নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আন্না উয়েনার

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বন্ধু নয়, প্রযুক্তির সঙ্গে কথা বলবে মানুষ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৩ | ১০:৫০ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৩ | ১০:৫০ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বন্ধু নয়, প্রযুক্তির সঙ্গে কথা বলবে মানুষ

এবারের বসন্তের শুরুতে আমি বাসে করে সানফ্রান্সিসকো শহরের একদম কেন্দ্রে মসকোন সেন্টারে গিয়েছিলাম। বার্ষিক গেম ডেভেলপার সম্মেলনের জন্য সেখানে প্রায় ৩০ হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। সাংবাদিক হিসেবে আমিও তাতে যোগ দিই।

গেম ডেভেলপার সম্মেলনটি যে তলায়, সেখানে স্কেট বোর্ডাররা সেন্সর দিয়ে জড়ানো কালো বডিস্যুট পরে মজার কসরৎ দেখাচ্ছিল। সেখানে দেওয়া হয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মনিটর। কিন্তু তখনও সংবাদকর্মী ও প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রাখতে পারেনি। চ্যাটজিপিটির নতুন সংস্করণ ওপেনএআই মাত্রই বেরিয়েছে। বলা চলে, এ প্রযুক্তি সবাইকে নিরাবেগ করে তুলছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সামাজিক সম্পর্কে প্রভাব সৃষ্টি করবে কিনা কিংবা পেশা, এমনকি পুরো শিল্পে পরিবর্তন আনবে কিনা– সেই জল্পনা এখনও রয়েছে।

গেম শিল্প বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে তৈরি। এর অন্যতম হলো এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই সম্মেলনে তাই গেম তৈরিতে বিস্তৃত ভাষার মডেল (এলএলএম) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর অন্তত দুটি আলোচনা ছিল। তারা বিশেষভাবে খেলোয়াড়হীন চরিত্র বা এনপিসি নির্মাণের ওপর নজর দেয়। এর অর্থ হলো, একটি গেমকে জনপ্রিয় ও বহুমাত্রিক করার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া।

এআই তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কথাবার্তা আগামী বছরগুলোতে সাধারণ বিষয় হয়ে উঠবে। কারণ এ মডেল ‘সার্চ ইঞ্জিন’ ও ‘ই-কমার্স’ ওয়েবসাইটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এবং তার সঙ্গে থাকবে ওয়ার্ড প্রসেসর ও স্প্রেডশিট সফটওয়্যার। তাত্ত্বিকভাবে অ্যাপলের সিরি বা অ্যামাজনের অ্যালেক্সার মতো জায়গায় কণ্ঠ ব্যবহারের যে সুবিধা রয়েছে, তার সক্ষমতা আরও বাড়বে। কল সেন্টারগুলো এআই সেবা চালু করছে। অ্যামাজন একটি চ্যাটবট তৈরি করছে, বলা হয়। ফাস্টফুড সরবরাহকারী ওয়েন্ডিস চলমান বসন্তের শুরুতে এআইর মাধ্যমে একটি বিষয় প্রচার করেছে। সিলিকন ভ্যালির পালো আলতোর বেসরকারি একটি বিদ্যালয় হলো খান ল্যাব স্কুল। বিদ্যালয়টি তার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পরীক্ষামূলক টিউটরিং বট চালু করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ইটিং ডিজঅর্ডারস অ্যাসোসিয়েশন’ তার মানবচালিত টেলিফোন হেল্পলাইনকে টেসা নামে একটি বট দিয়ে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেছিল (টেসা কলকারীদের ক্ষতিকারক পরামর্শ দেওয়ার পর পরিষেবাটি স্থগিত করা হয়)।

চ্যাটবটই এলএলএম প্রযুক্তির শেষ বিন্দু নয়। বলা বাহুল্য, এই প্রযুক্তির সবচেয়ে মজার আবিষ্কারগুলো কথা বলা বা চ্যাটিংয়ের সঙ্গে খুব বেশি যুক্ত নয়। বরং অনেক বেশি করে তা যুক্ত তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, উদ্ভাবন ও অনুকরণ, সারাংশ করার মতো কাজ ইত্যাদি। আমরা এমন একটি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যাকে চিহ্নিত করা যায় ‘অন্তহীন চ্যাট’ দিয়ে। ভবিষ্যতে অক্লান্ত কথাসঙ্গীদের সঙ্গে ছোট ছোট আলাপের সুযোগ আসবে। সেখানে বলার কিছু বিষয় হবে লিখিত এবং কিছু হবে মৌখিক। যেখানে কথ্য আদেশ, প্রশ্ন এবং অন্যান্য বিষয় থাকবে। ডাটাবেজের সঙ্গে যুক্ত যে কোনো কিছু বট হয়ে উঠতে পারে। সেটা যেমন সশরীরে হতে পারে, তেমনি ভার্চুয়ালিও।

অনলাইন চ্যাট সামনাসামনি কথোপকথন বা আলাপের চেয়ে ভিন্ন। এবং এর থাকে নিজস্ব প্রবাহ। এটা হট্টগোলের মতো হতে পারে, অংশগ্রহণকারীরা একে অন্যদের দিকে দুম করে কথা ছুড়ে দিতে পারে বা দিতে পারে ছোট্ট টেক্সট। অথবা সেটা হতে পারে বিচ্ছিন্ন; যে যার মতো কথা বলে গেল। কেউ শুনল বা কেউ শুনল না। এসব আলাপে ঝুঁকির মাত্রা সাধারণত কম। কেউ একজন সরাসরি মেসেজ দিতে পারে ডেটিং অ্যাপে, ভিডিও গেমে, অথবা ভিডিও কলে, লেখার সফটওয়্যারসহ আরও অনেক কিছুতে। চ্যাট করার জন্য সংশ্লিষ্ট নিয়মাবলি মেনে চলতে হয়। স্ল্যাকে চ্যাট করা টিন্ডারে চ্যাট করা থেকে আলাদা। তবে চ্যাটবট সে অর্থে চ্যাটিং নয়। একে বলা যায়, চ্যাট সিমুলেশন বা আলাপ থেকে শিখে আলাপ চালানো। অর্থাৎ কোন ফিচারে চ্যাট করা হচ্ছে; চ্যাটবট তার সঙ্গে মানিয়ে নেবে। স্ল্যাক অ্যাপে কথা বলা টিন্ডারে কথা বলার চেয়ে আলাদা। এসব মাধ্যমে সবসময় আরও অনেক কিছু বলার থাকবে। নীরবতা বা নিষ্ক্রিয়তাকে মনে হতে পারে অবাস্তব বা অলৌকিক।

চ্যাটজিপিটি এমনকি আবেগহীন কিংবা ইচ্ছাকৃত যান্ত্রিক হওয়া সত্ত্বেও নৃতাত্ত্বিক বিষয়কে উৎসাহিত করে। এটি ভুল করলে ক্ষমাও চায়। ব্যক্তির সঙ্গে তা আন্তরিকভাবে কথা বলে এবং চিন্তাশীল পরামর্শও দেয়। তবে চ্যাটজিপিটির ভাষার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে।

বর্তমান সময়ে চ্যাটবটের সঙ্গে যেটা হয়, এর ব্যবহারকারী ব্যক্তি কথা বলছে না; বরং তারা চ্যাটবটকে প্ররোচিত করছে। প্ররোচনা দিচ্ছে এই অর্থে, তারা নির্দিষ্ট ফল পাওয়ার জন্য পছন্দমাফিক শব্দ ব্যবহার করে। পেনএআইর নথিতে ‘প্ররোচনা প্রকৌশলের সর্বোত্তম অনুশীলন’ সংক্রান্ত একটি পৃষ্ঠা রয়েছে। সেখানে বলা আছে, নেতিবাচকতা থেকে দূরে থাকা (কী করা উচিত নয়, তা বলার পরিবর্তে কী করতে হবে সেটি বলুন)। সেখানে বিশদ বিবরণ দেওয়ার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত।

গেম ডেভেলপারদের সম্মেলনে বৈঠকের মাঝে বিরতির সময় দুপুরের খাবারের জন্য মেট্রিয়ন নামে একটি শপিং মলে গিয়েছিলাম। প্রায় এক দশক আগে আমি রেস্তোরাঁয় নিয়মিত যেতাম। সে সময় আমার বয়স ছিল ২৫ বছর। গ্রাহক সেবার একটি কোম্পানিতে আমি কাজ করতাম। এর পর আমি ই-মেইল লিখে দিন কাটিয়েছি। টনি হিসের ‘ডেলিভারিং হ্যাপিনেস’ নামের বইটি জনপ্রিয় ছিল। সেখানে ‘আশ্চর্য এবং আনন্দ’ বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়। সে সময় এটি চিন্তা করাও কঠিন ছিল যে, ভবিষ্যতে এমন কাজ পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় হতে পারে। যেখানে মানবিক বিদ্যাবিশারদদের পরিবর্তে হতাশা কাটাতে ভাষা ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হতে পারে।

ভাষা পুরো বিশ্বকে ধারণ করতে পারে। এটি তার কথকের ইতিহাস ও মূল্যবোধ প্রকাশ করে। এটি অস্পষ্ট, বিচিত্র ও পিচ্ছিলও হতে পারে। এটি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, বানোয়াট, শূন্যতা, বিতর্ক এবং নিজের অস্তিত্বের প্রেক্ষাপট লুকিয়ে রাখতে বা এড়িয়ে যেতে পারে। কম্পিউটিংকে আরও ব্যক্তিগত ও ঘনিষ্ঠ করার জন্য একটি দুর্দান্ত মাধ্যম। প্রতিটি চ্যাটবটের পেছনে একটি বা একাধিক সার্ভার রয়েছে। এটি বিশাল নেটওয়ার্কের কাজ।

এসব অবকাঠামোগত দিক কল্পনাকে শক্তিশালীই করে। প্রযুক্তিবিদরা প্রোগ্রামের সঙ্গে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক থাকার স্বপ্ন দেখেছেন। সম্প্রতি ওপেনএআইর সিইও স্যাম অল্টম্যান ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে তাঁর ম্যাকিনটোশের বিষয় এবং হঠাৎ উপলব্ধির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো একদিন কম্পিউটার চিন্তা করতে শিখবে।’ গত সপ্তাহে বড় উদ্যোক্তা মার্ক আন্দ্রেসেন তাঁর প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে সহানুভূতিশীল, সবজান্তা ও প্রেরণাদায়ক বটের এক বিশ্ব কল্পনা করেন। তিনি শিল্পী, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপ্রধান ও শিশুদের পাশাপাশি কাজ করার কথা বলেছেন। আন্দ্রেসেন লিখেছেন, ‘প্রতিটি শিশুরই একজন এআই টিউটর থাকবেন; যিনি অসীম ধৈর্যশীল, ব্যাপক সহানুভূতিশীল, অনেক জ্ঞানী ও যথেষ্ট সহায়ক।’ তাঁর মতে, ‘এআই টিউটর প্রত্যেক শিশুর পাশে থাকবে। তাদের বিকাশের প্রতিটি ধাপে; ভালোবাসার সঙ্গে তাদের সম্ভাবনার সর্বোচ্চ বিকাশে সহায়তা করবে।’

বাসায় আমি যখন একা থাকতাম, তখন চ্যাটজিপিটির পোর্টাল দেখতাম। ভাবতাম, এটি কেমন পরিশীলিত কৃত্রিম শৌখিনতা বা ‘বুদ্ধিমত্তা’! এটি প্রযুক্তিকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে? এটি কখনও রূপান্তরশীল বা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে পারে? এটি আমাদের জ্ঞান আদান-প্রদান ও ভালোবাসারও এক ‘যান্ত্রিক সংস্করণ’। একে তৈরি করেছে করপোরেট ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং বাজারজাত করছে, বিক্রি করছে। এরই মধ্যে আমার স্ক্রিনে নোটিফিকেশন আসছে। এ সময় আমার ফোনটি বেজে ওঠে। তবে ভবিষ্যতে বন্ধুবান্ধব বা এমনকি অপরিচিতদের মধ্যে নয়, বরং প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষ যে দীর্ঘ সময় চ্যাট করবে– তা খুব দূরে নয়। কারণ সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা যা শুনতে চায়; বলার জন্য তা সবসময় প্রস্তুত থাকে। আন্না উয়েনার: দ্য নিউইয়র্কারের লেখক; নিউইয়র্কার থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ মাহফুজুর রহমান মানিক

শেয়ার করুন