নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবুল বারাকাত

দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা : অশোভন সমাজের গোড়ার কথা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ১১:৫৭ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৩ | ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা : অশোভন সমাজের গোড়ার কথা

কভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত হওয়ার আগের চার দশকে বাংলাদেশে একদিকে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা ছিল ক্রমবর্ধমান আর অন্যদিকে কিছু মানুষের হাতে অঢেল সম্পদ-সম্পত্তি পুঞ্জীভূত হয়েছে—এ সম্পর্কে আমরা এরই মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণপূর্বক বলেছি, বিষয়টি দুর্ভাবনার—বড়ই দুর্ভাবনার। দারিদ্র্যর বহুরূপ-বহুমুখ আমরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছি।

বহুমুখী এসব দারিদ্র্যর মধ্যে আছে আয়ের দারিদ্র্য, ক্ষুধার দারিদ্র্য, কর্মহীনতার দারিদ্র্য, স্বল্প মজুরির দারিদ্র্য, আবাসনের দারিদ্র্য, শিক্ষার দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যের দারিদ্র্য, অস্বচ্ছতা-উদ্ভূত দারিদ্র্য, শিশু দারিদ্র্য, প্রবীণ মানুষের দারিদ্র্য, নারীপ্রধান খানার দারিদ্র্য, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের দারিদ্র্য, ভাসমান মানুষের দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধী মানুষের দারিদ্র্য, ‘মঙ্গা’ এলাকার মানুষের দারিদ্র্য, বহিঃস্থ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য, বস্তিবাসী ও স্বল্প আয়ের মানুষের দারিদ্র্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপর্যয়ের দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা-উদ্ভূত দারিদ্র্য, প্রান্তিকতা থেকে উদ্ভূত দারিদ্র্য (অনানুষ্ঠানিক সেক্টর, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, আদিবাসী মানুষ, নিম্নবর্ণ-দলিত, ‘পশ্চাৎপদ’ পেশা, চর-হাওর-বাঁওড়ের মানুষ), রাজনৈতিক দারিদ্র্য (রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ না করতে পারার কারণে দারিদ্র্য), রাষ্ট্র-সরকার পরিচালনাকারীদের প্রতি আস্থাহীনতা-উদ্ভূত দারিদ্র্য, মানসকাঠামোর (mind set) দারিদ্র্য।

আমরা এও দেখেছি যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বৈষম্য হ্রাসকারী উন্নয়ন দর্শনের বিপরীতে সংবিধানবিরোধী নব্য-উদারবাদী মুক্তবাজার ‘উন্নয়ন’ দর্শন গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশ উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেছে—যে পথে দারিদ্র্য বেড়েছে, বেড়েছে বৈষম্য-অসমতা, সমাজে ধনী-দরিদ্র মেরূকরণ ক্রমাগত বেড়েছে, অর্থনীতি ও রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে, অর্থ-ক্ষমতার জোরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছে ক্ষুদ্র এক স্বার্থগোষ্ঠী—যারা নিজেরা কোনো সম্পদ সৃষ্টি করে না, যারা অন্যের সৃষ্ট সম্পদ দখল-বেদখল-জবরদখল-আত্মসাৎ করে—অর্থাৎ লুটেরা ধনী বা রেন্ট-সিকার গোষ্ঠী। এসবের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রটাও জ্ঞানগত সাম্প্রদায়িকীকৃত হয়েছে।

আমাদের দেশে কভিড-১৯-এর আগের চার দশকেই উল্লিখিত স্বজনতুষ্টিবাদী-আগ্রাসী-চৌর্যতান্ত্রিক-রেন্টসিকিং গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে, যা অন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার চালিকাশক্তি আর্থিকীকরণকৃত পুঁজিবাদের অধীনস্থ ব্যবস্থামাত্র। এ ব্যবস্থাটাই আমাদের দেশে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে চলেছে।

এ ব্যবস্থা সুচারুরূপে পরিচালনে রেন্ট-সিকাররা বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি-পন্থা অবলম্বন করে, যার মধ্যে অন্যতম হলো নিম্নরূপ:

(১) রাষ্ট্রীয় সম্পদ-সম্পত্তি কারও কাছে (রেন্ট-সিকারদের কাছে) কম দামে বিক্রি করে তাদেরই উৎপাদিত পণ্য বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে কেনা (privatization, divest and government procurement);

(২) সরকারি ক্রয়-নীতির আইনকানুন এমনভাবে ডিজাইন করা, যাতে ‘রেন্ট-সিকার’রা উপরি সুবিধা পেতে পারে;

(৩) নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক সম্পদে (জ্বালানি-গ্যাস-কয়লা ইত্যাদি) একচেটিয়া ব্যবসা করার সুবিধা প্রদান;

(৪) লুণ্ঠনমূলক মূল্য নির্ধারণে (predatory pricing) সহায়তা করা, যেখানে কোনো ফার্ম তার প্রতিযোগীদের বাজার থেকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে প্রথমে পণ্যের মূল্য কম রাখে। আর প্রতিযোগীরা উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে সুযোগ বুঝে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে বাজারে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাজার দখল করে; কিন্তু তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না;

(৫) সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধরনের কোটা প্রদান; কর-শুল্কসহ বাজারের বিভিন্ন আইন-কানুন, বিধি-বিধান এমনভাবে সাজানো ও প্রয়োগ করা, যাতে রেন্ট-সিকাররা উপরি পেতে পারেন (regulatory capture);

(৬) ব্যাংকিং খাতে প্রকল্প ঋণ থেকে শুরু করে এলটিআর (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে আমদানি অর্থায়ন), ক্যাশ ক্রেডিট, পিএডি (payment against document) সুবিধা, পুনঃতপশিলীকরণ, ঋণের অবলোপসহ খেলাপি ঋণসমূহে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে ‘রেন্টসিকিং’ উদ্বুদ্ধ করা, যেখানে ব্যবস্থাপকসহ শক্তিধর বোর্ড সদস্যরাও সুবিধা পেয়ে থাকেন;

(৭) আমদানি বাণিজ্যে ওভার ইনভয়েসিং আর রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং সুবিধা প্রদান;

(৮) বিভিন্ন সেক্টরে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রদান করে রেন্ট-সিকারদের আরও সম্পদশালী হওয়ার সুযোগ প্রদান; কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে উচ্চ অঙ্কের কমিশন প্রদান (ঘুষ-দুর্নীতির রূপ);

(৯) ধনীবান্ধব সরকারি ভর্তুকি ও প্রণোদনা—কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই;

(১০) বাজেটে ধনীবান্ধব কর-শুল্ক হার নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়ন এবং পরবর্তী পর্যায়ে এসআরও (statutory requirements order) জারি করে রেন্ট-সিকারদের পক্ষে আরও বেশি সুবিধা প্রদান;

(১১) বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণে অযথা ও অযৌক্তিক মধ্যস্বত্বভোগী সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদান;

(১২) পণ্যের বেআইনি মজুত;

(১৩) পুঁজিবাজারে অস্বচ্ছ ও তথ্য গোপনের খেলা; সমরাস্ত্র ক্রয়ে অস্বচ্ছতা;

(১৪) বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থায় সংশ্লিষ্ট রেন্টসিকিং গোষ্ঠীর স্বার্থবাহী ব্যক্তিদের নিয়োগ;

(১৫) গণমাধ্যম ও টেলিকম সংস্থাসমূহকে এমনভাবে সাজানো, যা রেন্ট-সিকারদের স্বার্থের অনুকূল হয় ইত্যাদি।

উপরে যা বললাম তার সারার্থ হলো—একচেটিয়া বাজার ও দৃশ্যমান বাজার ব্যবস্থাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে সরাসরি ‘রেন্ট-সিকার’দের স্বার্থেই সরকার ও রাজনীতি প্রভাবকের ভূমিকা পালনে বাধ্য। এসবই হলো উঁচুতলার কয়েকজনের কাছে নিচুতলার মানুষের সম্পদ-সম্পত্তি নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেওয়ার কয়েকটি পথ-পদ্ধতি।

এ তো গেল কভিড-১৯-পূর্ব চার দশকে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতার কথকতা। কভিড-১৯ এসবে নতুন মাত্রা যোগ করে অবস্থার চরম অবনতি ঘটিয়েছে। আমরা এ সম্পর্কে সবিস্তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ স্পষ্ট দেখিয়েছি যে, কভিড-১৯ মহামারির মহাবিপর্যয় আমাদের দেশের শ্রেণিকাঠামোকে পাল্টে দিয়েছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে লকডাউনের মাত্র ৬৬ দিনে (২৬ মার্চ-৩১ মে ২০২০) বিশাল এক ‘নব-দরিদ্র’ গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে—লকডাউনের আগে দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ, যা লকডাউনের মাত্র ৬৬ দিনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৬ কোটি ৮০ লাখ। ব্যাপকসংখ্যক মানুষ খুবই দ্রুত সময়ে, মাত্র ৬৬ দিনের মধ্যে (২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে ২০২০) শ্রেণি মইয়ের (class ladder) তলার দিকে নামতে বাধ্য হয়েছেন, হচ্ছেন। কভিড-১৯ মহামারি এবং তৎ-উদ্ভূত লকডাউনের ফলে বিদ্যমান আয় বৈষম্য, ধন-সম্পদ বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য ও শিক্ষা বৈষম্য প্রকটতর হয়ে অতিমাত্রায় বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এ এক অশনিসংকেত প্রচণ্ড ঝড়ের পূর্বাভাসমাত্র (অবশ্য প্রশ্ন ‘অশনিসংকেত’ কার জন্য?)। এ অবস্থা থেকে ঘুরে না দাঁড়াতে পারলে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিপর্যয় অনিবার্য (অবশ্য ‘বিপর্যয়’ কার–সেটাও একটা প্রশ্ন)। দেশে দারিদ্র্য-বৈষম্য-অসমতার ক্রমাবনতি এবং কভিড-১৯ উদ্ভূত লকডাউনের অভিঘাত বিশ্লেষণে আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটসহ ভবিষ্যতের সব উন্নয়ন দর্শন-দলিলে অন্তর্ভুক্তি এবং তা বাস্তবায়নে আমাদের প্রস্তাবসমূহ নিম্নরূপ :

দারিদ্র্য-বৈষম্য উচ্ছেদে অবশ্যকরণীয়

(১) শুধু আসন্ন ২০২০-২১ বাজেটই নয়, আগামী অন্তত পাঁচ বছরের বাজেট ও অন্যান্য পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নীতি-কৌশল দলিল প্রণয়নে যে বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের প্রধানতম ভিত্তি-নীতি (foundational principle) হিসেবে গ্রহণ করতে হবে তা হলো: সমাজ থেকে চার ধরনের বৈষম্য আয় বৈষম্য (income inequality), সম্পদ বৈষম্য (wealth inequality), স্বাস্থ্য বৈষম্য (health inequality) ও শিক্ষা বৈষম্য (education inequality) চিরতরে নির্মূল করা। এ লক্ষ্যে বাজেটের আয় খাত ও ব্যয় খাতে মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে।

(২) বাজেটে অর্থায়নের উৎস নির্ধারণে দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর কোনো ধরনের কর-দাসত্ব আরোপ করা যাবে না। ধনী-সম্পদশালীদের সম্পদ পুনর্বণ্টন করে তা শ্রেণি মইয়ের নিচের দিকে প্রবাহিত করতে হবে। এই কাজে প্রধানতম পথ-পদ্ধতি হবে: যথেষ্ট বেশি হারে সম্পদ কর (বা wealth tax) আরোপ, অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর আরোপ (tax on excess profit), পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার (money laundering), কালো টাকা উদ্ধার (black money)।

(৩) ধনীদের—সে যে-ই হোক না কেন, যে ব্যবসায়েরই হোক না কেন, যে শিল্পেরই হোক না কেন—নগদ অর্থে কোনো ধরনের প্রণোদনা (cash incentive) প্রদান করা যাবে না।

(৪) বাজেটে ব্যয়-বরাদ্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ‘বৈষম্য হ্রাসকারী উন্নয়নদর্শনের’ নিরিখে সেসব খাত-উপখাত-ক্ষেত্রকেই প্রাধান্য দিতে হবে, যা আপাতত বড় মাত্রায় বহুমুখী বৈষম্য হ্রাস করবে (পরে উচ্ছেদ করবে)—হ্রাস করবে আয় বৈষম্য, ধন বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য, শিক্ষা বৈষম্যসহ সব ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বৈষম্য-অসমতা।

(৫) বাজেটের ব্যয়-বরাদ্দে অগ্রাধিকার দিতে হবে অনানুষ্ঠানিক সেক্টরের প্রায় সব কর্মকাণ্ড (দেশের ৮৫ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ, যাদের সংখ্যা হবে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার শ্রমশক্তির মধ্যে সাড়ে ৫ কোটি, যার মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের অণু, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও শিল্প-কুটির শিল্প; কৃষি খাত শস্য ও শাকসবজি-প্রাণিসম্পদ-মৎস্যসম্পদ- জলজসম্পদ; স্বাস্থ্য খাতে জরুরি ভিত্তিতে ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠা; সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবেষ্টনী এবং শিক্ষা ও গবেষণা।

(৬) দারিদ্র্য-বৈষম্য উচ্ছেদে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্ধার-পুনরুদ্ধার (recovery) কর্মসূচিকে দেখতে হবে রোগের লক্ষণের চিকিৎসা হিসেবে (treatment of symptoms), যা আশু ও স্বল্পমেয়াদি; আর সংস্কারজাতীয় কর্মসূচিকে (reform) দেখতে হবে রোগমুক্তির স্থায়ী চিকিৎসা হিসেবে, যা দীর্ঘমেয়াদি এবং যথেষ্ট শ্রেণি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাঠামোগত বিষয়। রাষ্ট্রের সব উন্নয়নসংশ্লিষ্ট দলিলে এসব বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ পথ নির্দেশনা থাকতে হবে।

দারিদ্র্য ও বৈষম্যের ধরনভিত্তিক তথ্যভান্ডার

বহুমুখী দারিদ্র্য (multiple poverty) দূরীকরণে বিভিন্ন ধরনের দরিদ্র মানুষ নিয়ে জাতীয় তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা জরুরি। প্রস্তাবিত এই ‘দারিদ্র্যের তথ্যভান্ডার’-এ দারিদ্র্যর বিভিন্ন ধরনভিত্তিক দরিদ্র মানুষের নাম-ঠিকানাসহ অন্তর্ভুক্ত হতে হবে ক্ষুধার দারিদ্র্য, আয়ের দারিদ্র্য, আবাসনের দারিদ্র্য, বেকারত্ব-উদ্ভূত দারিদ্র্য, অসুস্থতা-উদ্ভূত দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব-উদ্ভূত দারিদ্র্য, সুপেয় পানির অভাব-উদ্ভূত দারিদ্র্য, নারীপ্রধান খানার দারিদ্র্য, অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের দারিদ্র্য, ভৌগোলিক অবস্থানজনিত দারিদ্র্য ইত্যাদি ।

দারিদ্র্যের বিস্তারিত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ করার লক্ষ্যে আসন্ন বাজেট বরাদ্দসহ সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন দলিলে সময়-নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা জরুরি।

ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য দূরীকরণ

(১) এ দেশে ক্রমবর্ধমান বহুমুখী দারিদ্র্য নিরসনে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ জরুরি ভিত্তিতে বাজেটসহ দারিদ্র্য বিমোচনসংক্রান্ত সব দলিলে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত:

(ক) বাজেটের ব্যয় বরাদ্দ কীভাবে এবং কোন সময়ের মধ্যে মানব বঞ্চনা, দুর্দশা ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ সব ধরনের বৈষম্য হ্রাসে অবদান রাখবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা; (খ) দারিদ্র্য নিশ্চিত নিরসনসম্পর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনগণের সম্পৃক্ততা করার কার্যকর পদক্ষেপ; (গ) স্বাভাবিক সময়ে দেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন, কিন্তু ২০ লাখ মানুষেরই কর্মসংস্থান হয় না।

(২) কভিড-১৯-এর কারণে যেহেতু বেকারত্ব দ্রুত হারে বাড়ছে, সেহেতু বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানসহ ব্যাপক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার পথ-পদ্ধতি অনুসন্ধান করে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।

(৩) দারিদ্র্য-বৈষম্য দূরীকরণে যেসব বিষয়ে আরও গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো: (ক) ক্রমবর্ধমান যুব বেকারদের বছরে কমপক্ষে ২০০ দিনের কর্মসংস্থান; (খ) দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পদ সৃষ্টি, সম্পদ রক্ষা ও শ্রমভিত্তিক সম্পদ বৃদ্ধি; (গ) ভূমিহীন কৃষক, কর্মচ্যুত শ্রমিক, বাস্তুচ্যুত মানুষ, গ্রাম-শহরের নারীপ্রধান খানা (যার অধিকাংশই দরিদ্র), বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠী (এখন প্রায় ৮০ লাখ মানুষ), বস্তিবাসী, চরের মানুষ, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আদিবাসী মানুষ (আনুমানিক ৫০ লাখ), নিম্নবর্ণ-দলিত সম্প্রদায়ের (৪০-৫০ লাখ) মানুষসহ সব প্রান্তিক ভঙ্গুর মানুষের স্থায়ীত্বশীল বৈষম্য নিরসনমুখী জীবনসমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সময়ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

 

সামাজিক সুরক্ষা-নিরাপত্তাবেষ্টনী-কল্যাণ

এ দেশে স্বাভাবিক অবস্থায় (অর্থাৎ কভিড-১৯ লকডাউনের আগে) সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তবেষ্টনী সুবিধা পাওয়ার যোগ্য খানার (household) সংখ্যা ২ কোটি, যাদের ৭৫ শতাংশ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ সংখ্যা এখন বেড়ে কমপক্ষে সাড়ে ৩ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। সেইসঙ্গে নিঃস্বতর হয়েছেন অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যাপকাংশ মানুষ এবং বেকার হয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ।

এসব বিবেচনায়—

(১) সামাজিক বৈষম্য হ্রাস ও সামজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ‘সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ’ খাতে (বিভিন্ন উপখাত ও ভাতা কার্যক্রম) বাজেট বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ বৃদ্ধি জরুরি।

(২) সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবেষ্টনীর সুবিধাপ্রাপ্তির সহজগম্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে পথ-পদ্ধতি নিরূপণ করা প্রয়োজন, যেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ-রাজনৈতিক দলীয় পরিচিতি নির্বিশেষে সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবেষ্টনীর ‘অন্তর্ভুক্তি ভ্রান্তি’ এবং ‘অন্তর্ভুক্ত-না হওয়ার ভ্রান্তি’ দুটোই দূর করা যায়। এসব ভ্রান্তি দূর করার অন্যতম পন্থা হলো সামাজিক সুরক্ষা জালটা চাহিদানুযায়ী সম্প্রসারিত করে ফেলা। বাজেটে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা জরুরি। অবস্থাদৃষ্টে বিশ্বাস যে, এ বিষয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলাটাই জরুরি।

(৩) আজকের প্রবীণ মানুষই ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা। আমাদের সব অর্জনে অবদান রেখেছেন প্রবীণ মানুষ। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় ‘প্রবীণ নীড়’ গড়ে তোলা সময়ের দাবি। দেশে একদিকে যেমন মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়ছে, তেমনি পুঁজিবাদের ঠেলা-ধাক্কায় বর্ধিষ্ণু পরিবার ভেঙে অনুপরিবার বাড়ছে। বাড়ছে অসহায়-দুস্থ-নিঃসঙ্গ প্রবীণ মানুষের সংখ্যা। সেইসঙ্গে কভিড-১৯-এর মহাবিপর্যয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি পর্যুদস্ত হচ্ছে প্রবীণ মানুষের জীবন। এতে করে অনেক প্রবীণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রবীণদের আশ্রয়হীন-ভঙ্গুর হওয়ার সম্ভাবনা অতীতের তুলনায় বহুগুণ বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে। আর এসব যৌক্তিক কারণেই প্রবীণ মানুষদের জন্য ‘প্রবীণ নীড়’ (‘বৃদ্ধাশ্রম’ নয়) গড়ে তোলা জরুরি। বিষয়টি বাজেটে অগ্রাধিকারযোগ্য। আমরা এ জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘প্রবীণ হিতৈষী বিভাগ’ নামে নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সে জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ প্রস্তাব করছি।

(৪) স্বাভাবিক সময়েই পেনশন ভোগীদের পেনশন প্রাপ্তির আয় থেকে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের সব আয় থেকে সব ধরনের আয়কর, কর, শুল্ক সম্পূর্ণ রহিত করা অত্যন্ত জরুরি। আর কভিড-১৯ মহামারির অভিঘাতকালে তা আরও বেশি যৌক্তিক।

(৫) কভিড-১৯-এর অভিঘাতে দেশের আর্থসামাজিক শ্রেণিকাঠামোতে আমূল অধোগতির ফলে মানুষ নিঃস্বতর হয়ে শ্রেণি মইয়ে দ্রুত নিচের দিকে নামছেন। মানুষের জীবনকে সম্মান ও শ্রদ্ধাশীল করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব-কর্তব্য। এ নিরিখে ভবিষ্যতের জীবন কুশলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সার্বজনীন পেনশন বিষয় নিয়ে এখনই ভাবনা জরুরি। বিষয়টি আসন্ন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সরকার এ নিয়ে কার্যকর কী কী পদক্ষেপের কথা ভাবছেন তার সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা-বিবরণী আমাদের বাজেটে থাকাটা হবে সময়োপযোগী, ন্যায়সংগত এবং সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিফলন।

(৬) জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সরকারের প্রতিশ্রুত ‘সকল গৃহহীনের জন্য বাড়ি’ কর্মসূচির দ্রুত এবং পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি। ‘আম্ফান’ সাইক্লোনে যেসব মানুষ গৃহহীন হয়েছেন, তাদের সবার দ্রুততর সময়ে গৃহনির্মাণ করে দেওয়া ন্যায়সংগত। সময়-নির্দিষ্ট বরাদ্দসহ বাজেটে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ

(১) অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠী, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়, পরিচ্ছন্নকর্মী, জেলে, বেদেসহ বিভিন্ন স্বল্প আয়ের পেশার এবং পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ এবং মানবিক উন্নয়নে অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অতিরিক্ত ও সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকা জরুরি।

(২) দেশের অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের জন্য ‘নিজ নামে’ প্রচলিত বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হোক। অনগ্রসর অঞ্চল নামে কোনো বরাদ্দের উল্লেখ থাকে না। অথচ বিভিন্ন মানদণ্ডে দেশে অনেক অনগ্রসর অঞ্চল আছে; এমনকি বৈষম্যের নিরিখে অনগ্রসর বিভাগও আছে। আমরা মনে করি, অঞ্চলের জন্য ‘নিজ নামে’ ব্যয়-বরাদ্দের রীতি চালু করা প্রয়োজন।

(৩) আদিবাসী, ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠী, দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য বাজেটে ভিন্ন কোনো বরাদ্দ থাকে না। বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে এসব বরাদ্দ এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, যা থেকে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ হিসাব করা সম্ভব হয় না। এক হিসাবে দেখা যায় যে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাহাড় ও সমতলের ৩০ লাখ আদিবাসী মানুষের জন্য আনুমানিক বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ বছরে ৩ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা, যা দেশের মোট বাজেটের মাত্র ০.৬৭ শতাংশের সমান (২০১৯-২০ অর্থবছরের মোট বাজেট ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা)। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বিধান-এর (অনুচ্ছেদ ২৩ ক) প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমরা এ বরাদ্দ দেশের মূল স্রোতের মানুষের মাথাপিছু বরাদ্দের তুলনায় কমপক্ষে তিনগুণ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করি। একই সঙ্গে প্রস্তাব করছি যে, আদিবাসী মানুষের জন্য সরকারি ব্যয়-বরাদ্দ যেখানেই দেওয়া হোক না কেন, তা ‘আদিবাসী মানুষ’ নামের লাইন আইটেমে দেওয়াটা স্বচ্ছতার বহিঃপ্রকাশ হবে এবং সেটাই কাম্য। আবুল বারাকাত অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি।কালবেলা-র সৌজন্যে

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন