নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ১৪ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাঠে চাঙ্গা বিএনপি, সামনে ১০ চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২২ | ০৪:১৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২২ | ০৪:১৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
মাঠে চাঙ্গা বিএনপি, সামনে ১০ চ্যালেঞ্জ

চলমান আন্দোলন সফল করে বিএনপি কি নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ নির্বাচনের দাবি আদায় করতে পারবে? সরকারকে বাধ্য করার মতো অপ্রতিরোধ্য গণসংগ্রাম কি গড়ে উঠবে? নাকি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যেতে বাধ্য হবে এবারও? সর্বত্র এ নিয়েই চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।

অবশ্য এরই মধ্যে নিজেদের কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন বিএনপি নেতারা যে, নির্দলীয় সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না এবং নির্বাচন হতেও দেবেন না। এ পর্যন্ত আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করে এই লক্ষ্য সফল করতে বিএনপিকে কমপক্ষে ১০টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্নেষক ও দলটির শীর্ষ নেতারাও। প্রায় দেড় দশক ক্ষমতার বাইরে থেকে মামলা-হামলায় সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত দলটির পক্ষে এসব চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণ কঠিন বৈকি মনে করছেন তাঁরা।

তবে দলের নেতারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞা প্রকাশ করছেন। সরকারি দলের হামলা, কোথাও কোথাও পুলিশের বাধা ও গণপরিবহন অচল করে রাখার পরও বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোয় বিপুল জনসমাগম বিএনপিকে উৎসাহিত করেছে, আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রকৃতি, সংকটের গভীরতা এবং ব্যাপ্তি বিষয়ে ধারণার অভাবের কারণে কৌশল তৈরির ক্ষেত্রে বিরোধী দলগুলো সব সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে সরকারি প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল বর্তমানে অনেকটা একাকার হয়ে পড়ায় ক্ষমতার পরিবর্তন সহজ নয়। বড় গণসমাবেশ দিয়েই চূড়ান্ত দাবি আদায় করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময়ে লাগাতার হরতাল-অবরোধ করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সমতলভূমি আদায়ে ব্যর্থ হয় বিএনপি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা শক্তিশালী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলনে বিজয়ী হতে বিএনপির জন্য মূল্য কত কঠিন হবে এবং চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবে- তা সময় বলে দেবে।

পর্যবেক্ষক ও দলীয় নেতাদের দৃষ্টিতে বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জগুলো কী? ১. অবিচল থেকে দলকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ রাখা; ২. সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ অহিংস গণআন্দোলন গড়া; ৩. হামলা-মামলা মোকাবিলা করে জনগণকে রাজপথে নামানো; ৪. প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করা ও বলপ্রয়োগ মোকাবিলা; ৫. যুগপৎ আন্দোলনে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গড়া; ৬. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়; ৭. গোয়েন্দা থেকে পরিকল্পনার গোপনীয়তা রক্ষা; ৮. দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সংকট; ৯. যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা এবং ১০. আর্থিক সচ্ছলতার অভাব।

এসব বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেছেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সবকিছু মোকাবিলা করবেন তাঁরা। জনগণের ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন তাঁরা। শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলনের মাধ্যমেই সব বাধা অতিক্রম করবেন এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায় করতে পারবেন বলে আশাবাদী তাঁরা।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতীতের আন্দোলন থেকে এবারের ভিন্নতা হচ্ছে অত্যাচার-নির্যাতন উপেক্ষা করে নেতাকমী-সমর্থকদের সঙ্গে জনগণও রাজপথে নামছেন।

বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেন, বিএনপির ডাকে সাম্প্রতিক অতীতের আন্দোলন থেকে বর্তমানের ভিন্নতা হলো, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্নীতি সাধারণ মানুষের জন্য জীবনযাত্রা অনেক বেশি অসহনীয় করে তুলেছে। ফলে শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের পরিবর্তন চাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

তিনি বলেন, বিএনপির দিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আন্দোলন জনজীবনের সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো- দেশের উদ্ভূত সংকটের সমাধান তাঁরা কীভাবে দেবেন, সেটারও একটি রূপরেখা তুলে ধরা।

এ বিষয়ে সুজন সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেন, বর্তমানে রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ২০১৮ সালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা ও নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে আগের রাতেই ভোট কারচুপি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনে। জনগণের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এখন তাদের স্বার্থেই তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখছে।

দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা : দাবি আদায়ে অবিচল থেকে তৃণমূল থেকে দলকে সুসংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধ রাখা বিএনপির একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা। তাঁদের মতে, বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো ঠিক রেখে বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে নানামুখী তৎপরতা চালাতে পারে সরকার। তাতে দলের ভেতর বিভেদ তৈরি ও ফাটল ধরিয়ে ভাঙনের চেষ্টা হতে পারে।

অবশ্য বিএনপি নেতারা জানান, কয়েক বছর আগে কিছু শীর্ষ নেতা বেইমানি করে দল ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। এবার তৃণমূলে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৮২টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৫২টিতে এরই মধ্যে কমিটি করে পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত সাবেক ছাত্রদল নেতাদের উচ্চপদে আনা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেছেন, সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনে পিষ্ট বিএনপি নেতাকর্মী সরকারের কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেবেন না বলে তাঁর বিশ্বাস।

শান্তিপূর্ণ অহিংস গণআন্দোলন গড়া : শেষ পর্যন্ত সংঘাত এড়িয়ে অহিংস শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন গড়াই দলটির জন্য কঠিন হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা। তাঁদের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনের ইতিহাস বিশ্নেষণ করলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ অহিংস আন্দোলনই অধিক মানুষকে যুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং সেগুলো সাফল্যও অর্জন করে বেশি। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয় যে, ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই কেবল এ ধরনের একটি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব। একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁরা বলেন, মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেই একটা আন্দোলন সফল হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে কোনো সংঘাত ও সহিংসতায় জড়াতে চায় না বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সমকালকে বলেন, সরকারি দল ও প্রশাসন তাঁদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নানাভাবে হামলা ও বাধা দিয়ে বিএনপিকে সংঘাতে জড়াতে চায়। বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোতে হামলা ও গণপরিবহন বন্ধ এর প্রমাণ।

জনগণকে রাজপথে নামানো : বিএনপি নেতারা বলছেন, গত ১৪ বছর ধরে তাঁদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে হামলা করে উল্টো হাজার-হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা দিয়েছে সরকার। ২০১৫ সালে বাসে অগ্নিসংযোগ করে বিএনপি নেতাকর্মীদের আসামি করে ঘরছাড়া করার জন্য তাঁরা সরকার পক্ষকেই দায়ী করেন। আগামী দিনেও এসব ঘটনা ঘটতে পারে।

এটি কর্মীদের জন্য তো চ্যালেঞ্জ বটেই, জনগণকে সম্পৃক্ত করে রাজপথে নামানো সে কারণেই কঠিন বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা। তাঁরা আরও জানান, বিএনপির নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল। তা ছাড়া বিএনপি জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে- এমন কোনো কর্মসূচি দাঁড় করাতে পারেনি। যেমন আওয়ামী লীগের ‘দিন বদলের সনদ’ বা ‘রূপকল্প ২০২১’ অঙ্গীকারনামা জনগণকে আকৃষ্ট করেছিল। পক্ষান্তরে নিজেদের দলীয় স্বার্থ, দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বিএনপি; জনগণকে আকৃষ্ট করার মতো কর্মসূচি নেই।

অবশ্য বিশ্নেষকদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিএনপি নেতারা। তাঁরা বলেন, সম্প্রতি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে জেলা পর্যায়ের সমাবেশে অংশ নিয়ে দলের পাঁচজন কর্মী প্রাণ দিয়েছেন। বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ অংশ নিয়েছেন, যা দিনে দিনে বাড়ছে।

যুগপৎ আন্দোলনে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ‘: বিভাগীয় গণসমাবেশগুলো বিএনপি এখন একা করছে। তাদের ঘোষিত কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য দলগুলো নিয়ে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গঠন বাস্তবায়িত করাও চ্যালেঞ্জ হবে। ক্ষমতাসীনদের তরফে সমমনা দলগুলোকে ভয় ও লোভ-লালসা দেখানোর অভিযোগ করছে বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতাদের মন্তব্য হচ্ছে, রাজনৈতিক জোট গঠন নিয়ে পর্দার আড়ালে ‘নীরব যুদ্ধ’ চলছে। তার পরও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে ঐক্য গড়ার কাজ এগিয়ে যাচ্ছে বলে তাঁরা দাবি করেন।

রাজনৈতিক বিশ্নেষকদের মতে, আগামী দিনের রাজনৈতিক কৌশলে বিএনপি জোটের শরিক কাদের করছে- তা গুরুত্বপূর্ণ। সমমনা দলগুলোর মাঠ পর্যায়ে সাংগঠনিক সক্ষমতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি অন্যতম। বিগত দুটি নির্বাচনে জোটগত আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়েও তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে দলটির। বিগত নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে ওই জোটের শীর্ষ নেতা করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে দলের ভেতর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সমর্থন : দলটির ফরেন উইং সূত্র জানায়, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে জোর চেষ্টা করছে বিএনপি। নানামুখী লবিং চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে তারা। এ বিষয়ে বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে গুম-খুনের তালিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনটির বিরুদ্ধে পাল্টা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ‘কথিত সেনা সদস্যদের হত্যার’ অভিযোগ উত্থাপন করছে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় শক্তিকে ব্যবহার করছে।

আরও পর্যবেক্ষণ, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেভাবে দেখে, চীন ও ভারত সেভাবে দেখে না। বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন আদায়ও চ্যালেঞ্জের বিষয়। তবে বিএনপি নেতারা আশাবাদী।

প্রশাসনের নিরপেক্ষতা : সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে বল প্রয়োগের যে কৌশল প্রয়োগ করছে, তা মোকাবিলা করাও কঠিন বলে মনে করেন অনেকে। বিগত ১৪ বছরে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অনেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছেন। সুবিধাভোগী এসব দলবাজ কর্মকর্তা এবং এ সময়ে নতুন রিক্রুটমেন্ট হওয়া কর্মকর্তারা চাকরি হারানোর ভয়ে বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেবেন বলেও মনে করেন বিশ্নেষক ও বিএনপি নেতারা।

মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আশা করেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন পাওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণের বিরুদ্ধে আর দাঁড়াবেন না। রাজনৈতিক কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে একদিন তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ইতোমধ্যে সমাবেশে গুলি চালানো অতিউৎসাহী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে তাঁরা মামলা করা শুরু করেছেন।

গোপনীয়তা রক্ষা : বিএনপি সূত্র জানায়, বিরোধী দলের প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন। টেলিফোনে আড়িপাতা বিষয়টি সরকারের হাতে থাকায় বিএনপির যে কোনো আগাম পরিকল্পনা সরকারপক্ষ জেনে যাচ্ছে।

দলটির নেতাদের দাবি, আগাম গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের তথাকথিত ‘অগ্নিসন্ত্রাস’-এর মতো ঘটনা সাজানো হয়। সরকার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন বাহিনী ও সরকারের হাতে অনেকগুলো গণমাধ্যম থাকার কারণে বিরোধী দলের কর্মসূচিকে আগুন সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করা ছিল সহজ।

শীর্ষ নেতৃত্বের সংকট : বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জামিনে মুক্ত থাকলেও সক্রিয় রাজনীতি করতে পারছেন না। আবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সাজাপ্রাপ্ত হয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি ভার্চুয়ালি দল পরিচালনা করলেও সশরীরে উপস্থিত না থাকায় নেতৃত্বের একটি সংকট বিরাজ করছে। বিগত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন- কূটনীতিকদের এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেননি জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। সম্প্রতিও সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিএনপির শীর্ষ নেতা কে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রেও শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন উঠছে। যদিও বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, চলমান আন্দোলনে বিএনপির স্টাইকার বা ফিনিশার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই।

যুদ্ধাপরাধী জামায়াত প্রশ্ন : বিশ্নেষকরা বলছেন, বিএনপি ডানপন্থি কয়েকটি রক্ষণশীল দলকে জোটে রেখে ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার দিকে চলে গেছে। এমনকি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সামগ্রিক দর্শনকে ছেঁটে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদীর দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে। ভোটের হিসাবে অবশ্য বিএনপির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে দেশে-বিদেশে ইমেজ সংকটে পড়েছে দলটি। বিষয়টি দেরিতে হলেও দলটির হাইকমান্ড অনুভব করেছেন। জামায়াতকে দূরে রেখেই আগামী দিনের যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ২০ দলীয় জোটকে নিষ্ফ্ক্রিয় রাখলেও এখনও ভাঙার ঘোষণা দেয়নি। এমনকি জোটের অন্যতম শরিক এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ সম্প্রতি জামায়াত বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করবে বলে জানিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে ভোটের অঙ্ক কষে শেষ পর্যন্ত জামায়াত থেকে বিএনপি কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

আর্থিক সমস্যা : দলীয় সূত্র জানায়, টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি আর্থিকভাবে কিছুটা অসচ্ছল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিএনপি সমর্থক বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি নেতাদের অনেকেই চাপের মুখে দল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, কোষাধ্যক্ষ মিজানুর রহমান সিনহা, সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম এমএ হাসেম, দলের কেন্দ্রীয় নেতা সাহাব উদ্দিন প্রমুখ। একই সঙ্গে অন্য দল সমর্থক শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা সরকারের ভয়ে অনুদান দেওয়া থেকেও বিরত রয়েছেন।

এ বিষয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, তাঁরা পৈতৃক জমি বিক্রি এবং নেতাকর্মীদের চাঁদার টাকায় রাজনীতি করছেন। দলটির একটি সূত্রের দাবি, বর্তমান সরকারের আমলে ধনিক শ্রেণি ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। পটপরিবর্তনে ক্ষতির আশঙ্কায় তাঁরা সরকারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেবেন।

শেয়ার করুন