নিউইয়র্ক     রবিবার, ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে আমরা যেন তুরস্কের মত এক ভয়াবহ পরিণতির অপেক্ষায়

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১:১১ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৩ | ১১:১৬ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশে আমরা যেন তুরস্কের মত এক ভয়াবহ পরিণতির অপেক্ষায়

এম আবুল কালাম আজাদ: লাগামহীন দুর্নীতি, অনিয়মকে বৈধতা, ক্ষমতার মোহ আর জবাবদিহি না থাকলে পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তুরস্কে-সিরিয়ার ভুমিকম্প সেটা আরেকবার জানিয়ে দিলো৷ আলাপটা শুরু করা যাক তুরস্ক থেকে৷ ১৯৯৯ সালে ইস্তাম্বুলের নিকটে ভূমিকম্পে ১৭ হাজার মানুষ মারা গেলে তখনকার সরকার ভবন নির্মাণে কঠোর নিয়ম মেনে চলা ছাড়াও ‘ভূমিকম্প কর’ চালুর ঘোষণা দেয়৷ ভবিষ্যতে ভুমিকম্পের ভয়াবহতা রোধে দেশকে প্রস্তুত করার কাজে করের অর্থ ব্যবহার করা হবে বলে আশ্বাস প্রদান করে৷ ঐ ভূমিকম্পের পর উদ্ধার কাজে সরকারের ধীর তৎপরতা ও প্রতিশ্রুতিপূরণে ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে এরদোগানের দল ২০০২ সালে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়৷ ক্ষমতায় বসে সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশ্বাসও দেন এরদোগান৷

এরদোগানও কাজের কাজ কিছুই করেনি৷ ২০১১ সালে আরেকটি ভূমিকম্পে কয়েকশ মানুষ মারা গেলে নিম্নমানের নির্মাণ ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য অন্যদের দোষারোপ করেন৷ পরবর্তীতে তিনি উল্টো পথে হেঁটেছেন৷ ভবন নির্মাণে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নীতিমালা না মানার জন্য সেগুলো ভেঙ্গে ফেলা বা সংস্কারের পদক্ষেপ না নিয়ে বরং তার সরকার জরিমানা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হাজার হাজার ভবনকে বৈধতা প্রদান করেন৷ এমন সিদ্ধান্তের পর এক বিশেষজ্ঞ ২০১৯ সালে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘এর মানে হচ্ছে শহরগুলোকে কবরস্থানে পরিণত করা৷’

তিন বছরের মধ্যে ঐ বিশেষজ্ঞের কথা ফলে গেলো৷ তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে তুরস্কের শত শত ভবন৷ অনেক শহর পরিণত হয় মৃত্যুর নগরীতে৷ এতো ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানীর জন্য মূলত দায়ী এরদোগান ও তার ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বহীনতা, দুর্নীতি, বিধিবিধান না মানা ও প্রস্তুতির অভাবকে৷ বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুরস্কের চেয়ে ভিন্ন নয়, অনেক বাস্তবতা তার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে৷ বড় কোনো ভূমিকম্প না হলেও রানা প্লাজা ও নিমতলির বিস্ফোরণ থেকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা টের পেয়েছি আমরা৷ উদ্ধারকাজে আমরা কতটা অপ্রস্তুত ও এক্ষেত্রে কি ধরনের চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হয় তা আর অজানা নয়৷

ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকায় অবৈধ বা ক্রুতিপূর্ণ ভবনের অভাব নাই৷ আছে অনুমোদনহীন ভবনও৷ আবার অনেক ভবন আট বা ১০ তলা কিন্তু বাস্তবে সেগুলোর অনুমোদন রয়েছে চার বা ছয় তলা৷ জলাশয় ভরাট করে বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে নির্মিত হয়েছে অনেক ভবন৷ অধিকাংশ ভবনগুলো একটার সাথে আরেকটা যেন লেগে আছে৷ শুধু ঢাকা না, চট্টগ্রাম, সিলেট ও অন্যান্য শহরের চিত্র অনেকটা একই৷ ইমারত নির্মাণ আইন ও বিধিমালা থাকলেও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তা যথাযথভাবে মেনে না চলা হয় না৷ এক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষের গাফিলতি সুপরিচিত৷ মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও নিয়মিত তদারকির অভাবে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে৷ বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, দেশের শহরাঞ্চলের নির্মাণ করা ৬০ শতাংশ ভবনই তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে৷

সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির এক রিপোর্ট অনুসারে, শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৮৩ শতাংশ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৯২ শতাংশ এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ এসব নগরে পুরোপুরি ভেঙে পড়া ভবনের সংখ্যা হবে যথাক্রমে ২ লাখ ৩৮ হাজার, ১ লাখ ৪২ হাজার এবং ৫০ হাজার৷ এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশে তুরস্কের মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর পরিস্থিতি কি হবে তা অকল্পনীয়৷

এই অঞ্চলে গত ১০০ বছরে বড় কোনো ভূমিকম্প না হওয়ায় ছোট কম্পনগুলো শক্তি সঞ্চয় করে সামনে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে৷ ভূমিকম্প হলে কি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে সে বিষয়ে অনেক বছর ধরে বিশেষজ্ঞগণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো সতর্ক করে আসলেও সরকারের টনক নড়ছে না৷ একদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা বা সংস্কার করা হয়নি, অন্যদিকে নিয়ম ভঙ্গ করে ভবন নির্মাণ চলছে ৷ অন্যদিকে, ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমানো বা উদ্ধার তৎপরতার প্রস্তুতির কোনো অগ্রগতি নেই৷

ঢাকায় সাতের বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন তো ধ্বংস হবেই, সেই সঙ্গে নিয়ম না মেনে বা জলাশয় ভরাট করে তৈরি নতুন ভবনও ধসে পড়বে৷ এ অবস্থায় ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষকে উদ্ধার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ভূমিকম্প-পরবর্তী পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলা নিয়ে কেমন অসহনীয় একটা পরিস্থিতি হবে, তা অনুমান করাও যেন কঠিন৷

ভূমিকম্প এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেটি প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ কিন্তু আগে থেকে সতর্কতা ও প্রস্তুতি থাকলে এর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান কমিয়ে আনা সম্ভব৷ আমারা কতটা প্রস্তুত ভবন ধস ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একাধিকবার মনে করিয়ে দিয়েছে৷ এসব ঘটনায় তদন্ত হয়েছে, অনেক সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি৷ একটি ঘটনা ঘটলে এসব আলোচনায় আসে, কিছুদিন পর সকলেই ভুলে যায়৷ আমরা কি তাহলে তুরস্কের মত ভয়াবহ পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছি না? এরদোগানের মত আমরাও কি দুর্নীতি, অনিয়মকে প্রশ্রয় দিবো এবং সবকিছুর জন্য ভূমিকম্পের তীব্রতাকে দায়ী করবো? – সুত্ জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে

শেয়ার করুন