নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ক্যারেন ডেনইয়ং

বিশ্ব রাজনীতির কূটচালের যুদ্ধ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৩ | ০২:১৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০১ মে ২০২৩ | ০২:২৫ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বিশ্ব রাজনীতির কূটচালের যুদ্ধ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে পুতিন অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন। দক্ষিণ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে অবশ্য সম্পর্কের হিসেবে তাকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সবকিছু দেখে মনে হয়, বৃহৎ শক্তিগুলোর রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমরাঙ্গন হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে। প্রক্সি শব্দটি এখানে ভেবে দেখা জরুরি। আপনার বাজে কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করানোই প্রক্সি। সম্প্রতি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বিশেষত ডিসকর্ডে কিছু তথ্য ফাঁস হওয়ার পর এই যুদ্ধের প্রতিটি ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাদের কাছে যুদ্ধের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ও রয়েছে। ফাঁস হওয়া তথ্যে এও জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধক্ষেত্রে অসংখ্য এসপিওনাজ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিয়োজিত করেছে। এই যুদ্ধের ফলাফলে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ জড়িত থাকলেও বাইডেন প্রশাসন বরাবরই তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এই যুদ্ধ পুতিনের কারণেই দীর্ঘদিন চলছে। এ কথা সত্য। কিন্তু এও সত্য, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি আর্থিক সহযোগিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করেছে। মূলত রাশিয়াকে দমানোর রাজনৈতিক চাল হিসেবেই এই যুদ্ধকে দেখা হচ্ছে। সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেও এ বিষয়ে একটি মন্তব্য করেন। গত জুনে মাদ্রিদে ন্যাটো সামিটে বাইডেন নিজেও ঘোষণা দিয়েছিলেন, রাশিয়াকে হারানোর জন্য তারা সবকিছু করতে রাজি। যতদিন ইউক্রেন জয়ী না হবে ততদিন তারা জ্বালানিতে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করবেন। তবে ইউক্রেনে ন্যাটো কিংবা মার্কিন সেনা মোতায়েন না করার সিদ্ধান্তও জানিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য, পরিকল্পনা পর্যায়ে রাশিয়ার ব্যর্থতাই এই যুদ্ধ শেষ করবে।

ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে অবশ্য একটি চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেল। ভ্লাদিমির পুতিন বললেন, এক বছরের এই যুদ্ধ থেকে তিনি অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আরও জটিল অস্ত্র নির্মাণের কাজে তারা সফল এবং ইউক্রেন যেন তাদের এই অস্ত্রের ক্ষমতা পরীক্ষার উপযুক্ত মঞ্চ। মূলত গোটা ইউরোপেই এক ধরনের প্রক্সি যুদ্ধ তৈরি করে বিরোধী শক্তিদের হটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে রাশিয়া। বিশেষজ্ঞরা যত দ্রুত সম্ভব এই যুদ্ধের ইতি দেখতে চান। আন্তর্জাতিক স্কলাররা অবশ্য একে অপরের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক চালাচ্ছেন। বিশ্ব রাজনীতি কি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে একটি প্রক্সি যুদ্ধ হিসেবে দেখছে? এদিকে যুদ্ধের ময়দানে ধ্বংসযজ্ঞ চলছেই। কিন্তু এই জিজ্ঞাসাও একটু যাচাই করে দেখা জরুরি। কিংস কলেজ লন্ডনের সমরবিদ্যার ইমেরিটাস অধ্যাপক লরেন্স ফ্রিডম্যান জানান, ‘আধুনিক যুদ্ধে সুনিপুণ এবং নির্ভুল তথ্যের গুরুত্ব অনেক। তবে প্রক্সি যুদ্ধ সম্পর্কে এখনও বৈশ্বিক রাজনীতিতে সঠিক ধারণা আমাদের নেই। তবে একটি রাষ্ট্র তার স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্য একটি দেশকে ব্যবহার করার প্রক্রিয়ায় বোধহয় প্রক্সি যুদ্ধ।’ তবে এই ধারণা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তার এই মন্তব্যের বিপক্ষেও জোরালো মন্তব্য আছে। কারণ বৃহৎ শক্তিগুলো রাশিয়াকে দমানোর জন্য ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্র, এমনকি আর্থিক সহযোগিতাও দিচ্ছে। অনেক পশ্চিমা রাষ্ট্রই রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে চাচ্ছে। পুতিনকে একজন যুদ্ধসন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে বিশ্ব রাজনীতিতে যে জটিল আবহ তৈরি হয়েছে তা থেকে এই যুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য আবছাভাবে অনেকের কাছেই ধরা পড়ছে।

সম্প্রতি যুদ্ধের ভয়াবহতা আরও বেড়েছে। ইউক্রেন বেশ কয়েকটি হামলায় বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। অনেকেই বিষয়টিতে খুশি। কারণ রাশিয়া বিজয়ী হলে অনেকের জন্যই ক্ষতির খবর হয়ে দাঁড়াবে। একজন মন্তব্য করলেন, ‘এই যুদ্ধ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া বিশ্বের ক্ষমতার বলয় কেমন হতে পারে।’ ইউক্রেন যদি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা না পেত তাহলে পুতিনের চাপে তাদের দ্রুতই ভেঙে পড়তে হতো। রাশিয়ান আধিপত্য মেনে না নেওয়ার দরুন ইউক্রেনের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেক নেতাকেই কারাভোগ করতে হতো। ফ্রিডম্যান অবশ্য এত যুক্তি-ব্যাখ্যা পেয়েও কিছু বিষয়ে মন্তব্য করেন। বলেছেন, ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ করছে ইউক্রেনের সেনারাই। তাদের সামরিক সদস্যরাই প্রতিটি হামলা পরিচালনা করছে। ইউক্রেন সরকারই তাদের লক্ষ্য ও নির্দেশনা আগে থেকে নির্ধারণ করে দেয়। অপরদিকে এই যুদ্ধকে ঘিরে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেকটাই আত্মরক্ষাগত। সীমানার লড়াই জোর করে জেতা সম্ভব নয়Ñ এটুকু বুঝেই তারা নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থানে রেখেছে।’

অবশ্য অতীতেও যুক্তরাষ্ট্র অগোচরে বহু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত ১৯৮৬ সালে নিকারাগুয়ায় সানদিনিস্তা সরকারের আমলে প্রক্সি ওয়ার সংগঠিত করার দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে। এমনকি ১৯৮০-এর সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকা আফগান মুজাহিদদেরও যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। এও স্মরণে আছে, ওবামা প্রশাসনের সময় মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হটানোর ক্ষেত্রেও লিবিয়ান সশস্ত্র সংগঠনদের তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে, এই যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য শাপে বর হয়ে উঠেছে। কিয়েভের আক্রমণ থেকেই স্পষ্ট হয়েছে, রাশিয়ান সামরিক বাহিনী নিজেদের যথাযথভাবে সামলাতে পারছে না।

ফাঁস হওয়া পেন্টাগন নথি রাশিয়ার অনেক দুর্বলতাই প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও প্রচুর মূল্যবান তথ্য পেয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোও নানা সমস্যায় জর্জরিত। এ সময় ইউক্রেনকে দামি অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করার কাজটি জটিল। পশ্চিমা নেতারা বুঝে গেছেন, পুতিন যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন পর্যন্ত এই যুদ্ধের সুরাহা হবে না। অর্থাৎ সামনের পথ জটিল। রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতামূলক একটি সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের পথ আপাতত বন্ধ। তবে পশ্চিমা রাষ্ট্র রাশিয়ার পতন চায়, পুতিনের এই বক্তব্যের সঙ্গেও তারা একমত নন। বিগত কয়েক বছরে ইউক্রেনে মার্কিন সহযোগিতার মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা একটি পাল্টা আক্রমণেই অনেকটুকু সীমানা জয় করে নেবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ইউক্রেন ব্যর্থ হয়, তবে কী হবে? আপাতত সামনের লক্ষ্য নিয়েই মাথা ঘামানো শ্রেয়। সামনে যা আছে তা থেকে নজর হটালেই বিপদ। ক্যারেন ডেনইয়ং সাংবাদিক। ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর : আমিরুল আবেদিন

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন