নিউইয়র্ক     শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ড. এ কে আব্দুল মোমেন

‘ব্যবসা হলে স্বীকৃতি আসবে’

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৩ | ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৩ | ১২:১৫ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
‘ব্যবসা হলে স্বীকৃতি আসবে’

আমি তখন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর একান্ত সচিব। এ সময়ে খন্দকার মোশতাক ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। খন্দকার মোশতাক প্রায় সময়ই অফিসে আসতেন না। আর ওই সময়ে মনে হয় তিনি পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলো দেশে বেড়াতে গেছেন। ফলে আমার মন্ত্রী তখন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। আমরা তখন ইন্ডিয়া থেকে সবকিছুই কিনে থাকি। কয়লাটা আমদানি করি ইন্ডিয়া থেকে। এর কিছুদিন আগে ইন্ডিয়া থেকে লবণ আমদানির কথা ছিল। লবণ যথাসময়ে এল না। ইন্ডিয়া শেষ সময়ে লবণ আসাটা বন্ধ করে দিল। তারা বলল, ওখানকার শ্রমিকরা স্ট্রাইক করেছেন পোর্টে। সেজন্য তারা লবণ পাঠাতে পারেনি। বাংলাদেশে এটা নিয়ে খুব হইচই। এর পরপর আমরা ভারত থেকে কয়লা কিনব। তখন যারা কয়লা বাংলাদেশে আনতেন তাদের অন্যতম হচ্ছেন মহসিন এমপি এবং আরেকজন সিলেটি, নাম মনে পড়ছে না।

তারা এসে প্রতিমন্ত্রীকে জানালেন যে ইন্ডিয়া কখনই সময়মতো কয়লা ছাড়ে না। ইন্ডিয়া থেকে কয়লা সস্তায় কেনা যায় বা ট্রান্সপোর্ট খরচও কম। তবে প্রত্যেক সময়েই শেষ মুহূর্তে তারা ঝামেলা বাধায়। যথাসময়ে কয়লা ছাড় দেয় না এবং তাদের কয়লা নিম্নমানের। সেজন্য তারা বললেন, শুধু ইন্ডিয়া থেকে কয়লা না এনে বিকল্প হিসেবে চীন থেকে কয়লা আমদানি করা যায় কিনা। চীনও কয়লা রফতানি করতে রাজি। কিন্তু চীনের কয়লার দাম বেশি। দাম বেশি তাই কেনা যাবে না। আমরা তখন খুব কৃচ্ছ্রসাধন করছিলাম। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ছিল।

যারা কয়লা আমদানি করেন, যেমন মহসিন সাহেবের দল (আমরা তাকে কয়লা মহসিন নামে ডাকতাম)। তিনি অত্যন্ত সৎ এবং পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন। এর আগে তাকে নিয়ে আমরা ইংল্যান্ডেও গিয়েছিলাম। তিনি খুলনা থেকে নির্বাচিত এমপি ছিলেন। সেই থেকে তার সঙ্গে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। মহসিন ভাই বারবার বলেছিলেন, ইন্ডিয়া থেকে কয়লা আনতে অনেক ঝামেলা হয়। তাই চীন থেকে কয়লা আমদানির পক্ষে তিনি। কিন্তু সমস্যা হলো চীনের কয়লার দাম বেশি। আমাদের সচিব ছিলেন তখন এক্সটার্নাল ট্রেডের নূরুল ইসলাম। তারা দুই ভাই সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। এক ভাই ইন্ডাস্ট্রি সেক্রেটারি মতিউল ইসলাম এবং অন্যজন নূরুল ইসলাম। নূরুল ইসলাম দাম বেশি দেখে চীন থেকে কয়লা কেনার প্রস্তাবটা নাকচ করে দেন। আমার মন্ত্রীর কাছে যখন ফাইলটা এল তখন কয়লা ব্যবসায়ীরা আমার মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এবং বলেন, ইন্ডিয়া থেকে কয়লা আমদানি করলে সময়মতো কয়লা পাওয়া যাবে না এবং যা পাওয়া যায় তাও নিম্নমানের।

দিল্লিতে থাকা অবস্থায় আমরা সর্বপ্রথম মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক করলাম চাইনিজদের সঙ্গে। বৈঠকটি চীনা দূতাবাস আয়োজন করে। এটা ছিল ডিনারের দাওয়াত। ওখানে চাইনিজদের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি ছিল। তখন বার্মায় (মিয়ানমার) নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত খাজা কায়সারও যোগ দেন। খাজা কায়সার একসময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে চীনে ছিলেন। এর কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর আদেশে আমরা চীন থেকে কয়লা আমদানি করি। হয়তো তারই ফলে এ বৈঠকটা সম্ভব হয়

আমার মন্ত্রী তখন ফাইল নিয়ে সোজা বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন এবং সঙ্গে আমিও ছিলাম। সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর রুমে ঢুকলেন। বঙ্গবন্ধু তখন সুগন্ধায় অফিস করতেন। আমার বস ফাইলটা দিলেন বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু ফাইলটা দেখে গভীর মনোযোগে পড়লেন, কিন্তু কোনো কথা বললেন না। কোনো কথা না বলে ফাইলটা সই করে দিলেন। তারপর বললেন, ‘গাজী সাহেব, অনুমোদন দিয়ে দিলাম। ব্যবসা হলে স্বীকৃতি আসবে। একটু বেশি টাকা খরচই হলো তাতে কি, স্বীকৃতি তো পাব। পাশাপাশি বিকল্প উৎস থাকা ভালো।’ ফাইল নিয়ে আমরা চলে এলাম। এটা নিয়ে তিনি কিন্তু কারো সঙ্গে আলাপ করেননি। এই যে তার তড়িৎ গতিতে সুদূরপ্রসারী চিন্তা, এটা আমার নিজের চোখেই দেখলাম।

১৯৭৪ সাল। ফেব্রুয়ারিতে আমরা এসক্যাপ কনফারেন্সে নয়াদিল্লিতে যাই। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা আমার প্রতিমন্ত্রী। চারজনের প্রতিনিধি দল। আমি ওই দলের সদস্য সচিব হিসেবে যাই। তখনকার সময়ে পিএস হিসেবে যেতাম কম। বাকিদের মধ্যে ডেপুটি লিডার ড. আশরাফুজ্জামান। তিনি আমাদের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। আরেকজন মহিউদ্দিন, টেপের (টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স, ইআরডি) চিফ বা প্রধান ছিলেন। আর ওখানে আমাদের দলে যোগ দেন রাষ্ট্রদূত ড. এআর মল্লিক এবং দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর কামরুল হুদা, তখন ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন আতাউল করিম সাহেব। দিল্লিতে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন আমাদের রিসিভ করলেন ইন্ডিয়ার স্টেট মিনিস্টার অব কমার্স প্রণব মুখার্জি। পরবর্তী সময়ে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হন।

এখানে মজার কাহিনী আছে। দিল্লিতে থাকা অবস্থায় আমরা সর্বপ্রথম মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক করলাম চাইনিজদের সঙ্গে। বৈঠকটি চীনা দূতাবাস আয়োজন করে। এটা ছিল ডিনারের দাওয়াত। ওখানে চাইনিজদের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি ছিল। তখন বার্মায় (মিয়ানমার) নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত খাজা কায়সারও যোগ দেন। খাজা কায়সার একসময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে চীনে ছিলেন। এর কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর আদেশে আমরা চীন থেকে কয়লা আমদানি করি। হয়তো তারই ফলে এ বৈঠকটা সম্ভব হয়। এখানে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা আমার চোখের সামনে এখনো ভাস্বর। ড. এ কে আব্দুল মোমেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। দৈনিক বণিকবার্তার সৌজন্যে

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন