নিউইয়র্ক     বুধবার, ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ওয়াকিল রহমান

দেশপ্রেমের ছবকটা জাফর ভাইয়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ০২:০৫ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ০২:০৫ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
দেশপ্রেমের ছবকটা জাফর ভাইয়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম

আমি আর জাফর ভাই (ডা : জাফরুল্লাহ চৌধুরী) একদিন বগুড়া যাচ্ছি ডাক্তারদের সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য। আমাদের বহনকারী জিপটি ফেরিতে উঠল। আমি, জাফর ভাই, উনার নারী ড্রাইভার তিনজন এক কোণায় দাঁড়িয়ে মুড়ি মাখানো খাচ্ছিলাম। হঠাৎ জাফর ভাইয়ের চোখ গেল এক ভিক্ষুক কিংবা ওই টাইপের এক লোকের পায়ের দিকে। হাঁটুর নিচে পায়ের মধ্যে দগদগে ঘা। উনার গাড়িতে সবসময় চিকিৎসার জন্য ইমারজেন্সি জিনিসপত্র, ওষুধ পথ্য থাকত। আমাকে বললেন, ওটা নিয়ে আসতে। তারপর জাফর ভাই নিজ হাতে সেই দগদগে ঘা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন। উনার ডাক্তার পরিচয় পেয়ে ফেরির অনেক যাত্রীই উনার পরামর্শ নিতে আসতে লাগলেন। প্রায় তিন ঘণ্টার ফেরিযাত্রাতে উনি প্রায় ৪০/৫০ জন রোগী দেখলেন। পারিশ্রমিক হিসাবে এক রোগী কিছুটা জোর করেই আমাদের তিনজনকে ডাব খাওয়ালেন। ব্যাস এটাই। জাফর ভাইয়ের সঙ্গে ওটাই ছিল আমার প্রথম লং জার্নি, ঢাকার বাইরে।

১৯৯৪ এর জুন, এমবিএ পরীক্ষা শেষ। হঠাৎ পেপারে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস একজন এমবিএ নিবে। ইন্টারভিউ দিলাম। জাফর ভাই স্বয়ং ছিলেন বোর্ডে। চাকরিটা হয়ে গেল, জয়েন করলাম গণস্বাস্থ্যে।
১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ এই চার বছর খুব কাছ থেকে দেখেছি জাফর ভাইকে। আমরা যারা ওখানে চাকরি করতাম, সবাই উনাকে জাফর ভাই কিংবা বড় ভাই বলতাম। স্যার ডাক পছন্দ করতেন না। যখন ঢাকার বাইরে যেতেন কেন জানি সঙ্গী হিসাবে আমাকে পছন্দ করতেন। আমার সুপারভিশন এরিয়া ছিল উত্তরবঙ্গ। জাফর ভাইয়ের সাথে পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী সহ উত্তরবঙ্গ’র প্রায় সব জেলা চষে বেড়িয়েছি। বেশির ভাগ সময় ঘুমাতাম জেলা অফিসগুলোর ম্যানেজারের রুমে, ফ্লোরে, অথবা যদি গেস্টরুম থাকত সেখানে। যদি একটা খাট থাকত উনি ফ্লোরে আর আমি খাটে ঘুমাতাম, জোর করলেও শুনতেন না। খাওয়ার ব্যাপারে ছিল প্রচন্ড উদাসীন। আমার ওগুলো পছন্দ হতো না, কিন্তু ভয়ে বলতাম না। একনাগারে তিন চারদিন না ঘুমিয়ে কাজ করতে পারতেন। তাল মিলাতে পারতাম না, অসুস্থ হয়ে যেতাম। উনি দিব্যি কাজ করতেন, সাংঘাতিক পরিশ্রমী। এমনিতে রাশভারি স্বভাবের হলেও বাইরে কোথাও গেলে প্রচুর কথা বলতেন।

সামান্য তোতলা ছিলেন, উনি কথা বলার সময় মাথার চুলগুলো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে কথা বলতেন। একদিন বগুড়া অফিসে আমি আর সেখানকার ইনচার্জ জব্বার ভাই বসে আছি। হঠাৎ আমি জাফর ভাইকে নকল করে অভিনয় করতে লাগলাম। তোতলারা যেভাবে কথা বলে সেভাবে। কখন যে জাফর ভাই পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, টের পাইনি। জব্বার ভাই ইশারা দিলেও বুঝতে পারিনি। তোতলাচ্ছি আর জাফর ভাইয়ের মতো বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছি। হঠাৎ পিছনে হাতের স্পর্শ পেয়ে মনে করলাম আরেক স্টাফ হয়তো। আমি পিছন না ফিরেই বললাম হাহাহাত সসসসরা। পিছনে তাকিয়ে দেখি জাফর ভাই। ভয় পেয়ে গেলাম, চাকরিটা বোধহয় গেল। উনি হেসে বললেন, অঅঅঅভিনয়টাও ঠিকমত কককরতে পারিস না।কত স্মৃতি, কত ঘটনা।

সম্ভবত ১৯৯৬ সাল। “গণস্বাস্থ্যের ২৫ বছর, স্বাধীনতার ২৫ বছর” নামে এক অনুষ্ঠান হবে সাভারে। কমিটিতে আমাকে রাখলেন। আমার দায়িত্ব হলো বিদেশ থেকে যে সমস্ত অতিথি আসবেন তাদের দেখভাল করা। তখনও বিয়েটা করিনি, থাকি সাভার পিএটিসিতে সাবলেট। দিনরাত কাজ করেছি। বিদেশ থেকে কত নোবেল বিজয়ী, বিখ্যাত সব চিকিৎসা বিজ্ঞানী, সমাজসেবী যাদের নাম পড়েছি পত্র পত্রিকায়, আমার দায়িত্ব ছিল এয়ারপোর্ট থেকে তাদের রিসিভ করে গণস্বাস্থ্যের সাভার ডরমিটরিতে নিয়ে যাওয়া। সেই তরুণ বয়সে এত এত নোবেল বিজয়ীদের চোখের সামনে দেখতে পাওয়া, তাদের সাথে কথা বলা, একসাথে থাকা খাওয়া বিষয়টি বেশ এক্সাইটেড। যেখানে ডাক্তার, নার্স, অফিস স্টাফরা থাকত সেখানেই সাফ সুতরো করে সেই বিখ্যাতদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই পরিবেশে আমিই থাকতে পারতাম না, যত রাতই হোক বাসায় চলে আসতাম। অথচ সেই বিখ্যাত মানুষগুলো অবলীলায় সেখানে ঘুমাতো। উল্লেখ্য, তারা সবাই নিজ নিজ খরচেই বাংলাদেশে এসেছিলেন, থেকেছেন শুধু জাফর ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে। তখন দেখেছি এইসব বিখ্যাত মানুষরা জাফর ভাইকে কতটুকু সমাদর করে, ভালবাসে।

এরকম হাজারো স্মৃতি। বলতে গেলে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। উনার মত পরিশ্রমী দেশপ্রেমিক, দরদী এবং সত্যিকার অর্থে একজন জ্ঞ্যানী ব্যক্তি বাংলাদেশে রেয়ার। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম একজন মানুষ কিভাবে দিনরাত ২৪ ঘন্টা শুধু দেশ দেশ করে। যে চার বছর উনার সাথে কাজ করেছি, উনাকে দুইটা শার্ট আর একটা জিন্স প্যান্ট পরা অবস্থায় দেখেছি। উনার চুল কেটে দিতেন ভাবী। চুল কাটা মানে কেচি দিয়ে চুল ছোট করা। গাড়িতে চলার সময় ভুপেন হাজারিকার গান খুব পছন্দ করতেন, আর পুরানো দিনের হিন্দি গান। বিশেষ করে মুঘল ই আজম ছবির পেয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া গানটা। পছন্দের খাবার ছিল ডিমভাজি দিয়ে মুড়ি, আর চা দিয়ে চুবিয়ে গরম গরম পুরি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বিলাতের স্মৃতি, ওষুধ নীতি, স্বাস্থ্য নীতি এরশাদ, জিয়া, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার মধুর অভিজ্ঞতা আমাকে বলতেন। একমাত্র গণস্বাস্থ্যর সব প্রতিষ্ঠানে হিসাব কিতাব বেতন সবকিছু বাংলায় হতো। বাংলার প্রতি, বাংলাদেশের প্রতি তার ছিল মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসা।
গণস্বাস্থ্য ছাড়ার পরও উনার সাথে যোগাযোগটা অব্যাহত ছিল। ধানমন্ডি গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের সামনে দিয়ে গেলে উনার সাথে দেখা করতাম। শেষ দেখা হয়েছে গতবছর। উনার রুমে যেয়ে দেখি এক হুজুরের কাছে মনযোগ দিয়ে কোরআন শরীফ পড়ছেন। আমাকে ডেকে কাছে বসালেন, কিছুক্ষণ কথা হলো। জানালেন কিডনি দুটোই নষ্ট, সপ্তাহে তিনবার ডায়ালেসিস করতে হয়। গত কয়েকদিন ধরেই উনার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল। পত্রিকায় আসার আগে থেকেই আমি জানি উনি লাইফ সাপোর্টে। গতরাতে এক সাবেক কলিগের মারফত উনার মৃত্যু সংবাদ পেলাম। উনি তখন হাসপাতালে, জাফর ভাইয়ের পাশেই। একটা অধ্যায় শেষ হলো। তরুণ বয়সে জাফর ভাই আমাকে প্রভাবিত করেছিল। দেশপ্রেমের ছবকটা উনার কাছ থেকেই প্রথম পেয়েছিলাম। (ফেসবুক থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন