নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আসিফ নজরুল

দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত ব্যক্তিত্বের বিদায়

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:৩৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ | ০১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত ব্যক্তিত্বের বিদায়

জাফরুল্লাহ ভাইয়ের জিপটা চালাতেন একজন নারী। চার দশক আগে ব্যাপারটা চোখে পড়ত খুব। নারীরা তখনও অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগ তো বটেই, রাজনীতি কিংবা শ্রমবাজারেও তাঁদের প্রাধান্য তখনও সুদূর কল্পনার বিষয়। আমি উঠতি তরুণ, এটা দেখে চমৎকৃত হতাম। কিন্তু এর মধ্যেই যে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনদর্শনের একটা ঘোষণা আছে; তা বুঝতাম না।

কয়েক বছর পর তাঁকে যখন বিচিত্রা অফিসে দেখতাম, মনে হতো, হলিউড ছবির কোনো মাচো (পুরুষালি) নায়ক কিংবা এর চেয়েও বেশি কিছু। ঝাঁকড়া চুলে গমগম করে কথা বলতেন; ঝকঝকে চোখে এক পলকে অনেক কিছু দেখে নিতেন। তাঁকে দেখে মনে হতো পৃথিবীর যে কোনো অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ়তায় ভরপুর একজন মানুষ। মনে হতো, এক মানুষের ভেতর অনেক মানুষের জীবনীশক্তি নিয়ে টগবগ করে ফুটছেন তিনি।

তিনি আসলেই সে রকম একজন অবিশ্বাস্য মানুষ। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আগরতলার মেলাঘরে কিংবা হয়তো তারও আগে থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব। সেক্টর-২ এর আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নিয়মিত আগমন ছিল বিচিত্রা অফিসে। নাসির উদ্দীন ইউসুফ, হাবিবুল আলম, শহীদুল্লাহ খান বাদল, নায়লা জামান, মেজর আখতার– তাঁদের নিয়মিত আড্ডার জায়গা ছিল বিচিত্রা সম্পাদকের ছোট্ট ঘরটি। তাঁরা শাহাদত চৌধুরীর ঘরে এলে মুক্তিযুদ্ধের গল্প জমে উঠত। তাঁরা না এলেও পত্রিকা অফিসে লেখার জন্য তখন যে নিউজপ্রিন্ট প্যাড ছিল; পরিপাটি করে তা ছিঁড়তে ছিঁড়তে শাহাদত চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের গল্প করতেন। তাঁর উত্তেজনা, উল্লাস; আবার কখনও সজল হয়ে আসা চোখে আমরা দেখতাম মুক্তিযুদ্ধের বহু হিরণ্ময় গল্প। সেখানে সিংহভাগ জুড়ে থাকতেন খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার, তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হাবিলদার বেলায়েত (হাবিলদার বেলায়েত পরে নায়েব সুবেদার পদে উন্নীত হন। কুমিল্লার শালনা নদীর পাড়ে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে জয়ী হলেও ওই যুদ্ধের নায়ক বেলায়েত শত্রুর দূরবর্তী একটি এলএমজির ব্রাশফায়ারে শহীদ হন। শহীদ বেলায়েত পরে মরণোত্তর ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন) এবং জাফরুল্লাহ চৌধুরীদের কথা। তাঁদের মধ্যে প্রথমোক্তদের কোনোদিন দেখার সুযোগ হয়নি আমাদের। শেষোক্তদের দেখার সুযোগ হতো নিয়মিত। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছাড়া আর সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও ছিল আমার। তাঁর সঙ্গে কেন যেন এক-তালে কথা বলতে পারতাম না। মনে হতো, তিনি আমার বোঝার ক্ষমতার চেয়ে অনেক বিশাল কোনো মানুষ। মনে হতো বুদ্ধিমত্তা, জীবনবোধ, কর্মচাঞ্চল্য, দেশপ্রেমে তিনি অচেনা দিগন্ত পর্যন্ত প্রসারিত একজন মানুষ।

১৯৮৮ সালে তাঁর ধানমন্ডির অফিসে আমাকে নিয়ে যান শাহাদত চৌধুরী। বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রসারে দক্ষ এপিকিউটিভের অভাব অনুভব করতেন তাঁরা। শাহাদত চৌধুরীর ইচ্ছা, এ বিষয়ের ওপর যেন আমি বিচিত্রায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন লিখি। ব্যবসা-বাণিজ্য আমার দু’চোখের বিষ। কিন্তু সম্পাদকের ধারণা, পৃথিবীর যে কোনো বিষয়ের মতো এটার ওপরেও প্রতিবেদন তৈরির ক্ষমতা আছে আমার। বিষয়টা ভালো করে যাতে বুঝতে পারি, এ জন্য অনিচ্ছুক আমাকে তিনি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য অফিসে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে এলেন শহীদুল্লাহ খান বাদলও। তাঁরা তিন বন্ধু মিলে কী কী যেন বললেন। অন্যদের ছাপিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথাই বেশি শুনলাম। শাহাদত চৌধুরী বারবার চমৎকৃত হয়ে আমার দিকে তাকালেন। যে তাকানোর মানে হচ্ছে, ‘এসব শুনে তাক লেগে যাচ্ছে কিনা তোমার’ ধরনের। আমার তাক লাগল না; প্রায় কিছুই বুঝলাম না। তবে একটা জিনিস ভালো করে বুঝলাম। সেটা হচ্ছে পৃথিবীর সবাইকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আছে শাহাদত চৌধুরীর। আর তাঁকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা ছিল একজনেরই। তিনি জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, আইনের শাসনসহ যে কোনো নাগরিক আন্দোলনে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সহধর্মিণী শিরীন হক মাঝে মাঝে আফসোস করতেন। বলতেন, ঘরে বসে থাকলে সে বেঁচে থাকতে পারত না। যতদিন কাজ ততদিনই তার আয়ু। বাস্তবেই তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত কর্মমুখর সময় কাটিয়ে গেলেন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেমন মানুষ ছিলেন, শুধু এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা থেকে বলি। এক দিন ফোন করে ভাসানী মঞ্চের নেতা বাবলু ভাই বললেন, আদানির সঙ্গে দেশবিরোধী বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে প্রোগ্রাম হবে প্রেস ক্লাবের সামনে; আমাকে থাকতে হবে। সেই শুক্রবার আমার অনেক কাজ, একটু গাঁইগুঁই করলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমি কিন্তু ভাইয়ের সামনে (জাফরুল্লাহ চৌধুরী)। উনি বলছেন আপনাকে থাকতে; দিব উনাকে? ১ সেকেন্ড ভাবি। তাঁর সঙ্গে কথা বললে কী বলব আমি? উপন্যাস লেখায় ব্যস্ত? বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার প্রোগ্রাম আছে? বিদেশে যাব দেখে একটা পেপার লিখছি? তাঁকে এসব বলার সাহস হবে আমার? হবে না। তাঁর কাছে দেশের প্রয়োজন বড়; বাদবাকি সব তুচ্ছ। কাজেই আমি বলে উঠলাম, না না; ঠিক আছে। যাব আমি, যাব!

এই তো কিছুদিন আগে, তিনি নিজেই ফোন করেছিলেন : আসিফ, ইউনূস ভাইয়ের ব্যাপারে তো কিছু করতে হয়। জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ফজলে হাসান আবেদ ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশে তিনটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। নিজেরাও সারাবিশ্বে সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু ঈর্ষা তো দূরের কথা, জাফরুল্লাহ ভাই ও আবেদ ভাই দু’জনকেই দেখতাম ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব ও অতুলনীয় সম্মানের আসনে রয়েছেন– এটা তাঁরা বরং উপভোগ করতেন, ভালোবাসতেন।

ইউনূস স্যার নোবেল পাওয়ার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেকে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি সবাইকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছিলাম। তৎকালীন বাংলাদেশ-চীন সম্মেলন কেন্দ্রে বসার আসন নিয়ে সুশীল সমাজের মাথাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও মান-অভিমানও দেখেছিলাম। এদের কেউ কেউ বর্তমান সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলছেন এখন। বাকি প্রায় সবাই ক্ষমতাসীনদের রোষে পড়ার আশঙ্কায় নিজেদের রেখেছেন নিরাপদ দূরত্বে। একমাত্র ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং অল্প কয়েকজন বুক চিতিয়ে ছিলেন ড. ইউনূসের সত্যিকারের মূল্যায়নের সাহস দেখাতে, এটা বলতে যে তাঁর সঙ্গে যা করা হচ্ছে তা অন্যায় এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর।

আমি এ রকম বহু গল্প বলতে পারি জাফরুল্লাহ ভাইকে নিয়ে। এসব গল্প দেশপ্রেম ও সৎসাহসের। সারাটা জীবন তিনি নিজেকে উৎসর্গিত রেখেছিলেন দেশের মানুষ আর দেশের বিকাশের জন্য। বিলেতে আনন্দময় শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে আগরতলার মেলাঘরে এসে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন। যুদ্ধক্ষেত্রের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন। গণস্বাস্থ্য নামক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কম খরচে স্বাস্থ্যসেবার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ঔষধনীতি প্রণয়নে নেতৃত্ব দিয়ে দেশে রপ্তানিমুখী ওষুধ শিল্পের ভিত গড়ে দিয়েছেন। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করায় তাঁর উদ্ভাবিত মডেল বহু দেশ গ্রহণ করেছে। আরও বহু কিছু করে গেছেন তিনি। কিন্তু আমরা যারা ঘনিষ্ঠভাবে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়েছি, তাঁদের অনেকের কাছে মনে হয়, তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি দেশটাকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন। তিনি, ফজলে হাসান আবেদ, ড. ইউনূস– প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিদেশে রাজার হালে দিন কাটাতে পারতেন। কিন্তু সব কাঁটা ধন্য করে তাঁরা দেশে থেকেছেন। দেশের জন্য অমূল্য প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। লাখ লাখ তরুণের স্বপ্ন নির্মাণ করেছেন। আর যাঁদের শাসনামলে এ দেশ থেকে লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়েছে; হাজার হাজার জীবন আর স্বপ্ন নিঃশেষ হয়েছে; যাঁরা তাঁদের নিজের পরিবার-সন্তানকে রেখেছেন বিদেশের বিত্ত-বৈভবে; এদেশের সেই শাসকগোষ্ঠী বারবার বিভিন্নভাবে আক্রমণ করেছে এসব মানুষকে। কিন্তু তাঁরা অন্তত জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দমাতে পারেননি এক বিন্দুও। মামলা-হামলা-অপবাদ কোনোকিছু দিয়েই না।

এই মানুষদের জীবনসংগ্রাম আর দর্শনকে উপলব্ধি করতে হবে আমাদের। আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে এদেশের এই সোনার সন্তানদের অর্জন, অবদান ও আত্মত্যাগের কথা। জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিঃসন্দেহে সেই দীপ্তিমান সোনার সন্তানদের একজন। ধন্য আমরা, তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে। তাঁর শূন্যস্থান সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আসিফ নজরুল: কথাসাহিত্যিক; অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে।

সাথী / পরিচয়

শেয়ার করুন