নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোফাজ্জল করিম

দিগন্ত-বিস্তৃত স্বপ্ন, অর্জনও কম নয় কিন্তু…

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ | ১১:১৩ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩ | ১১:২১ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
দিগন্ত-বিস্তৃত স্বপ্ন, অর্জনও কম নয় কিন্তু…

ক্ষমতাসীন জোটের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। এই প্রত্যয়টির বাংলা করলে সাদামাটা অর্থ দাঁড়ায় ‘চৌকস বাংলাদেশ’। সব দিক থেকে চৌকস, সব বিষয়ে পারদর্শী বাংলাদেশ। বড় কথা হচ্ছে, ‘স্মার্ট’ শব্দটি আমাদের গ্রামাঞ্চলে কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও তেমন প্রচলিত নয়। অন্য কোনোভাবে অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষায় বা অন্য শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে নামকরণ হয়তো করা যেত। ‘স্মার্ট’ বলতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে তা অধিকাংশ মানুষের কাছে দ্ব্যর্থক, একাধিক অর্থবিশিষ্ট এবং দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। দিনশেষে তো সাধারণ মানুষই তা বাস্তবায়ন করবে।

কয়েক বছর আগে যখন এই আওয়ামী লীগ সরকারই ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলল তখন ডিজিটাল শব্দটিও সাধারণ মানুষের কাছে নতুন ছিল। কিন্তু ডিজিটাল শব্দটি যেভাবে প্রচলিত ও ব্যবহৃত হয়েছে ‘স্মার্ট’ সেভাবে প্রচলিত নয়। ডিজিটাল শব্দটি যে নতুন ধারণা দিয়েছিল এবং তা সর্বস্তরের মানুষ, অর্থাৎ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র সবার কাছে পৌঁছানো হয়েছে। ওই সময়ে মানুষ শব্দটিকে নতুন ধারণা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সেজন্য এ শব্দটি নিয়ে কোনো ধরনের দুর্বোধ্যতা বা দ্ব্যর্থকতার সুযোগ ছিল কম। সবাই শব্দটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেছে এবং খুব দ্রুত এটি সবার মধ্যে প্রচলিত হয়ে যায়। এর পেছনে অবশ্য একটি বড় কারণ ডিজিটাল শব্দটির সঙ্গে মোবাইলফোন ও এ রকম আরও কিছু বিষয় জড়িত ছিল। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টি যেহেতু জড়িত ছিল তাই এমন হয়েছে। হয়তো স্মার্ট শব্দটিও একসময় পরিচিত হয়ে যাবে। দেখার বিষয় সরকার বা ক্ষমতাসীন দল এটিকে নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যায়। তবে আমি মনে করি শব্দবন্ধে আবদ্ধ না থেকে যেটা লক্ষ্য সেটাই বলা উচিত।

লক্ষ্যটা কী? লক্ষ্য হচ্ছে একটি উন্নত বাংলাদেশ। পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ। সকলের সম-অধিকারের ক্ষেত্রে সমুন্নত একটি বাংলাদেশ। এমন উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করেই এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশ্ব ইতিহাসের একটি অনন্য অধ্যায় রচনায় জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং চূড়ান্তভাবে সফল হয়। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হবে—এমন প্রত্যয় বাস্তবায়নের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন জাতীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐক্য। স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিশ্চিতকরণ। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অন্যতম বিষয় সবার অধিকারের সমতল ভূমি নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা তেমনটি করতে পারিনি। পারিনি তার কারণ হচ্ছে, সবসময়ই একটা লক্ষ থাকে যে আইন-কানুন কিংবা আর যাই করা হোক না কেন, আমার জন্য অন্যরকম ব্যাপার থাকবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সব রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলেই কমবেশি এমনটি পরিলক্ষিত হয়েছে। যদি বলা হয়ে থাকে সবার জন্য অধিকারের সমতল ভূমি চাই, তারপরও সুপ্ত ইচ্ছে থাকে আমি যেন আমারটার ক্ষেত্রে সামান্য একটু বেশি হলেও পাই। তাতে সবার সমতল অধিকার নিশ্চিত হয় না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

নির্বাচনী ব্যবস্থায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখন খুব উচ্চারিত হয়ে থাকে। কিন্তু দেখা যায়, সেটা হচ্ছে না বা হয় না। যারা অর্থবিত্ত এবং রাজনৈতিক অবস্থানে অগ্রগামী, তারা অনগ্রসর শ্রেণিকে সহজেই দূরে ঠেলে রাখতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অবস্থান, রাজনৈতিক সহায়তা, রাষ্ট্রীয় সহায়তা অমোঘ হয়ে ওঠে; আইন নিয়ামক হয় না। এজন্য মনে করি, চেষ্টা করতে হবে সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা। বিকশিত গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে এর বিকল্প নেই।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও বৈষম্যের নিরসন। গণতন্ত্রকে গত একান্ন বছরে আমরা বেশিদূর সামনে নিতে পারিনি। সবক্ষেত্রে আমরা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রতিষ্ঠাও করতে পারিনি। নিঃসন্দেহে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। উন্নয়ন আমাদের ঊর্ধ্বমুখী, অর্থাৎ আমরা সামনের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু গণতন্ত্র, সাম্য, সম-অধিকার—এসব বিষয়ে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই নয় বরং পিছিয়ে পড়ছি। গণতন্ত্র যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পায় তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের যে সাফল্য রয়েছে তা আমরা ধরে রাখতে পারব না। সরকার কিংবা বিরোধী দলের নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়গুলো যে অজানা তা নয়, কিন্তু এমন বিষয়ে সবারই কমবেশি সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।

সার্বিকভাবে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে তা অসত্য নয়। গণমানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে, এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা যে অবস্থায় ছিলাম তার থেকে আমরা এখন অনেক সামনের দিকে। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎটাকে কিছুতেই আশাপ্রদ মনে হচ্ছে না। আমাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ অনুজ্জ্বলই বলতে হয়। জরুরি কথা হচ্ছে, গণতন্ত্রকে যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হয় তাহলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় যে অবিচল আস্থা সেগুলো না থাকলে শ্রেণিতে শ্রেণিতে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, বিভিন্ন দলের মধ্যে কোন্দল-কোলাহল বাড়বে এবং ক্রমাগত তা আরও বাড়তেই থাকবে। তাতে যা হবে, হয়তো অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা এগিয়ে যাব অথবা সামাজিক সূচকগুলোর দিক থেকে ভালো অবস্থায় চলে যাব কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা শতধাবিভক্ত হয়ে থাকব। দেশ-জাতির জন্য এমনটি কিছুতেই কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনা।

বিভাজিত রাষ্ট্র কখনও আপদের সময় এই যেমন যুদ্ধবিগ্রহের সময় অথবা অন্য যেকোনো প্রতিকূল সময়ে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে পারবে না। অনৈক্যের কারণে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে তাতে জাতির অস্তিত্ব বিবর্ণ হয়ে পড়তে পারে এবং সুযোগসন্ধানীদের প্রভাব বেড়ে যাবে একইসঙ্গে তারা জাতীয় অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবে। সেজন্য মনে করি, সবকিছুর মধ্যে যে ঐক্য মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রধান শক্তি ছিল সেটা দরকার। মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল বলেই আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিভক্ত রাজনৈতিক অবস্থার দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তাঁর দূরদর্শিতা অস্বীকারের জো নেই।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা-জবাবদিহি এবং পরমতসহিষ্ণু না হয়ে আমাদের রাজনীতিকরা যে স্বপ্ন দেখছেন তাতে কি দিগন্ত বিস্তৃত স্বপ্ন পূর্ণতা পাবে? অদম্য বাংলাদেশের যাত্রাপথে আমি যা বলব তা-ই শেষ কথা এবং সবকিছুতে এই তালগাছ আমার নীতি অনুসরণ করার চিন্তা রাজনীতিকদের পরিত্যাগ করতে হবে। এই নীতিতে অটল হয়ে থাকলে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি হলেও তা স্থায়ী হবে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার যেন ভুলে না যাই। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও চেতনাই আলোর পথ ধরে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

সব থেকে বেশি ঘৃণা করি সাম্প্রদায়িকতাকে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কিছু বিচার করাকে। দেশ ও জাতির কল্যাণে যারা নিজেদের নিয়োজিত করেছেন বা করছেন, তাদের সঙ্গে আছি। সবসময় চেয়েছি এবং এখনও মনেপ্রাণে চাই, বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িকতা স্থায়ী রূপ পাক। আমাদের এত অর্জন বিফলে যাবে যদি আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বিচারহীনতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হই। দেশের উন্নয়নকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন একাত্তরের সেই ইস্পাতকঠিন ঐক্য। গত ৭৫ বছরে আমরা এই উপমহাদেশকে দুবার স্বাধীন হতে দেখেছি। আমরা বলতে আমি আমার মতো সিনিয়র সিটিজেনদের কথা বলছি, যাদের বয়স ১৯৪৭ সালের প্রথম স্বাধীনতার সময় ১০ বা তার কাছাকাছি ছিল। আমাদের স্বপ্ন দিগন্ত বিস্তৃত। অর্জনও কম নয়। কিন্তু এও সত্য, অনার্জিতও রয়ে গেছে অনেক কিছু। এর সঙ্গে যেন অর্জনের বিসর্জন আর না হয়। আমরা এখন তাকিয়ে আছি কাঙ্ক্ষিত সেই উন্নত বাংলাদেশের দিকে। মোফাজ্জল করিম সচিব ও কবি। প্রতিদিনের বাংলাদেশ এর সৌজন্যে।

সুমি/পরিচয়

শেয়ার করুন