নিউইয়র্ক     সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো. ছানাউল্লাহ

আরাভ খান ও অর্থপাচার : ডেভিড ইস্টন ও মারিও পুজো বাণীই যখন সত্য

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৩ | ১১:১৬ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৩ | ১১:২৮ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
আরাভ খান ও অর্থপাচার : ডেভিড ইস্টন ও মারিও পুজো বাণীই যখন সত্য

আরাভ খান আকাশ থেকে আবির্ভূত হননি। তিনি মর্তেই জন্মেছেন এবং এই রাষ্ট্রের এই সমাজের ‘গর্তে’ই বেড়ে উঠেছেন। হালে আলোচিত আরাভ খান একজন নন, অনেকজন। সময়ের খেয়ালিতে হোক অথবা ‘দুর্বৃত্তায়নের দ্বন্দ্বেই’ হোক ‘ফান্দে’ পড়ে গেছেন একজন। কিন্তু শত আরাভের কাহিনি আমাদের অজানা। তবে আন্দাজের বাইরে নয়।

‘প্রতিটি সৌভাগ্যের পেছনে একটা বড় অপরাধের গল্প লুকিয়ে থাকে’। এটিকে ফরাসি ঔপন্যাসিক অনরে দে বারজাকের (বাংলায় প্রচলিত নাম বালজাক, ১৭৯৯-১৮৫০) উক্তি হিসেবে ধরা হয়। মারিও পুজোর বিশ্ববিখ্যাত ‘দ্য গডফাদার’ উপন্যাসেও এমন কথা এসেছে। অনরে দে বারজাকের মতে, প্রতিটি সফলতা বা উত্থানের গোপন রেসিপি হলো এর পেছনে অপরাধ থাকে। তবে এ অপরাধ আর ধরা-ছোঁয়া যায় না। কারণ এটি খুব মুনশিয়ানার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে।

আরাভ খানদের মিলিয়ে নিলে এই উক্তির যথার্থতা টের পাওয়া যায়। মানুষ মেধার প্রয়োগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তাঁর ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন করতে পারে, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। তবে এর জন্য প্রয়োজন সময়পরিক্রমা ও কাজের ধাপ। বাংলাদেশের ভূমিকেন্দ্রিক অনেক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিয়ে নিলে এই উক্তির যথার্থতা বোঝা যাবে।

ডেভিড ইস্টন ও ব্ল্যাকবক্স

সিদ্ধান্ত গ্রহণ তত্ত্বের অনেক তাত্ত্বিকদের মধ্যে একজন—ডেভিড ইস্টন। তাঁর তত্ত্বের আলোকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের রূপায়ণ না করে একটু আরাভ খানদেরকে টেনে নেব। এতে অনেক আরাভ খান তৈরির বিষয়টি আমজনতার কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে সুবিধা হবে।

ডেডিভ ইস্টনের ডিসিশন মেকিং থিওরি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ তত্ত্বের গূঢ় হলো, আমরা যা দেখি বা ভোগ করি তার পেছনে রয়েছে একদল সিদ্ধান্তগ্রহীতার নেওয়া সিদ্ধান্ত। তবে তাঁরা কিসের ভিত্তিতে ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তা বাইরের মানুষ জানে না। যেমন: একজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলো। খালি চোখে আমরা দেখি অমুক অপরাধের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু একটু দম নিলেই দেখা যাবে, তার চেয়েও জঘন্য সব কর্মকাণ্ড করে একজন বহাল তবিয়তে আছেন। তাহলে তমুকের বিষয়ে এমনটা হলো কেন? আসলে এটা আপনি-আমি বলতে পারব না, হয়তো কোনো কোনো বিষয় অনুমান করতে পারব। আর এসব অনুমান বা ব্যাখ্যা সঠিক নাও হতে পারে। কারণ সিদ্ধান্তগ্রহীতা বা গ্রহীতারা ঠিক কোন কারণে এমনটি করেছেন তা তাঁদের মস্তিষ্কের কোটরেই থাকে। এ জন্যই ডেভিড ইস্টন তাঁর তত্ত্বে সিদ্ধান্তগ্রহীতাদের এই আসরকে ব্ল্যাকবক্স বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ দুর্ঘটনা কবলিত উড়োজাহাজের ককপিটে থাকা ব্ল্যাকবক্সের মতো এখানেও তথ্য থাকে সুরক্ষিত।

গডফাদার কিংবা মামাদের দাপট

বাবার ওপর বাবা থাকেন, গডফাদারের ওপর গডফাদার। আরাভ খানেরা একেকজন এক-একটি মডেলমাত্র। তাদের ওপর পদসোপানভিত্তিকভাবে (হায়ারারকি) থাকে অপরাধীর পর অপরাধী। এই গডফাদাররা কীভাবে আমাদের নিয়ে খেলেন তা আমরা নিজেরাও জানি না। মারিও পুজোর মতে, পৃথিবীতে যা ঘটে তার অধিকাংশের পেছনেই রয়েছে কোনো না কোনো গডফাদার বা গডফাদারদের হাত। সেটা হতে পারে কোনো দেশের সরকার গঠন বা কোনো কোম্পানির বাজার দখল। করোনাকালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে আমরা শাহেদ-সাবরিনাদের ধরতে দেখেছি। কিন্তু তাঁরাই কি স্বাস্থ্যখাতের বড় ‘ডন’। না কি সুযোগে, তাঁদের ধরিয়ে দিয়ে আরও বড় ডনেরা নিজেদের প্রতিশোধ নিয়েছে ও আখের গুছিয়েছে?

অর্থপাচার ও আইন

বাংলাদেশিরা বিদেশে যে বেগমপাড়া তাঁর পেছনে ঢের অভিযোগ অর্থপাচারের। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) জাতিসংঘে দেওয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হিসাব থেকে বের করে যে, বাণিজ্যের আড়ালে কত অর্থ পাচার হয়ে যায়। জিএফআইয়ের তথ্য হিসাব কষে দেখা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৭১ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। (তারিক চয়নের নিবন্ধ, অর্থ পাচারের সাতকাহন, আলী রীয়াজ সম্পাদিত লুণ্ঠিত ভবিষ্যৎ, প্রথমা প্রকাশন)।

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বড় মাধ্যম হুন্ডি। এর বাইরে রয়েছে পণ্য আমদানিতে ‘ওভার-ইনভেয়েসিং’ অর্থাৎ পণ্যের আমদানি মূল্য বেশি দেখানো। এতে সবার চোখের সামনে ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমেই টাকা পাচার হয়ে থাকে। আর বিদেশে বসে হোম্বা-চোম্বাদের ডলার ঘুষ বাণিজ্যের কথাতো আমাদের জানার বাইরে। ফলে আরাভ খানদের পেছনে খাটানো মূলধনের উৎস কি তা সংশ্লিষ্ট ‘ধনকুবেররাই’ বলতে পারবেন।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ১৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন কোন ব্যক্তি বা সত্তা মানিলন্ডারিং অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইলে আদালত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত দেশে বা দেশের বাহিরে অবস্থিত যে কোন সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করিবার আদেশ প্রদান করিতে পারিবে’। ২০১৫ সালে আইনটি সংশোধন করে এ-সংক্রান্ত মামলা দায়ের ও তদন্তে দুদকসহ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস বিভাগ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে এখতিয়ার দেওয়া হয়।

এত সব আইন থাকতে কেন এত অর্থ পাচার হয়ে যায়? ব্যাংকমালিক থেকে শুরু করে আরাভ খান—সবাই পার পেয়ে যায়।

শেষ করছি অনরে দে বারজাকের আরেকটি উক্তি দিয়ে। তাঁর মতে, ‘আইন হলো সেই মাকড়শার জাল, যার ভেতর দিয়ে বড় মাছিরা অনায়াসে পালিয়ে যায় কিন্তু ছোটরা ধরা পড়ে।’ কিন্তু কথা হচ্ছে, বড় মাছিরা না, ছোট মাছিদেরও আটকাতে পারছে না সরকার। যেখানে সুশাসনের অভাব, অসত্যের দম্ভ ভরা শ্বাস—সেখানে কি এটিই হওয়ার কথা ছিল না? – মো. ছানাউল্লাহ প্রথম আলোর সহসম্পাদক দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে

শেয়ার করুন