নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমীন আল রশীদ

চাপে পড়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে হবে কেন

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৩ | ০৬:১৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৩ | ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
চাপে পড়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে হবে কেন

‘সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য পশ্চিমাদের চাপ এবং দেশের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে পারে সরকার। এজন্য আগামী এপ্রিলের কোনো এক সময় বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে আনার উদ্যোগ নেবে আওয়ামী লীগ।’ (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)

প্রশ্ন হলো, চাপে পড়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে হবে কেন? নির্বাচন মানেই তো সেটি অংশগ্রহণমূলক হতে হয়। যেটি অংশগ্রহণমূলক নয়; যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই বা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জিতে যান, সেটিকে আদৌ নির্বাচন বলা হবে কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। কারণ নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের দেশের জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে—যা প্রকারান্তরে গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে আছে গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের মূল কথাই হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল। যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একই দল বার বার ক্ষমতায় আসে, সেটিও অগণতান্ত্রিক নয়। কিন্তু ভোট যদি অংশগ্রহণমূলক না হয়, অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো যদি ভোটে অংশ না নেয় এবং সেই ভোট যদি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণও হয়, তারপরও সেটিকে ভালো নির্বাচন বলার সুযোগ নেই।

অনেক সময় বলা হয়, বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের তরফে এরকম কথা বহুবার বলা হয়েছে যে, কেউ যদি (বিশেষত বিএনপি) নির্বাচনে আসতে না চায়, সেটি তাদের ব্যাপার। তাদেরকে জোর করা হবে না। কিন্তু কোনো একটি বড় দল কেন নির্বাচন বর্জন করে বা ভোটে অংশ নিতে চায় না—সেটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বড় প্রশ্ন। অর্থাৎ নির্বাচনটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে সব দল যদি আশ্বস্ত না হয়, তখনই ভোট বর্জনের প্রশ্ন ওঠে। তখনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্ধেকের বেশি সংসদীয় আসনে প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে (দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন)—যা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তা ছাড়া এই ধরনের নির্বাচন বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়, দেশের ভেতরে এবং বাইরে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। তারা যতই জনবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে দেশ পরিচালনা করুক কিংবা তাদের আমলে যতই উন্নয়ন হোক না কেন, যেহেতু দেশের সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্রকে গ্রহণ করা হয়েছে, অতএব সেই গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো নির্বাচন হলে সেটি ক্ষমতাসীন দলের জন্য কোনো সম্মান বয়ে আনে না।

মনে রাখা দরকার, নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন মূলত ‘সিলেকশন’। প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো পদে একাধিক প্রার্থী না থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ঘোষণা যেহেতু অসাংবিধানিক বা বেআইনি নয়, সুতরাং কেন একে নির্বাচন বলা যাবে না? এই যুক্তিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত কাউকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই এটা যেমন সত্য, তেমনি কেন একটি পদের বিপরীতে একাধিক প্রার্থী থাকেন না—সেই প্রশ্ন তোলাও সঙ্গত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কেন এই প্রবণতা বেড়েছে—তারও নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা-সংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১৯ ধারা কেন সংবিধানপরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট একটি রুল দিয়েছিলেন। (প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটই প্রধান উপায়। আর ভোট বলতে বোঝায় গোপন ব্যালটে স্বাধীন ও নির্ভয়ে নাগরিকের অধিকার প্রয়োগ। অর্থাৎ একাধিক প্রার্থীর মধ্য থেকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনি ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে নির্বাচন। এটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং যখন কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তখন সেখানে নাগরিকের এই সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ণ হয়। সেটি স্থানীয় সরকার হোক কিংবা জাতীয় সংসদ। বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুরো নির্বাচন পদ্ধতিটিই এমন হয়ে গেছে যে, এখন ভোটের আগেই জানা যাচ্ছে যে, কে জয়ী হবেন? যদি এটি আগেভাগেই নিশ্চিত হয় যে কে জয়ী হচ্ছেন, তাহলে তার সঙ্গে কেউ লড়াই করতে আসবেন না—এটিই স্বাভাবিক।

এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে পশ্চিমাদের কী সুবিধা? বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতায় থাকল, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা কেন? গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বার্থে? পৃথিবীর অসংখ্য দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নের মুখে। সব দেশকে কি তারা চাপ দেয়? এখানে কি তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং তাদের ওপর বাংলাদেশের ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর কোনো প্রভাব আছে?

তবে বিদেশি চাপ থাকুক বা না থাকুক, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনই অংশগ্রহণমূলক হওয়া প্রয়োজন। কারণ অনেক সময় পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ হওয়ার পরও সেই ভোট গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। যেমন: একটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের ফল ঘোষণা পর্যন্ত কোনো হানাহানি হলো না, কোনো প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেওয়া হলো না, কাউকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ দেওয়া হলো না; কিন্তু দেখা গেল মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি বা ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। যেহেতু আমাদের সংবিধানে এটি বলা নেই যে, ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে। বরং ২০ শতাংশ ভোট পেয়েও যেহেতু জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া যায়, সুতরাং কোনো একটি ভোটে যদি ২০ শতাংশ মানুষও ভোট দেয়, তারপরও ওই ভোটকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। ওই সামান্য সংখ্যক ভোট পেয়ে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন, তাকেও অবৈধ বলা যাবে না। কিন্তু এই নির্বাচনটি কি গ্রহণযোগ্য হলো?

আবার পুরো নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ হলো, প্রচুর মানুষ ভোট দিলো, কিন্তু ফল পাল্টে দেওয়া হলো, সেটিকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা গেলেও গ্রহণযোগ্য বলার সুযোগ নেই। অর্থাৎ সহিংসতামুক্ত নির্বাচন মানেই সেটি গ্রহণযোগ্য ভোট নয়। কিন্তু ভোট যখন অংশগ্রহণমূলক হয়, অর্থাৎ যখন প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ভোটে অংশ নেয়, তখন তারা প্রত্যেকে প্রত্যেককে পাহারা দেয়। কেউ যদি ভোটে কারচুপি করতে চায়, তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সেটি রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু ভোট যদি অংশগ্রহণমূলক না হয়, যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে বা বড় দলের বিপরীতে অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলো ভোটের মাঠে থাকে, তখন বড় ও শক্তিশালী দল কোনো কারচুপি করলেও ছোট দলগুলো তার বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে না। ফলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে হলো সবগুলো বড় দলের অংশগ্রহণ।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে প্রধান কয়েকটি দল যেমন: আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো দলগুলোর অংশগ্রহণ। কিন্তু আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, বিশেষে করে বিএনপি আসবে কি না, সেখানে এখন পর্যন্ত মোটা দাগে ২টি চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ১. নির্বাচনকালীন সরকার, অর্থাৎ ভোট কোন ধরনের সরকারের অধীনে হবে এবং সরকার প্রধান হিসেবে কে থাকবেন; ২. ইভিএম। এই বিষয়গুলোর সুরাহা এখনো হয়নি।

ডেইলি স্টারের খবর বলছে, আওয়ামী লীগ রাজপথে আধিপত্য বিস্তারে বিএনপির আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচি দিলেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের সঙ্গে পর্দার আড়ালে আলোচনা করার কথা বিবেচনা করছে। অর্থাৎ বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কথা ভাবছে ক্ষমতাসীন দল। প্রশ্ন হলো, সংলাপ করে দেশের বড় রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়েছে কি? এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন নির্বাচনকালীন সরকার, যেটি বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে প্রায় অসম্ভব, সে বিষয়ে সংলাপ করে সমাধান হবে? এর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আওয়ামী লীগ কি তাতে রাজি হবে? আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপে বসে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে একটি সমঝোতায় পৌঁছাবে, সেটি বিশ্বাস করার মতো কোনো পরিস্থিতি কি এখনো তৈরি হয়েছে?

নির্বাচনকালীন সরকারের সঙ্গে এবার খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিও জানাচ্ছে বিএনপি। সম্প্রতি তার রাজনীতি করা না করা নিয়ে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। যদিও রাজনীতি করা বলতে কী বোঝায় এবং ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, সর্বোচ্চ আদালত তার রায় বাতিল করবেন কি না, করলেও তিনি শারীরিকভাবে কতটা সুস্থ আছেন এবং থাকবেন—এসব প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

ফলে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো এবং সরকারের সঙ্গে যুক্ত ও সরকারবিরোধী অন্য সব দলের অংশগ্রহণে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনটি কেমন হবে, সে বিষয়ে এখনই ধারণা করা বা উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন। কারণ সামনের মাসগুলোয় রাজনীতির জল হয়তো আরও ঘোলা হবে। সেই ঘোলা পানিতে কেউ মাছ শিকার করে কি না—সেদিকেই বরং দেশবাসীর সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন, দ্য ডেইলি স্টারের সৌজন্যে

শেয়ার করুন