নিউইয়র্ক     শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ব্রেক্সিটের দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ব্রিটেন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ | ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ব্রেক্সিটের দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ব্রিটেন

করোনাকালে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে যায় ব্রিটেন। তাদের এ প্রস্থান ‘ব্রেক্সিট’ নামে পরিচিত। ব্রেক্সিট হচ্ছে দুটি ইংরেজি শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ- ‘ব্রিটেন’ ও ‘এক্সিট’। ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্তকে ব্রেক্সিট বলা হয়। রয়েছে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ব্রিটেনের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় ব্রেক্সিটের স্পষ্ট ও শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে।

ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলেও বাণিজ্যসুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে রয়েছে ব্রিটেন। ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য চুক্তিগুলো সুরক্ষিত করার লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না দেশটির। প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ব্রেক্সিট চুক্তি বাস্তবায়নের পর থেকে যুক্তরাজ্যের রপ্তানিকারকের সংখ্যা ১৫ শতাংশ কমে গেছে।

২০১৯ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, নতুন বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে তারা ব্রেক্সিটের কারণে খোয়ানো বহির্বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই পুনরুদ্ধার করবে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য ব্রেক্সিট-পূর্ব বাণিজ্যের ৬৩ শতাংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। বর্তমান মার্কিন প্রশাসন বিষয়টিকে তেমন অগ্রাধিকার দিচ্ছে না।

ব্রিটিশ সরকার ১২ নভেম্বর ভারতের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। সেটি সম্ভব হয়নি। তবে যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে ইইউ এবং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জাপানসহ ৭১টি দেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। জাপানের সঙ্গে করা চুক্তিটি নিয়ে চলতি বছরের শুরুর দিকে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। কারণ সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরে দেশটিতে যুক্তরাজ্যের পণ্য ও পরিষেবা রপ্তানি কমেছে।

এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের বাণিজ্য চুক্তিটিও সমালোচনার জন্ম দেয়। যুক্তরাজ্যের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী জর্জ ইউস্টিসও কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আসলে যুক্তরাজ্যের জন্য খুব ভালো কোনো চুক্তি নয়।’

যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ‘আমরা আমাদের লক্ষ্য বড় করেছি। কিন্তু আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করা প্রয়োজন। কিন্তু এটি এখন একটি স্পষ্ট বিষয় যে বাইডেন প্রশাসন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাকে খুব একটা অগ্রাধিকার দিচ্ছে না।’

রাজস্ব ও কাস্টমস বিভাগের তথ্য-উপাত্তে দেখা যায় যে ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যে যেখানে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৪৪৩ জন রপ্তানিকারক ছিলেন সেখানে ২০২১ সালে তা কমে ১ লাখ ২৬ হাজার ৮১২ জনে নেমে এসেছে।

প্রতি মাসেই ব্রিটেনের মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড উচ্চতায় উঠছে। গত সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবার জানা গেল, অক্টোবরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য থেকে শুরু করে জ্বালানি- সবকিছুর দাম এখন বাড়তি। দুধ, পনির ও ডিমের দাম এখনো বাড়ছে। জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১১.১%। এই হার ১৯৮১ সালের অক্টোবরের পর সর্বোচ্চ।

এর মধ্যে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশটির অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকসের (ওএনএস) প্রধান অর্থনীতিবিদ গ্রান্ট ফিটজনার জানান, গত এক বছরে যুক্তরাজ্যে গ্যাসের মূল্য বেড়েছে প্রায় ১৩০ শতাংশ আর বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ।

জ্বালানি মূল্যের রাস টানতে যুক্তরাজ্য সরকার অক্টোবর থেকে এনার্জি প্রাইস গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছে। এর মাধ্যমে দেশটির প্রায় সব নাগরিক ৪০০ পাউন্ড জ্বালানি ভর্তুকি পাবেন।কিন্তু তাতেও মানুষের দুরবস্থার যেন অবসান ঘটছে না। মূলত গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই মূল্যস্ফীতির হার প্রতি মাসেই রেকর্ড স্পর্শ করছে। ওএনএসের হিসাব- সরকার যদি এই ভর্তুকি না দিত, তাহলে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াত ১৩.৮%।

এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে মজুরি বেড়েছে ৫.৭ শতাংশ। আর সে মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০.১। অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিটেনের বৃহত্তম সুপারমার্কেট টেসকোর এক জরিপে দেখা গেছে, ক্রেতারা এখন মেয়াদের শেষ দিকে থাকা পণ্য খোঁজ করছেন, কারণ এসব পণ্যে বেশি ছাড় পাওয়া যায়। টেসকো জানায়, তাদের ৩৩ শতাংশ গ্রাহক এখন ঘন ঘন এ ধরনের ছাড় খুঁজছেন।

পাইকারি বাজারে জ্বালানির দাম কমার কারণে গ্রাহকেরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন ঠিক, কিন্তু জ্বালানির দাম এখনো প্রাক-যুদ্ধ সময়ের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। সেজন্য ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আশা করছে, আগামী কয়েক মাস যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের ওপরে থাকবে। এরপর মূল্যস্ফীতির হার কমতে পারে।

এদিকে যুক্তরাজ্যে চিকিৎসকের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য পরিচর্যায় বিশেষায়িত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক নুফিল্ড ট্রাস্টের এক সমীক্ষায় এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। সংস্থাটি জানায়, ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর থেকে ব্রিটেনে চার হাজার চিকিৎসকের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ব্রেক্সিটের আগে যেভাবে ব্রিটেনে ইউরোপীয় চিকিৎসকদের উপস্থিতি ছিল, এখন সে রকম নেই। বিশেষ করে অ্যানেস্থেশিয়া, পেডিয়াট্রিক্স, কার্ডিও ও সাইকিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞদের ঘাটতি রয়েছে।

নুফিল্ড ট্রাস্ট মনে করে, ব্রেক্সিট পরবর্তী নতুন নিয়মে নানা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ভিসার নিয়ম আরও কঠোর হয়েছে। ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে (এনএইচএস) কাজের পরিবেশ পাল্টে গেছে। পরিবেশের অবনতিও হয়েছে। এ কারণে যুক্তরাজ্যে চিকিৎসকদের আগমন কমে গেছে। ব্রেক্সিটের পর ইইউ আইন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোর্ট অব জাস্টিস এখন ব্রিটিশ আইনের ওপর প্রাধান্য পায় না।

শেয়ার করুন