নিউইয়র্ক     বুধবার, ৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবার

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৩ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৭ মে ২০২৩ | ০১:১৩ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবার

শেখ হারুন : ঋণের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে মানুষ। দিন দিন মানুষের মধ্যে ঋণ নেওয়ার এ প্রবণতা ব্যাপক হারে বাড়ছে। দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি বা পরিবার এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত। যার সত্যতার খোঁজ পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ প্রতিবেদনেও।

বিবিএসের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবার ঋণগ্রস্ত। যেখানে ব্যক্তি বা পরিবারের প্রতিবছরে গড় ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ৭০ হাজার টাকারও বেশি। এ ঋণ তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে নিচ্ছে। করোনা-পরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণেই মানুষের মধ্যে ঋণের প্রবণতা বাড়ছে। মূলত তারা পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে অনেকটা অনন্যোপায় হয়েই ঋণের পথে পা বাড়াচ্ছেন এবং বেশি বেশি ধার করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী (জরিপ পূর্ববর্তী ১২ মাসে) আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ পরিবার। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৩২ দশমকি শূন্য ৩ শতাংশ পরিবার আর্থিক বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নিত। এ প্রবণতা ২০১৬ সালের জরিপে অনেকটা কমে গিয়েছিল। তবে ২০২২ সালের জরিপে আবার বেড়েছে।

গত ১২ এপ্রিল ২০২২ সালের খানার আয়-ব্যয় জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিবিএস। এক বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। সারা দেশের ৭২০টি নমুনা এলাকা থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ২০টি করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ খানা বা পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বছরব্যাপী এ তথ্য সংগ্রহের কাজ চলে।

জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণ নেওয়ার প্রবণতা শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। ২০২২ সালের জরিপে শহরে ৩২ দশমিক ১১ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে, যেখানে এই সময়ে গ্রামে ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে। ২০১৬ সালে শহরে ২২ দশমিক ১০ শতাংশ এবং গ্রামে ৩২ দশমিক ১১ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে। ২০১০ সালে এ হার ছিলে যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ৩৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

৬ বছরের ব্যবধানে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০২২ সালের খানার আয়-ব্যয় জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের খানাভিত্তিক গড় ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ৭০ হাজার ৫০৬ টাকা। এ হার ২০১৬ জরিপের ছিল ৩৭ হাজার ৭৪৩ টাকা এবং ২০১০ ছিল ২৮ হাজার ৬২ টাকা।

ঋণ নেওয়ার সংখ্যায় গ্রাম এগিয়ে থাকলেও টাকার পরিমাণে শহরের পরিবারগুলো এগিয়ে। ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, গ্রাম এবং শহরের ঋণ নেওয়ার পরিমাণে ব্যবধান অনেক। গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলো টাকার পরিমাণে কয়েকগুণ বেশি ঋণ নেয়। শহরে জরিপ পূর্ববর্তী ১২ মাসে গড় ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৯৫ টাকা এবং গ্রামে যার পরিমাণ ৪১ হাজার ৯২১ টাকা।

২০১৬ সালে শহরে একটি পরিবার ঋণ নিত ৫৯ হাজার ৭২৮ টাকা, যেখানে গ্রামে গড় ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৩৩২ টাকা। আর ২০১০ সালে গড় পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৪ হাজার ১২২ টাকা এবং ২১ হাজার ৮০৪ টাকা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, করোনার সময় চাকরি হারানো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এসব কারণেই মূলত মানুষের সঞ্চয় কমেছে এবং ধার করতে বাধ্য হয়েছে।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, কয়েকটি কারণে ঋণ গ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমতো করোনায় অনেকের আয় কমে যাওয়ায় তাদের সঞ্চয় কমে গেছে, যে কারণে ঋণ গ্রহণের হার বেড়েছে। দ্বিতীয়ত জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব, আরেকটা কারণ হতে পারে, ধার করে অনেকে বিদেশে গেছে, সেটাও ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে।

গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষ বেশি পরিমাণে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগুলোর ক্ষেত্রে ব্যয় অনেক বেশি। সে কারণে যাদের ঋণ নিতে হয়েছে তাদের পরিমাণে বেশি নিতে হয়েছে। আবার যাদের চাকরি আছে তাদের হয়তো লাগেনি। সেজন্য সংখ্যায় কম হলেও শহরে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেশি।

এদিকে ঋণ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ বা অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা দেওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ সালের খানা আয় ব্যয় জরিপে ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ পরিবার অর্থ জমা রাখত। সেটা ২০১৬ সালের জরিপে বেড়ে হয় ১৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। তবে ২০২২ সালের জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী এ প্রবণতা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ২১ দশমিক ৩০ শতাংশ পরিবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রাখে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রাখার দিক থেকেও গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলো এগিয়ে। বর্তমান জরিপ অনুযায়ী, গ্রামে ২১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ এবং শহরে ২১ দশমিক ৮৫ শতাংশ পরিবার অর্থ জমা রাখে। অপ্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রাখার হার কিছুটা কম। তবে আগের জরিপগুলোর তুলনায় বেড়েছে। ২০২২ সালের জরিপের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ পরিবার অপ্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রাখে। যে হার ২০১৬ সালে ছিল ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে যে আয়ের বৈষম্য বাড়ছে তাও এটি থেকে বোঝা যায়। কেউ কেউ হয়তো কিছু টাকা জমা রাখছে আবার অন্যদের হয়তো ধার করতে হচ্ছে, সঞ্চয় ভেঙে খেতে হচ্ছে। সুত্র কালবেলা

সুমি/পরিচয়

শেয়ার করুন