নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জেমস কে গ্যালব্রেইথ

চীনকে নিয়ে আমেরিকার নতুন ভাষ্য, নেপথ্যে কী

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩ | ০১:৫৬ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২৩ | ০১:৫৬ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
চীনকে নিয়ে আমেরিকার নতুন ভাষ্য, নেপথ্যে কী

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস তাদের সর্বসাম্প্রতিক তিনটি প্রতিবেদনে চীন সম্পর্কে নতুন এক ভাষ্য হাজির করেছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও বিশ্বমঞ্চে চীন ছিল আমেরিকার ভীতিজাগানিয়া প্রতিযোগী। কিন্তু এখন আমরা শুনলাম, চীন একটি আহত ড্রাগন। একটা সময় অনমনীয় উত্থানের জন্য যে দেশটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, অবনমনের কারণে সে এখন নতুন আরেক ধরনের হুমকি সৃষ্টি করেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনকে নিয়ে নতুন এই ভাষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেমন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর মাইকেল ডি শিয়ার লিখেছেন, চীনে বেকারত্বের উচ্চ হার এবং বুড়িয়ে যাওয়া কর্মী বাহিনীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন টাইম বোমায় পরিণত করেছে। বাইডেন সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে ‘যখন দুষ্টু লোকেরা সমস্যায় পড়ে, তখন তারা দুষ্টুমি করে।’ কিন্তু বেকারত্বের উচ্চ হার এবং বুড়িয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীর কারণে চীন কেন বিশ্বের জন্য হুমকি, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

চীনের অবনমন নিয়ে নতুন এই ভাষ্যের পেছনে শিয়ার অবশ্য আরেকটি কারণ দেখিয়েছেন, চীনের উত্থান ও যুক্তরাষ্ট্রে আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ব্যবহার করে চীন যেন আর লাভবান হতে না পারে, তা ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট এখন উঠেপড়ে লেগেছেন। সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নতুন করে নিয়ন্ত্রণ আরোপের পর হয়তো তিনি এখন অসামরিক বিষয়ও যুক্ত করতে চাইছেন।

এদিকে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিক পিটার এস গুডম্যান নতুন এই ভাষ্যের পক্ষে আরও বেশ কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন চীনের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ কমে আসা, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে আবাসন ও অন্যান্য পণ্যের দাম কমে যাওয়া, গৃহায়ণ খাতে ধস, আবাসন খাতে ঋণ পরিশোধের অক্ষমতা—যার পরিমাণ প্রায় ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (অঙ্কটি বড়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের দেউলিয়া হতে বসা ব্যাংকঋণের তুলনায় এই অর্থ সামান্যই)।

গুডম্যানের মতে, (চীনসহ আরও বহু অর্থনীতিবিদ) চীনের এই সংকটের পেছনে আরও গভীর সমস্যা আছে। যেমন সঞ্চয়ের অতি উচ্চ হার, ব্যাংক-ব্যবস্থায় বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রাখা, জমিজমা ও আবাসন খাতে ব্যয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা এবং দেশের ভেতর চাহিদা বাড়ানোর অব্যাহত চেষ্টা। তিনি এবং তাঁর তথ্যদাতারা একমত, এই সমস্যার সমাধান হলো বিনিয়োগ কমিয়ে আরও বেশি ব্যয় করা।

গুডম্যান এমআইটির অর্থনীতিবিদ ইয়াশেং হুয়াংয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। চীনের রপ্তানি ও আমদানির হার জিডিপির ৪০ শতাংশ (এর বড় অংশই আমদানি করা জিনিস পুনর্বিন্যাস করে রপ্তানি করা পণ্য)। হুয়াং আসলে গুডম্যানকে এই ধারণা দিতে চেয়েছেন যে হাতবদলের এই ব্যবসা কমার একটা বড় প্রভাব পড়বে। কিন্তু আসলে এই প্রভাব খুব ব্যাপক নয়। কারণ, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি) আমদানি যুক্ত করা হয় না। চীন আদতে তার উৎপাদনমূল্যের সামান্যই হারাবে এতে।

সর্বশেষ নোবেল বিজয়ী পল ক্রুগম্যান কাগজটিতে চীনের এই হোঁচট খাওয়া নিয়ে অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে মন্তব্য করেছেন। ক্রুগম্যানের মতে, চীনের সমৃদ্ধি বহুলাংশে পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর ভর দিয়ে গড়ে উঠেছে। এখন দেশটির সমস্যায় পড়ার প্রধান কারণ অতিরিক্ত সঞ্চয়, অতিরিক্ত বিনিয়োগ এবং ক্রয়ের অতি সামান্য হার। তাই তাদের মৌলিক কিছু সংস্কারের পথে যেতে হবে। পরিবারগুলোর হাতে আরও বেশি অর্থ দিতে হবে, যেন নড়বড়ে বিনিয়োগব্যবস্থার বিপরীতে কেনাকাটার হার ক্রমে বাড়তে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে সঞ্চয় প্রসঙ্গে ক্রুগম্যান যা বলেছেন, সেখানে নতুন কিছু নেই। পশ্চিমা অর্থনীতিবিদেরা এই কথা বলে আসছেন ৩০ বছর ধরে। সে সময় আমি প্রায় চার বছর চীনের স্টেট প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান টেকনিক্যাল উপদেষ্টা ছিলাম। সে সময় যেমন, এখনো তেমনই—‘বিনিয়োগ কম: ক্রয় বেশি’, এই মন্ত্র আমাকে টানত না, এখনো টানে না। অনেকের মনে কৌতূহল জাগতে পারে যে এর মানেটা আসলে কী। চীনের কি আরও অনেক বেশি গাড়ি থাকা ও বেহাল সড়কের সংখ্যাও বেশি থাকা দরকার বা কম গ্যাস স্টেশন থাকা দরকার (সাবওয়ে ও দ্রুতগতির ট্রেনের কথা না হয় বাদই দিলাম)?

এ কথা সত্যি যে চীনা পরিবারগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও বৃদ্ধ বয়সের জন্য যেভাবে সঞ্চয় করে, তা বিস্ময়কর। কিন্তু তারা এটা করতে পারছে। কারণ, তাদের আয়রোজগার ভালো। আর এই আয় তারা করেছে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ খাত থেকে। চীনা কর্মীরা কারখানা, বাড়িঘর, রেললাইন, সড়ক ও সরকারি অন্যান্য কাজের জন্য আয় করে থাকেন। তাঁদের এই কাজ আমাদের জীবদ্দশাতেই চীনকে বদলে দিয়েছে। ক্রুগম্যানের দাবির বিপরীতে বলা যায়, চীনা পরিবারগুলোর আয় সীমিত নয়। যদি সীমিত হতো, তাহলে তারা এত টাকা সঞ্চয় করতে পারত না।

তার ওপর চীন যদি এখন তার বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে আয় কমবে, সঞ্চয়ের গতিও ধীর হবে। আর আয়ের অনুপাতে কেনাকাটার হারও বাড়বে। কিন্তু সঞ্চয় কমে যাওয়ায় চীনা পরিবারগুলো আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে, যা ক্রমে তাদের গতিকে আরও মন্থর করে দেবে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে সরকার বিনিয়োগের গতি ঠিক রাখতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মতো বড় প্রকল্পের ঝক্কি নিয়েছে। এমনকি চীনের পূর্ণাঙ্গ বিনির্মাণের পরও মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় আরও অনেক কিছু করার আছে। ওই সব অঞ্চলে চীনের বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হয়। তাদের বলতে শোনা যায়, ‘যখন আমরা চীনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াই, তখন আমরা একটা বিমানবন্দর পাই। আর যখন আমরা তোমাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) সঙ্গে জড়াই, তখন আমরা বক্তৃতা শুনতে পাই।’

এ কথা সত্য, চীনের অর্থনীতির গতি এখন মন্থর। যে শহর ও যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তারা গড়ে তুলেছে, অথবা অতি দারিদ্র্য দূর করতে যে প্রচার তারা চালাচ্ছে, তার তুলনা পাওয়া কঠিন। চীন অন্যত্র তাদের করণীয় নির্ধারণ করেছে। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার খাত, বয়স্কদের জন্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা, দূষণ হ্রাস ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন কমিয়ে আনা। এই উদ্যোগগুলো সফল হবে, সে নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন। তবে অন্তত এই বিষয়গুলো চীনের আলোচ্যসূচিতে আছে। এর অর্থ, এই কাজগুলোও একে একে হবে, চীনারা যেভাবে করে থাকে, ঠিক সেভাবে।

তাহলে চীন বিষয়ে নতুন এই ভাষ্য আসলে কী নিয়ে? এটা আসলে চীন নয়, এটা পশ্চিমাদের নিয়ে। এটা আমাদের প্রযুক্তি, আমাদের মুক্ত বাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আমাদের ক্ষমতা খাটানো এবং আমাদের যারা চ্যালেঞ্জ দিতে পারে, তাদের দূরে রাখার কৌশল; যা কিছু পশ্চিমা বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, আসলে সেটাই বারবার বলা, পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। সর্বোপরি, এটা হলো দুষ্টু লোক, যারা কিনা দুষ্টুমি করতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার নেতাদের বিজয়ের ঘোষণা। এই ভাষ্য আসলে তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের নির্বাচন মাথায় রেখে। জেমস কে গ্যালব্রেইথ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের লিন্ডন বি জনসন স্কুল অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক।

শেয়ার করুন