নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জামায়াতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা বেহাল

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:৫০ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:৫০ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
জামায়াতের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা বেহাল

জামায়াতের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আশির দশকে গড়ে ওঠে একের পর এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, দিগন্ত মিডিয়া, কেয়ারি লিমিটেডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যতম। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মীর কাসেম আলীর গ্রেপ্তার ও মৃত্যুদণ্ডের ফলে জামায়াত ঘরানার এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা বেহাল হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আর যেগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেগুলোর পরিধিও সীমিত হয়ে পড়েছে।

২০১২ সালের ১৭ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে তার ফাঁসি ও আটটি অভিযোগে কারাদণ্ড হয়। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

জানা যায়, জামায়াত অনুসারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি সংগঠনটির আর্থিক জোগানের উল্লেখযোগ্য অংশ আসত মীর কাসেম আলীর মাধ্যমে। ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পর্যন্ত তিনি কারাগারেই ছিলেন। এ সময়ে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো হয় পর্যুদস্ত হয়েছে, নয়তো জামায়াত সমর্থিতদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। এতে এক দশকে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক সক্ষমতাও ভঙ্গুর হয়েছে।

জামায়াত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মীর কাসেম আলীর অনুপস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠানগুলো সফলভাবে চলতে পারত। কিন্তু সরকার ও সরকারি সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপের কারণে এগুলোর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে।

অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান এখনো জামায়াত মতাদর্শের লোকদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেগুলোও তাদের হাতছাড়া হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

ইবনে সিনা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান বলেন, মীর কাসেম আলী জামায়াত সমর্থক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে একত্র করে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তার অবর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটিই স্বাভাবিক।

তবে তিনি দাবি করেন, এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিনির্ভর হিসেবে গড়ে ওঠেনি। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের চেয়ে সরকার অনেক বেশি শক্তিশালী। সরকার চাইলে তার ক্ষমতা ব্যবহার করে যেকোনো প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন বা পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। ইসলামী ব্যাংকসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে আমরা এমনটি দেখেছি।

মূলত আশির দশকের শুরুর দিকে জামায়াত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও পেশাজীবীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন মীর কাসেম আলী।

১৯৮১ সালে জামায়াত মতাদর্শের চিকিৎসকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইবনে সিনা ট্রাস্ট। যা জামায়াত মতাদর্শীদের প্রথম ব্যবসায়িক উদ্যোগ। বর্তমানে এ ট্রাস্টের অধীনে তিনটি হাসপাতাল, ১৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, একটি মেডিকেল কলেজ, একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট ও একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি রয়েছে।

এর মধ্যে ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানিটি নিট মুনাফা করেছে ৬০ কোটি টাকা। গত বছরের জন্য কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৬০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা দিয়েছে।

ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাকালে এর পরিচালক ছিলেন মীর কাসেম আলী। একসময় জামায়াত ঘরানার লোকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখন শুধু ইবনে সিনা ট্রাস্টেই তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

নাম অপ্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, রাজধানীর বাইরেও সারা দেশে জামায়াত নেতাকর্মীদের গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত এক দশকে এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও খারাপ হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। যেগুলো এখনো টিকে আছে, সেগুলোর অবস্থাও ভালো নেই।

১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। এর নেতৃত্ব ছিলেন মীর কাসেম আলী। তিনি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক। যদিও ইসলামী ব্যাংকের ৬৩ শতাংশ মালিকানায় ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ১৩টি প্রতিষ্ঠান। এমনকি বাংলাদেশ সরকারেরও ৫ শতাংশ মালিকানা ছিল ইসলামী ব্যাংকে। ব্যাংকটির এ দেশী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিল জামায়াত ঘরানার প্রতিষ্ঠান ইবনে সিনা ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ইসলামিক রিসার্চ ব্যুরো ও বায়তুশ শরফ ফাউন্ডেশন।

ইবনে সিনা ট্রাস্টের প্রতিনিধি হিসেবেই মীর কাসেম আলীসহ জামায়াত সমর্থিতরা ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হতেন। ২০১৬ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। সরকারের সহায়তায় ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে জামায়াত মতাদর্শের কারো প্রতিনিধিত্ব নেই।

মীর কাসেম আলী ছিলেন চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টিদের অন্যতম। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডে ছিলেন চট্টগ্রামের জামায়াত নেতারা। ২০২১ সালে জামায়াত নেতাদের বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করে সরকার। চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামদ্দিন নদভীকে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়।

রাজধানীর মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মীর কাসেম আলী। সম্প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়েরও ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করে করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে। আগের সব ট্রাস্টিকে বাদ দেয়া হয়েছে।

মীর কাসেম আলীর প্রতিষ্ঠিত কেয়ারি গ্রুপের অধীনে ছিল অন্তত ১০টি কোম্পানি। ২০১২ সাল থেকেই এসব কোম্পানি দুর্বল হতে থাকে। বর্তমানে কেয়ারি গ্রুপের কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক পরিস্থিতি একেবারেই সীমিত হয়ে এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এছাড়া ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশন, রাবেতা আল-আলম আল ইসলামীসহ বহুজাতিক বিভিন্ন দাতব্য ও এনজিওর তহবিলের অর্থ বাংলাদেশে আসত মীর কাসেম আলীর মাধ্যমে। এসব তহবিলের অর্থ জামায়াতের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যয় হতো। মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের পর এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডও স্থবির হয়ে গিয়েছে।

মীর কাসেম আলীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত দিগন্ত মিডিয়া লিমিটেডের অবস্থাও বেহাল। এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা দিগন্ত টেলিভিশন ২০১৩ সালের ৬ মে থেকে বন্ধ। এছাড়া দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকাটি চালু থাকলেও অবস্থা ভালো নয় বলে জানা গেছে। সূত্র: দৈনিক বণিক বার্তা
পরিচয়/এমউএ

শেয়ার করুন