নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশেও বাড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০২:২৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০২:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশেও বাড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার

বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার৷ এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন তরুণ উদ্যোক্তারা৷ বেসরকারি খাতে এর ব্যবহার বেশি হলেও সরকারি খাতও আধুনিক এ প্রযুক্তি থেকে দূরে নেই৷ বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন আপারেটর, ব্যাংক, অনলাইন ও কৃষিখাতসহ অনেক খাতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন৷ আর এর গ্রাহকও বাড়ছে৷ তারা দেশের বাইরেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন লার্নিং টুলস রপ্তানি করছেন৷ ‘ইন্টেলিজেন্ট মেশিনস লিমিটেড’-এর সিইও মো. অলি আহাদ৷ তিনি জানান, এ মুহূর্তে তারা প্রায় ৪০ জনের একটি টিম৷ তারা এখন নানা ক্ষেত্রে লার্নিং মেশিন টুলস দিচ্ছেন৷ তার সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার দুই ক্ষেত্রেই কাজ করছেন৷

তিনি জানান, ‘‘এআই যেকোনো বিষয়ে অনেক দ্রুত এবং সঠিক পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত জানাতে পারে৷ সাধারণ সফওয়্যার তার প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করে৷ কিন্তু এআই ডাটার ভিত্তিতে নিজেই সিদ্ধান্ত জানায়৷ হাজার হাজার ডাটা প্রসেস করে অনেক মানুষ অনেক সময় নিয়ে যে সিদ্ধান্ত দিতে পারে, এআই তা খুব অল্প সময়ে এবং অনেক বেশি সঠিকভাবে করতে পারে৷’’

তার কথা, ‘‘আমরা যে-কোনো সেক্টরের জন্য কাজ করি৷ তবে ২০১৮ সালে বিকাশ দিয়ে আমাদের কাজ শুরু হয়৷ তাদের মার্কেটিং সিস্টেমকে আমরা এআই দিয়ে ডেভেলপ করি৷ অনেক কম জনবল দিয়ে তাদের মার্কেটিংকে আরো কার্যকর এবং দক্ষ করার ব্যবস্থা করি৷ কোনো সিস্টেম-লসও নাই৷ তখন তাদের এক লাখ ১৫ হাজার আউটলেটের জন্য মার্চেন্ডাইজার ছিল ৮২৪ জন৷ এখন পাঁচ লাখ ২৪ হাজারের চেয়ে বেশি অ্যাক্টিভ আউটলেটের জন্য মার্চেন্ডাইজার এক হাজার ১৪০ জন৷ তাদের বেতনও বেড়েছে৷ সাত হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে৷ এআই বেতনের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত দেয়৷ হিউম্যান সুপারভাইজারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এআই সহায়তা করছে৷ কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সে ভুলটা বলে দিচ্ছে, সঠিকটাও জানিয়ে দিচ্ছে৷ এর জন্য তার প্রয়োজন হয় সঠিক ডাটা৷ আমাদের এখানে এখন সঠিক ডাটা পাওয়াই প্রধান চ্যালেঞ্জ৷’’

তিনি জানান, তারা কয়েকটি ব্যাংককেও সার্ভিস দিচ্ছেন৷ কোনো গ্রাহক ঋণ চাইলে তার তথ্য দিয়ে এআই তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়৷ ব্যক্তির ক্ষেত্রে হয়ত তথ্য কম৷ কিন্তু কোনো কর্পোরেট গ্রাহক হলে তার ডাটা হতে পারে কয়েক হাজার পৃষ্ঠা৷ সেটা বিশ্লেষণ করা হিউম্যানলি অনেক সময়সাপেক্ষ৷ কিন্তু এআই তা খুব অল্প সময়ে করে দিচ্ছে৷ আর তার অ্যাকিউরেসি অনেক হাই৷ তিনি বলেন, ‘‘মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান আমাদের ক্লায়েন্ট৷ বাংলাদেশে পাঁচ এবং বিদেশে পাঁচ৷ ইউএসএ, অষ্ট্রেলিয়া এবং মিয়ানমারে আমারা কাজ করছি এখান থেকে৷ বাংলাদেশের পাঁচটির মধ্যে চারটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং একটি বহুজাতিক কোম্পানি৷’’

কৃষি ও শিল্প খাতে ব্যবহার : কৃষিখাতেও এআই’র ব্যবহার শুরু হয়েছে৷ বিএডিসি ব্যবহার করছে৷ হিমাগারে ব্যবহার করা হচ্ছে, বিভিন্ন শিল্প কারখানায়ও ব্যবহার শুরু হয়েছে৷ তরুণ উদ্যোক্তা পরাগ ওবায়েদের নেতৃত্বে একাধিক এআই প্রতিষ্ঠান কাজ করছে৷ তাদের পুরো কাজটিই মেশিন লার্নিং৷ তারা টেলকো এবং কৃষি খাতে কাজ করছেন৷ তারা সফওয়ার এবং হার্ডওয়্যার- দুইটি নিয়েই মেশিন লার্নিয়ের কাজ করেন৷ তিনি জানান, ‘‘আমরা পানি, মাটি, কৃষি ও কৃষকের ব্যাপারে এআই ব্যবহার করে সঠিক উৎপাদন চাষ-পদ্ধতির ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত দিচ্ছি৷ বিএডিসির সোলার পাম্পে আমরা মেসিন লার্নিং ডিভাইস বসিয়ে ডাটা নিয়ে পাম্পের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করছি৷ সঠিক সময়ে কতটুকু জলসেচ দরকার এইসব সিদ্ধান্ত দিচ্ছে এআই৷’’

তিনি জানান, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহায়তা নেয়ার বাইরেও যে প্রতিষ্ঠানের দরকার তারাও এখন নিজেরাই এআই ডেভেলপ করছে৷ আইওটি ডিভাইস বাংলাদেশেই : ‘অ্যাকুয়ালিংক’-এর সিইও সৈয়দ রিজওয়ান বলেন, ‘‘আমরা কোয়ালিটি মনিটরের এআই নিয়ে কাজ করি৷ সেটা যেকোনো প্রডাক্ট হতে পরে৷ মাটি, পানি হতে পারে৷ আমরা একটি আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংকিং) ডিভাইস তৈরি করেছি, যার নাম সেন্সোমিটার৷ এই ডিভাইস দিয়ে এটা করা যায়৷ এটা রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে একটি কারখানার পরিবেশ, বাতাসের আর্দ্রতা সব কিছুই দেখতে পারে৷ পানির মান দেখতে পারে৷ এটা কোল্ড স্টোরেজেও ব্যবহৃত হচ্ছে৷’’

তিনি জানান, তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বীজের জন্য একটি গ্রিন হাউজ করে দিয়েছেন, যেটা তাদের ডিভাইস দিয়ে নিয়ন্ত্রণ এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা হয়৷ সেখানে টেম্পারেচারসহ সব কিছু ডিভাইস সয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ৷ তিনি বলেন, ‘‘এআই মাটির গুণাগুণ রিসার্চ করে বলে দেবে কোন ধরনের ফসল ওই মাটিতে চাষ করা উচিত৷ কিন্তু সমস্যা হলো, পর্যাপ্ত ডাটা আমাদের এখানে নেই৷ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেল পমেন্টে (আরএনডি) এটাই প্রধান বাধা এখন৷’’

তার কথা, ‘‘এটার জন্য খুব অর্থের প্রয়োজন হয় না৷ প্রয়োজন হয় দক্ষতা এবং সব সময় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার দক্ষতা৷ আমরা এখন তেমন লাভ করতে পারছি না৷ লোকসানেও নেই৷ তবে চাহিদা বাড়ছে৷ মানুষ জানছে৷ গ্রাহক বাড়ছে৷ মার্কেট বড় হবে৷’’ তিনি জানান, তরুণদের যারা এআই নিয়ে কাজ করছে, তাদের অধিকাংশই বেসিসের অধীনে কাজ করছে৷

নেতৃত্বে তারুণ্য : জেমস বন্ড এবং আইনস্টাইনের নাম মিলিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম বন্ডস্টেইন টেকনোলজিস লিমিটেড৷ এর কো-ফাউন্ডার শাহরুখ ইসলাম জানান, তারা এআই এবং আইওটি দুটি নিয়েই কাজ করছেন৷ বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে তাদের ক্লায়েন্ট বেশি৷ তারা কৃষিখাতেও কাজ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘শিল্প কারখানা তাদের অপচয় কমাতে চায়৷ মেশিনের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে চায়, ব্যয় কমাতে চায় দক্ষ ম্যানেজন্টের মাধ্যমে৷ পরিবেশ বান্ধব হতে চায়৷ এইসব আমরা করে দিচ্ছি এআই এবং আইওটির মাধ্যমে৷’’ তার কথা, ‘‘প্রতিদিনই ক্লায়েন্ট বাড়ছে৷ অনেকে জানেন না৷ যখন জানছেন তখন আগ্রহ দেখাচ্ছেন৷ আমাদের কোনো প্রচার বা বিজ্ঞাপন নেই৷ কাজের মধ্য দিয়েই চাহিদা বাড়ছে৷’’

বাংলাদেশে এখন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান হয়েছে৷ নতুন প্রতিষ্ঠানও আসছে৷ তরুণরাই এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে সব দপ্তরকে টেকনোলজি ব্যবহারের জোর দিতে হবে৷ এটা আমাদের সহায়তা করছে৷’’ বিতর্ক আছে এআই এবং আইওটি মানুষকে বেকার করবে কিনা৷ তারা মানুষের জায়গা দখল করবে কিনা এমন প্রশ্নও করেন অনেকে৷

এর জবাবে শাহরুখ ইসলাম বলেন, ‘‘১৮ কোটি মানুষের এই দেশে সব কিছু ম্যানুয়ালি করা সম্ভব নয়৷ আমাদের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করতেই হবে৷ আসলে এর ব্যবহার অপচয় কমাবে৷ সঠিক উপায়ে কাজ করা নিশ্চিত করবে৷ ফলে নতুন ধরনের কর্মসংস্থান হবে৷ উৎপাদন বাড়বে৷’’

আর অলি আহাদ বলেন, ‘‘এটা শিক্ষা, সাংবাদিকতা সব ক্ষেত্রেই কাজে লাগছে৷ একটি ছেলে কোন বিষয়ে ভালো করবে তা-ও এআই বলে দিচ্ছে৷ কিন্তু এটা তো মানুষেরই সৃষ্টি- এটা মনে রাখতে হবে৷ সে কখনো মানুষকে বিদায় করতে পারবে না৷’’ বেসিস ছাড়াও বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, সরকারের এটুআই প্রকল্পসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান এআই এবং আইওটি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহ ও সহায়তা দিচ্ছে৷

চীনা রোবটের প্রোগ্রামিং : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এক সময় বেসিসের সভাপতি ছিলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘তরুণরা এই সময়ে অনেক কিছু পাল্টে দিচ্ছে৷ তারা এআই এবং আইওটি নিয়ে কাজ করছে৷ তাদের প্রয়োজন সহযোগিতা৷ সহযোগিতা, মানে তাদের অর্থ ঢেলে দিতে হবে তা নয়, তাদের কাজের পরিবেশটা দিতে হবে৷ আমরা সেটা দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশকে নিয়ে যে উদ্ভট ধারণা নিয়ে মানুষ চলতো, আমি মনে করি ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত সেই ধারণার উল্টোটা হচ্ছে৷ আমাদের এখানাকার ছেলে-মেয়েরা যত নতুন প্রযুক্তি আছে, তার প্রত্যেকটি নিয়ে কাজ করছে৷ আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ মেলায় চীনা কোম্পানি যে রোবট এনেছে তার প্রোগ্রামিং করেছে বাংলাদেশের তরুণরা৷ আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর এই প্রযুক্তিতে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য যা যা করা দরকার তা-ই করেছেন৷’’ তার কথা, ‘‘এর চাহিদা বাড়ছে৷ এটা এখন দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে৷’’

এই প্রযুক্তি মানুষের বিকল্প হবে এমন আশঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন অনেকে বলছেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা৷ আমরা বলি পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের কথা৷ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমি বিশ্বাস করি না৷ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা হলো মানুষকে যন্ত্র দিয়ে রিপ্লেস করা৷ আর পঞ্চম শিল্প বিপ্লব হলো যন্ত্রকে মানুষের করায়ত্ব করা৷ আমরা মনে করি, মানুষ যন্ত্র বানাবে, নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেই যন্ত্র মানুষের জন্যই কাজ করবে৷’’-হারুন উর রশীদ স্বপন , জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে

শেয়ার করুন