নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আসিফ নজরুল

জামিনের রাজনীতি, সরকারের ভূমিকা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ১২:১৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৩ | ১২:২৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
জামিনের রাজনীতি, সরকারের ভূমিকা

কয়েক বছর আগে আমি হাইকোর্ট থেকে একটি মামলায় আগাম জামিন পাই। মামলাটি করা হয় কুখ্যাত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে। এ দেশে এসব মামলার প্রায় অবধারিত পরিণতি হচ্ছে নিম্ন আদালতে জামিন না পাওয়া এবং দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত অন্তরীণ থাকার শাস্তি ভোগ করা।

শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে আমি তাই হাইকোর্টের শরণাপন্ন হই, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে সেখান থেকে আগাম জামিন পাই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার কিছুদিন পরেই শুনি এই জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে আপত্তি জানিয়েছে। নির্ধারিত দিনে আদালতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখি স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়েছেন আমার মতো এক সামান্য মানুষের জামিন বাতিল করার জন্য! আমার অবশ্য ভাগ্য ভালো, চেম্বার জজ আমার জামিন বহাল রাখেন।

আমার মতো ভাগ্য সবার হয় না। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা খুব কম ঘটে। অনেক সময় চেম্বার জজ বরং এসব মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তা আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চের কাছে পাঠিয়ে দেন। বিএনপির দুই শীর্ষস্থানীয় নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসের ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক দিন আগে তা-ই ঘটেছে।

বিএনপির এই দুই নেতাকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, সেখানে এজাহারেই তাঁদের নাম ছিল না। তারপরও তাঁদের জামিনের আবেদন নিম্ন আদালতের দুই স্তরে কয়েকবার নামঞ্জুর করা হয়। সব জেনেশুনে হাইকোর্ট এরপর তাঁদের ছয় মাসের জন্য জামিন দেন। আমরা সবাই জানি, সুপ্রিম কোর্টের দুটো বিভাগের একটি হচ্ছে হাইকোর্ট বিভাগ, অন্যটি আপিল বিভাগ।

এর মানে হচ্ছে হাইকোর্ট নিজেই সর্বোচ্চ আদালতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সর্বোচ্চ আদালতের সামান্য এক জামিন দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আপত্তি জানিয়ে অন্তত কয়েক দিনের জন্য আটকে দিয়েছে মির্জা ফখরুলদের মুক্তিলাভের সম্ভাবনা। সেখানে জামিন না পেলে এজাহারে নাম নেই, এমন এক প্রশ্নবিদ্ধ মামলায় তাঁদের কারাগারে থাকতে হবে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য।

আইন ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে যাঁদের জানা আছে, তাঁদের কাছে জামিন বাতিলে সরকারের এই প্রবণতা স্বাভাবিক লাগার কথা নয়। আমরা জানি, হাইকোর্টে কোনো ব্যক্তির জামিন না হলে এর বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল বিভাগে গেছে, এমন নজির নেই বললেই চলে। কিন্তু রাজনৈতিক মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিলেই সরকার (বা রাষ্ট্রপক্ষ) এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেছে, এটি সম্প্রতি এ দেশে প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ এটি কোন যুক্তিতে করে থাকে, হাইকোর্টের জামিনের আদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আত্মবিশ্বাসই তারা পায় কীভাবে?

আদালতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে নিম্ন আদালতে জামিন নামঞ্জুর করানোর অভিযোগ পুরোনো বিষয়। এখন জামিন

২.

জামিন কোনো অভিযোগ থেকে মুক্তির আদেশ নয়। এটি দোষ প্রমাণের আগে মুক্ত থাকার এবং সেভাবে বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ। আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমলে করা ফৌজদারি আইনে কম গুরুতর মামলায় জামিন পাওয়া হচ্ছে মানুষের অধিকারভুক্ত বিষয়। গুরুতর মামলায়ও কাউকে জামিন দিতে সেখানে নিষেধ করা হয়নি, বরং অল্পবয়স্ক, নারী ও অসুস্থ ব্যক্তিদের জামিনের আবেদন সুবিবেচনা করার নির্দেশনা রয়েছে সেখানে। এ ছাড়া আদালতের বিভিন্ন রায়ে আসামির পালিয়ে যাওয়ার বা বিচারকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার সম্ভাবনা না থাকলে বা অভিযোগটি আপাতদৃষ্টে সুপ্রতিষ্ঠিত না হলে জামিন দেওয়ার বহু নজির আছে। অন্যদিকে জামিন না দেওয়া একধরনের বিচারপূর্ব শাস্তি—মূলত এ বিবেচনায় উন্নত আইনব্যবস্থার দেশগুলোতে জামিন নামঞ্জুরের সুযোগ নেই বললেই চলে।

আমাদের দেশে নিম্ন আদালতে রাজনৈতিক মামলায় জামিন আবেদনের ক্ষেত্রে আমরা দুটো প্রবণতা দেখি। বিরোধী দল বা ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে মামলায় (এমনকি তা গায়েবি বা ঢালাও ধরনের হলেও) একাধিকবার জামিন মঞ্জুর না করা নিয়মে পরিণত করা হয়েছে সেখানে। অন্যদিকে, গুরুতর মামলায়ও সরকারি দলের লোকজনকে প্রথম সুযোগেই জামিন দেওয়া প্রায় স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

জামিনের আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে এখানে বিচারিক বিবেচনা কতটুকু থাকে আর সরকারি হস্তক্ষেপ কতটা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে। নিম্ন আদালতে জামিন নামঞ্জুর হলে যাঁদের মোটামুটি সামর্থ্য আছে, অন্তত তাঁদের জন্য হাইকোর্ট হয়ে দাঁড়ায় জামিন লাভের একমাত্র জায়গা। সেখানে জামিন পাওয়ার পরও রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে দাঁড়ালে নতুন করে খরচ, ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হতে হয় ভুক্তভোগী মানুষকে। আমাদের সংবিধান দেখলে মনে হবে না, সর্বোচ্চ আদালত স্থাপন করা হয়েছিল এমন ভোগান্তির সুযোগ দেওয়ার জন্য।

৩.

আমাদের দেশের সংবিধানে হাইকোর্টকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সেখানে মাত্র তিন ধরনের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে সংবিধানের ব্যাখ্যাজনিত, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং হাইকোর্টের অবমাননাসংক্রান্ত রায়ের ক্ষেত্রে। অন্যান্য যেকোনো ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ পাওয়া যাবে কেবল এ–সংক্রান্ত আবেদন আপিল বিভাগ যৌক্তিক মনে করলে। পুরো বিধানটিতে এটি স্পষ্ট যে শুধু অত্যন্ত গুরুতর তিনটি ক্ষেত্রে বা কোনো কারণে সমপর্যায়ভুক্ত বলে বিবেচিত ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়াকে যৌক্তিক মনে করেছিলেন আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা।

হাইকোর্টের জামিনের আদেশ এসবের তুলনায় ক্ষুদ্র একটি বিষয়। এই আদেশে কাউকে কোনোরকম দণ্ড দেওয়া হয় না বা দণ্ড মাফ করা হয় না। এ ধরনের ছোট বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ রাষ্ট্রপক্ষ মেনে না নিলে হাইকোর্টের মর্যাদা থাকে কোথায়? হাইকোর্টের তুলনায় আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা থাকেন মাত্র এক-দশমাংশের মতো। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে গণহারে আপিল করার কারণে এমনিতেই আপিল বিভাগে মামলার দীর্ঘ জট লেগে থাকে। এমন অবস্থায় হয়রানিমূলক ও গায়েবি মামলাগুলোতে জামিনের বিরোধিতা করার আবেদন নিয়ে আসার আবশ্যকতাই-বা কোথায়?

মির্জা ফখরুলের মামলা দিয়েই আবার উদাহরণ দিই। গত এক দশকে তাঁর বিরুদ্ধে শ খানেক মামলা হয়েছে, সব মিলিয়ে তিন শতাধিক দিন জেলে থেকে অনেকগুলো মামলায় তিনি জামিনও পেয়েছেন। জামিন পেয়ে তিনি পালানোর চেষ্টা করেছেন বা মামলায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্য বাদীদের প্রাণনাশের বা অন্য কোনো হুমকি দিয়েছেন, এমন কোনো অভিযোগ এমনকি সরকারও উচ্চারণ করেনি।

এ ছাড়া সর্বশেষ মামলার এজাহারে তাঁর নামই ছিল না। এজাহারে নাম ছিল, এমন দুজন সেই মামলায় প্রথম দফাতেই জামিন পেয়েছেন, কিন্তু মির্জা ফখরুল (বা মির্জা আব্বাস) জামিনের আবেদন বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে নিম্ন আদালতে। অসুস্থ এই প্রবীণ রাজনীতিবিদকে এভাবে অন্তরীণ রাখার ঘটনায় ক্ষুব্ধ
হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আবুল কাসেম ফজলুল হকের মতো মত-দলনির্বিশেষে সবার কাছে শ্রদ্ধাভাজন বিশিষ্টজনেরাও।

অবশেষে তিনি সার্বিক বিবেচনায় জামিন পেয়েছিলেন হাইকোর্ট থেকে। এরপরও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়াকে সরকারের অপরাজনীতির প্রতিফলন ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ আছে কি?

৪.

সংবিধান অনুসারে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস হচ্ছে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। অ্যাটর্নি জেনারেল এবং তাঁর অধীনের আইন কর্মকর্তারা হচ্ছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আইন কর্মকর্তা।

কিন্তু তাঁদের নিয়োগ ও চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়ায় শতভাগ সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলন থাকার সুযোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন আমলে তাঁদের নিয়োগ ও ব্যবহার করা হয় সরকারি দলের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এরই একটি প্রকাশ আমরা দেখি ভিন্নমত ও রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের জামিনের বিরুদ্ধে সরকারের তথা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মরিয়া তৎপরতার মধ্যে।

রাজনৈতিক মামলায় এসব তৎপরতা গণতন্ত্র তো বটেই, আদালতের স্বাধীন সত্তার জন্যও মঙ্গলজনক নয়। আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক।দৈনিক প্রথম আলো-র সৌজন্যে

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন