নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জেনারেল আসিম মুনিরের জন্য ইমরান কতটা চ্যালেঞ্জ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৩:২৬ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ০৩:২৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
জেনারেল আসিম মুনিরের জন্য ইমরান কতটা চ্যালেঞ্জ

পাকিস্তানের রাজনীতি এখন বেশ নড়বড়ে। আগাম নির্বাচনের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এ নিয়ে চাপে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকার। এরই মধ্যে পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান হয়েছেন জেনারেল আসিম মুনির। ইমরানের সঙ্গে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতাও সুখের নয়।

সেনাপ্রধান হওয়ার আগে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন আসিম মুনির। ২০১৮ সালে দেশটির প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রধান হন। তবে মাত্র আট মাসের মাথায় ওই পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। কারণ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁকে এই পদে দেখতে চাননি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের বিষয়ে ইমরান খান সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। তবে ইমরান–সৃষ্ট নানা পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে তাঁকে। আর পরবর্তী নির্বাচনে যদি ইমরান আবার প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তিনি নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা পাবেন। সে ক্ষেত্রে আসিম মুনিরকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়েও দিতে পারেন তিনি।

জেনারেল আসিম এমন একটা সময়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হলেন, যখন দেশটির রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি তোপের মুখে পড়েছে। গত এপ্রিলে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে পতন হয় ইমরান খান সরকারের।

এর পেছনে সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলে অভিযোগ করেন তিনি। এ ছাড়া সম্প্রতি বিক্ষোভের সময় ইমরানের ওপর হামলা চালানো হয়। এ ঘটনার আংশিক দায়ও তিনি সেনাবাহিনীর ওপর চাপিয়েছেন।

আসিম মুনিরের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে ইমরানের দিন দিন বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা। নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরানের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাঁর ওপর হামলা এই জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জেনারেল আসিমের নানা পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থকদের অসন্তোষের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।

সাবেক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়াও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গত ২৩ নভেম্বর তিনি বলেন, সাত দশক ধরে দেশটির রাজনীতিতে সেনা কর্মকর্তারা নাক গলিয়ে আসছেন। যদিও ভবিষ্যতে এমনটা আর হবে না বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

তবে জেনারেল আসিমের পক্ষে পূর্বসূরির এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা একপ্রকার অসম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। এমনই একজন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বলেন, বাজওয়ার বক্তব্য মেনে রাজনীতির বাইরে থাকা মুনিরের জন্য সম্ভব হবে না। বিশেষ করে এমন এটা সময়ে, যখন পাকিস্তান সরকার ও ইমরান খানের বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা চরমে উঠেছে।

আগামী বছর পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন। এর আগে নির্বাচনের আয়োজন করতে ইমরানের দাবি বরাবরই নাকচ করে এসেছে শাহবাজ শরিফ সরকার। মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, ইমরান ও পাকিস্তান সরকার—দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা করতে এগিয়ে আসতে পারেন নতুন সেনাপ্রধান। তবে এটা তিনি সেনাবাহিনীর স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই করবেন।

আসিম মুনিরের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে ইমরানের দিন দিন বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তা। নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরানের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাঁর ওপর হামলা এই জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জেনারেল আসিমের নানা পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থকদের অসন্তোষের মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।

পাকিস্তানের রাজনীতির মতো পররাষ্ট্রনীতিতেও সেনাবাহিনীর প্রভাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়নে এই প্রভাব কাজে লাগাতে পারেন জেনারেল আসিম। এমনিতেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। এরপর আবার ইমরান সরাসরি দাবি করেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে সে সময় ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়।

ঠিক এ কথাই বলছিলেন দিল্লিভিত্তিক প্রতিরক্ষাবিষয়ক গবেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা শশী আস্তানা। তাঁর ভাষ্যমতে, আসিম মুনিরকে অনেক বেশি রাজনৈতিক ঝড় সামলাতে হবে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে বর্তমানে এই ঝড় তুলেছেন ইমরান। তিনি সময়ের সঙ্গে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন।

পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আইএসআইপ্রধান থাকার সময় আসিম মুনির অভিযোগ করেছিলেন, ইমরান খান ও তাঁর স্ত্রী বুশরা বিবি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এরপরই তাঁকে গোয়েন্দাপ্রধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন অনেকেই বলেছিলেন, নিরপেক্ষ অবস্থান থেকেই ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন আসিম মুনির।

ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুহাম্মদ ফয়সাল খানের মতে, এসব কারণে পিটিআইয়ের সমর্থকদের মনে একটা আশঙ্কা রয়েছে যে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেই আসিম মুনিরকে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বর্তমানে সাধারণ মানুষের আস্থার সংকটে ভুগছে সেনাবাহিনী। বিভিন্ন অভিযোগ তুলে পিটিআইয়ের নেতারা এই সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছেন। পরিস্থিতি বদলাতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। গত মাসেই সাবেক সেনাপ্রধান বাজওয়াকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দেন ইমরান খান। এর পরপরই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সংবাদ সম্মেলন করেন আইএসআইপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুম। সাধারণত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এমন সংবাদ সম্মেলন করতে দেখা যায় না।

সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা জেনারেল আসিমের সামনেও একটা চ্যালেঞ্জ। গবেষক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার দিকে আসিম মুনিরকে নজর দিতে হবে। আর এটা করতে গিয়ে তিনি হয়তো সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে ইমরান খানের দলকে খেপানোর ঝুঁকি নেবেন না। কারণ, এতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে পারে।

পাকিস্তানের রাজনীতির মতো পররাষ্ট্রনীতিতেও সেনাবাহিনীর প্রভাব রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কোন্নয়নে এই প্রভাব কাজে লাগাতে পারেন জেনারেল আসিম। এমনিতেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অনেক দেশের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। এরপর আবার ইমরান সরাসরি দাবি করেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে সে সময় ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়।

সাবেক সেনাপ্রধান বাজওয়া অবশ্য তাঁর মেয়াদের শেষ সময়ে এসে পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মাঠে নেমেছিলেন। মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, এই ধারাবাহিকতা চালিয়ে যেতে হবে আসিম মুনিরকে। পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশা মোকাবিলা করতে এই সম্পর্কোন্নয়ন প্রয়োজন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বন্যায় দেশটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অর্থনৈতিক সংকট কমাতে সাহায্য করবে।

সব মিলিয়ে জেনারেল আসিম মুনিরের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করছে পিটিআইও। তাঁর নিয়োগ নিয়ে ইমরান খান প্রথম দিকে আপত্তি তুলছিলেন। তবে পরে তাঁর দল এর সমর্থন জানায়। এক বিবৃতি দিয়ে পিটিআই জানায়, তারা আশা করছে, সেনাবাহিনীর নতুন নেতৃত্ব তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে, যেন একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণ নতুন একজন নেতা বেছে নিতে পারে। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য কুইন্ট, আল-জাজিরা অবলম্বনে শেখ নিয়ামত উল্লাহ

শেয়ার করুন