত্রী চিত্রা সিনহার বড় ভাই)। বললেন, ‘জমাদার, মেইন গেট খুলে দাও।’ জমাদার-সুবেদার-মেট পাহারা মিলে বিশাল গেট খুলে দিলে শুরু হয়ে গেল হইহই রইরই কাণ্ড। আমার জন্য যে আরও আশ্চর্যের ঘটনা অপেক্ষা করছিল তা বুঝতে পারিনি। খোলা গেটের সামনে মুখে পাইপ নিয়ে আমার গলায় বেলি ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন মুজিব ভাই।”

তিনি আজীবন মানুষের জন্যই রাজনীতি করে গেছেন। সাম্যবাদী চেতনাবহ রাজনীতির বৃত্তেই তিনি কাজ করেছেন জীবনভর। স্বদেশি আন্দোলনের পীঠস্থান চট্টগ্রাম বোধহয় তাঁকে ত্যাগের এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের অভিযাত্রা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হলে তাঁর লড়াইও পায় নতুন বিস্তার, তিনি হয়ে ওঠেন পার্বত্য জাতিসত্তা ও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর নির্ভর ও তাঁদের কণ্ঠস্বর। নিগৃহীত, নির্যাতিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য তিনি ছিলেন ভরসার প্রতীক।

যে বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে জীবনদান করেছেন অগণিত শহীদ, সেই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সাম্যের স্বদেশ নির্মাণের কাণ্ডারি ছিলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রাজনীতির পরিসরে এক সন্ত পুরুষ। যে মানুষদের সাধনায় নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ, মুক্তির এই সংগ্রাম অব্যাহতভাবে যাঁরা পরিচালনা করেছেন জীবনভর, তাঁরা আগামীর বাংলাদেশের পাথেয় ও প্রেরণা। পঙ্কজ ভট্টাচার্য সেই আকাশের এক উজ্জ্বল তারা। মফিদুল হক : ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে

সাথী / পরিচয়

শেয়ার করুন