নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্যমন্তক ঘোষ

তসলিমা থেকে বিবিসি টু : শাসকের চরিত্র একই

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৩ | ০৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
তসলিমা থেকে বিবিসি টু : শাসকের চরিত্র একই

ক্ষমতার বলে বই থেকে তথ্যচিত্র, সবই নিষিদ্ধ করতে পারে শাসক৷ কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিস মানুষের হাতে আরো বেশি পৌঁছায় ৷ বিবিসি টু চ্যানেলটি ভারতে দেখা যায় না ৷ ভারতের প্রায় ১৪০ কোটি জনগণের ৯৫ শতাংশ মানুষ এমন একটি চ্যানেলের অস্তিত্ব জানতেন না ৷ তারা কেবল বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস চেনেন৷ সেহেন এক চ্যানেলের তথ্যচিত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিষয়ে কী বলা হয়েছে, আপামর ভারতীয় সমাজের তাতে কিচ্ছু এসে যায় না৷ বিবিসি টু-তে প্রদর্শিত তথ্যচিত্রের তথ্য আসমুদ্রহিমাচল ভারতীয় নাগরিকের কানে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব ছিল৷ মেরেকেটে এক থেকে দেড় শতাংশ মানুষ হয়ত বা তা জানতে পারতেন ৷ কিন্তু ভারতীয় প্রশাসন দায়িত্ব নিয়ে তা পৌঁছে দিয়েছে ঘরে ঘরে ৷ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিবিসি টু-র ওই তথ্যচিত্র চোরাপথে ডাউনলোড শুরু হয়ে গেছে৷ কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবির স্ক্রিনিং নিয়ে শুরু হয়েছে অশান্তি, আন্দোলন, বিক্ষোভ৷

আধুনিক বাণিজ্যশাস্ত্রে ‘নেগেটিভ পাবলিসিটি’ বলে একটি তত্ত্ব আছে৷ বিবিসি টু তথ্যচিত্রটি নেগেটিভ পাবলিসিটির এক অসামান্য উদাহরণ ৷ সরকারবাহাদুর নির্দেশ দিয়েছিল, ওই তথ্যচিত্র ভারতে নিষিদ্ধ৷ কোথাও ওই ছবি প্রদর্শন করা যাবে না, কেউ ওই ছবি সমাজমাধ্যমে শেয়ার করতে পারবে না ৷ সরকারবাহাদুর ওই নির্দেশ দেওয়ার আগে ছবিটি যদি এক শতাংশ শেয়ার হয়ে থাকে, প্রশাসনিক নির্দেশের পর তার শেয়ার অন্তত ১০০ গুণ বেশি হয়েছে এবং হচ্ছে ৷ দেশজুড়ে ওই ছবিটিই এখন সবচেয়ে বড় ট্রেন্ডিং টপিক ৷

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে পশ্চিমবঙ্গের একটি নাটকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ৷ জর্জ অরওয়েলের নাটক অ্যানিমেল ফার্মের বাংলা রূপান্তর করেছিলেন নাট্যকার ও নির্দেশক অর্পিতা ঘোষ৷ তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উঠে এসেছিল ওই নাটকের আধারে৷ তৎকালীন বামপন্থি শাসকদল তেলেবেগুন হয়ে গ্রামে গ্রামে নির্দেশ জারি করেছিল, পশু খামার দেখাতে দেওয়া যাবে না ৷ নাট্যকর্মীদের উপর বার বার চড়াও হয়েছে রাজনীতির হুলিগানেরা৷ স্টেজ ভেঙে দেওয়া হয়েছে৷ মারধর হয়েছে৷ কিন্তু তাতে নাটক বন্ধ হয়নি৷ অর্পিতা ঘোষের পশু খামারের যতটা জনপ্রিয়তা পাওয়ার কথা ছিল, শাসকের দমননীতির কল্যাণে তা অন্তত ১০০ গুণ বেশি পেয়েছিল ৷ শাসকের উগ্রতাই সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ৷

পরবর্তীকালে তৃণমূল জমানার পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনা বার বার ঘটেছে এবং ঘটছে৷ নাট্যকর্মীকে মারধর, কার্টুন আঁকার দায়ে অধ্যাপককে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া, নাট্যমেলার মাঠ দখল করে নেওয়া– প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে এমন ঘটনা৷ শাসকের নির্দেশে ছবির প্রদর্শন বন্ধ হয়েছে, পরিচালককে ছবি চালানোর প্রেক্ষাগৃহ দেওয়া হয়নি, এমন ঘটনাও ঘটেছে ৷ পরিচালক অনীক দত্ত এ নিয়ে প্রতিবাদও করেছেন একাধিকবার ৷ শাসক যত চাপ তৈরি করেছে, শিল্পের প্রসার ঘটেছে তত বেশি৷

এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়ার ইতিহাস ৷ কিন্তু তাই বলে কি তার বইয়ের কাটতি বন্ধ করা গেছে? এক প্রকাশক বলেছিলেন, তসলিমাকে যখন বিতাড়িত করা হচ্ছে কলকাতা থেকে, সে সময় তার বইয়ের বিক্রি ছিল সব চেয়ে বেশি৷ তার যে বই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, ফটোকপি করে সেই বইয়ের পাইরেসি হয়েছে৷ মজা করে ওই প্রকাশক বলেছিলেন, নিষিদ্ধ না হলে ওই বই হয়ত হাজার কপিও বিক্রি হতো না ৷

নেগেটিভ পাবলিসিটির তত্ত্ব কি তবে শাসক বোঝে না? আলবাৎ বোঝে ৷ তবু তারা বার বার সে রাস্তায় যায় ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করতে৷ এও এক ধরনের ইগোর প্রশান্তি ৷ কোনো ছবি, কোনো বই, শিল্পকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করার মাধ্যমে নিজেকে সর্বশক্তিমান প্রমাণ করা যায়৷ বিভিন্ন সময়ে শাসক একাজ করে এসেছে৷ এখনো করছে৷ শাসক কেবল বোঝে না, বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির সঙ্গে লড়াই করা যায় না৷ নাগরিককে ক্ষমতার দম্ভ দেখানো যায়, প্রযুক্তিকে যায় না৷ নেগেটিভ পাবলিসিটির প্রচারে সে কারণেই নিষিদ্ধ বই, নিষিদ্ধ সিনেমা, তথ্যচিত্র মানুষের হাতে হাতে ঘোরে৷ ঘুরছে ৷

পাঠান ছবির কিছু দৃশ্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছেন কিছু বিজেপি নেতা ৷ তারা ঘোষণা করেছিলেন, নিজেদের রাজ্যে নিষিদ্ধ করবেন ওই সিনেমা৷ ফল কী হলো? সারা দেশে প্রথম দিনেই রেকর্ড টিকিট বিক্রি৷ বিতর্ক না হলে হয়ত এত কাটতি হতো না আদতে অতি মধ্য মানের এই ছবিটির৷

সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে দেশ বা রাষ্ট্রের আরো কিছু পরিচয় থাকে৷ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সমানাধিকার, ঐক্য– এই শব্দগুলি রাষ্ট্রের বৃহত্তর পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে৷ বিবিসি-র তথ্যচিত্রে নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে যে কথাগুলি বলা হয়েছে, তা নিয়ে একাধিক আপত্তি থাকতে পারে৷ থাকা উচিতও৷ গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে মোদীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল, সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত তার বিচার হয়েছে৷ অভিযোগ প্রমাণ হয়নি৷ সুতরাং, সেই একই অভিযোগ নতুন করে তোলা অর্থহীন৷ কিন্তু তাই বলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কি হস্তক্ষেপ করা যায়? সরকার চাইলে কোনো মতের বিরুদ্ধতা করতে পারে, নিন্দা করতে পারে, আইনের দ্বারস্থ হতে পারে, কিন্তু ক্ষমতা দেখিয়ে নিষিদ্ধ করতে পারে না৷ যে সরকার সে কাজ করে, তার পরিচয় দিতে অন্য শব্দের ব্যবহার হয়৷ ইতিহাসে ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারী, একনায়ক– এমন বহু শব্দের অস্বিত্ব আছে৷ ভারতীয় ভূখণ্ডে বিভিন্ন রাজ্যের এবং কেন্দ্রীয় শাসকের বিরুদ্ধে এধরনের শব্দ ইদানীং অনেকেই বার বার ব্যবহার করছেন৷ – স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলে

সাথী / পরিচয়

শেয়ার করুন