নিউইয়র্ক     শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জোসেফ এস নাই

চীনের উত্থান ঘটেছে, কিন্তু কতটা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ | ১২:২৫ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৩ | ১২:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
চীনের উত্থান ঘটেছে, কিন্তু কতটা

চীনের শূন্য কোভিড নীতি যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তা দেশটির শক্তিমত্তা ও সক্ষমতাকে পুনর্মূল্যায়ন করার মতো অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত অনেকে ধারণা করছিলেন, চীনের জিডিপি ২০৩০ সাল নাগাদ বা তারপরই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।

তবে এখন কিছু বিশ্লেষক যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, চীন ২০৩০ নাগাদ যে আর্থিক লক্ষ্য ঠিক করেছিল, সেই লক্ষ্যে তারা পৌঁছাতে পারলেও যুক্তরাষ্ট্রকে তারা ধরতে পারবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র আবার এগিয়ে যাবে। তার মানে কি আমরা ইতিমধ্যে ‘সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠা চীন’কে দেখে ফেলেছি?

চীনা শক্তিকে খাটো করে দেখার মধ্যে যেমন বিপদ আছে, তেমনি তাকে অতিমূল্যায়ন করাও বিপজ্জনক। কাউকে খাটো করে দেখা আত্মশ্লাঘার জন্ম দেয়; আর মাত্রাতিরিক্ত বড় করে দেখা মনের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দেয়। দুটোই যে কারও সক্ষমতাসংক্রান্ত হিসাব-নিকাশে তালগোল পাকিয়ে দিতে পারে।

যেকোনো ভালো কৌশলের জন্য প্রথমেই সতর্ক মাপজোখ দরকার। বর্তমানে যে ধারণাটি বাজারে চালু আছে, সেটি হলো চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। আদতে তা নয়। ক্রয়ক্ষমতা সমতার (পারচেজ পাওয়ার প্যারিটি বা পিপিপি) মাপকাঠিতে ধরা হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশটির অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু পিপিপি হলো অনুমিত সমৃদ্ধির তুলনা করার জন্য অর্থনীতিবিদদের ব্যবহার্য একটি ডিভাইস বা মাধ্যম মাত্র। চীন যদি কোনো দিন মোট অর্থনৈতিক আকারের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়েও যায়, তারপরও মনে রাখতে হবে, শুধু জিডিপি দিয়ে কোনো দেশের ভূরাজনৈতিক ক্ষমতা পরিমাপ করা যায় না।

চীন সামরিক এবং সফট পাওয়ার (জবরদস্তি করা কিংবা অর্থ ঢালার বদলে নিজস্ব প্রভাব ও ভাবমূর্তি দিয়ে অন্যদের আকর্ষণ করা এবং এর মাধ্যমে পছন্দসই ফল লাভ করার ক্ষমতা) সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশ পিছিয়েই আছে এবং ইউরোপ, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে তুলনা করলে চীনের আপেক্ষিক অর্থনৈতিক শক্তি এখনো ছোট।

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তার সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র জাপানে তার ঘাঁটি বজায় রাখবে, ততক্ষণ চীন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর থেকে নিজেকে গুটাতে পারবে না। এটাও মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র-জাপান জোট স্নায়ুযুদ্ধের সময় যতটা শক্তিশালী ছিল, এখন তার তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী।

হ্যাঁ, এটা ঠিক, বিশ্লেষকেরা কখনো কখনো তাইওয়ানে চীনা আগ্রাসনের যুদ্ধ পরিকল্পনা দেখে হতাশাবাদী প্রতিক্রিয়া দেন। কিন্তু পারস্য উপসাগর এবং ভারত মহাসাগরে বিদ্যমান মার্কিন নৌ-আধিপত্যের সামনে চীনের জ্বালানি সরবরাহের গুমর ফাঁস হয়ে আছে এবং চীনা নেতারা যদি মনে করে থাকেন, তাইওয়ানের কাছে (কিংবা দক্ষিণ চীন সাগরে) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি নৌ-সংঘাত বাধলে তা সেই অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তাহলে তাঁরা ভুল করবেন। চীন তার সফট পাওয়ার খাতেও প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। তবে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং আর্থিক সহায়তা প্রকল্প প্রকৃতপক্ষে চীনের আকর্ষণ বাড়াতে পারলেও সে পথে দুটি বড় বাধা রয়ে গেছে।

প্রথমত, জাপান, ভারত এবং ভিয়েতনামের মতো প্রতিবেশীদের সঙ্গে আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে চীন বিশ্বজুড়ে সম্ভাব্য অংশীদারদের কাছে আকর্ষণ হারিয়েছে। দ্বিতীয়ত, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দেশের ভেতরে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখায় দেশটির মানুষ সেই সব মুক্ত নাগরিক সমাজের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা পশ্চিমের মানুষ ভোগ করতে পারছে।

তার মানে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি কোন মাত্রায় এগোচ্ছে, সেটি তাঁর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে থাকছে। যুক্তরাষ্ট্র একসময় বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য শক্তি এবং দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা দেশ ছিল। কিন্তু এখন প্রায় এক শ টি দেশ চীনকে তাদের বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার হিসাবে গণ্য করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মাত্র ৫৭টি দেশের এই সম্পর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে ফেলেছে, সেখানে চীন গত এক দশকে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ১০ হাজার কোটি ডলার ধার দিয়েছে।

তবে ক্ষমতার সামগ্রিক ভারসাম্য মূল্যায়নের দিকে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের এখনো অন্তত পাঁচটি দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা রয়েছে। একটি হলো এর ভৌগোলিক অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র দুটি মহাসাগর এবং দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ দ্বারা বেষ্টিত। অন্যদিকে চীন ১৪টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করছে এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে আঞ্চলিক বিরোধে জড়িয়ে আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি–সুবিধাও রয়েছে। গত এক দশকে শেলবিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রকে জ্বালানি রপ্তানিকারকে রূপান্তরিত করেছে। অন্যদিকে চীন জ্বালানি আমদানির ওপর আগের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এসব দিক বিবেচনায় চীন এখনো যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সাবেক সহকারী মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন