নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিএনপি কাছে চায়, বামরা দোটানায়

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ | ০১:৪৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩ | ০১:৫২ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বিএনপি কাছে চায়, বামরা দোটানায়

ফাইল ফটো

জয়ন্ত সাহা : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি এবার কাছে টানছে সক্রিয় বাম দলগুলোকে। দলটির নেতারা বলছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রণয়নসহ ‘রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের’ লক্ষ্যে তাদের উত্থাপিত ২৭ দফার সঙ্গে প্রধান সারির বাম দলগুলোর দাবিদাওয়ার তেমন কোনো ভিন্নতা নেই। কাজেই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকার কথা নয়।

‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ ২৭ দফা উত্থাপন করার পর বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও বলেন, একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো হবে। এ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোকে নিয়েই পরে একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।

এমন প্রেক্ষাপটে জোর আলোচনা চলছে, প্রথম সারির বাম দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির ঐক্য হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, হলে কোন কোন দল ঐক্যবদ্ধ হবে, তাদের নিয়ে নির্বাচনী জোট কীভাবে গঠন হবে বা সেটির রূপরেখা কেমন হবে এবং আসন বণ্টন ইস্যুর সমাধানইবা হবে কী করে।

তবে প্রধান সারির কয়েকটি বাম দলের নেতা বেশ জোরের সঙ্গেই বলছেন, তারা একটি বড় বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে চাইলেও বিএনপির সঙ্গে জোটের কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা যে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ রূপরেখা দিয়েছে, তার সঙ্গেও বামদের দূরত্ব রয়েছে। অবশ্য কোনো কোনো বাম দল চাইছে, বিএনপির সঙ্গে এক মঞ্চে না হলেও যুগপৎ আন্দোলনের পথে হাঁটতে।

বিএনপির পাশে যারা : গত বছরের ডিসেম্বর থেকে সমমনা দলগুলো নিয়ে বিএনপি সরকার পতনের ধারাবাহিক আন্দোলনের পথে হাঁটছে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে ১২ দলীয় জোট ও ১১ দলের জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট রয়েছে। আছে অলি আহমেদ নেতৃত্বাধীন এলডিপি।

মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্র মঞ্চের সমর্থনও পেয়েছে বিএনপি। অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’ও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ ধারায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ২০১৭ সালে গঠিত এই জোটে বর্তমানে রয়েছে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল।

এ প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সমন্বয়ক হারুন চৌধুরী বলছেন, ‘বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামতের যে ২৭ দফা দিয়েছে, তাতে এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য তাদের সমর্থন জুগিয়ে যাবে।’

যা বলছেন প্রধান সারির বামনেতারা : বিএনপি ও বাম দলগুলো আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে একই সুরে কথা বলছে- এ কথা মানতে নারাজ বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদ নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ এবং সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। যদিও গত বছরের ডিসেম্বরে বিএনপি যেসব দাবি উত্থাপন করেছে, সেগুলোর সঙ্গে একই বছরের অক্টোবরে বাম গণতান্ত্রিক জোটের উত্থাপিত ১০ দফার অনেক মিল থাকার কথা বলছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ প্রসঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ব্যবস্থা বদলের জন্য আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি জানাচ্ছি, সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে একই দাবি। আদতে তা নয়। আমরা বলছি, সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন করতে হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচনটি আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের প্রভাবমুক্ত রাখার কথা আমরা বলছি। আমরা যে দশ দফা দাবি দিয়েছি, তাতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। বিএনপির ২৭ দফায় সেসব নেই। বিএনপির সঙ্গে আমাদের দফাগুলোর পার্থক্য সেখানে।’

রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘জোট, মহাজোটের কোনো প্রশ্ন আমাদের নেই। আমরা চাই একটা বড় বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে। যাদের কাজ হবে, একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলা। তবে বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোটের বা ঐক্যের কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তারা যে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছে ,তাতে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের প্রশ্ন নেই। তারা কী বলেছে, তারা কালো টাকা সাদা করবে না? নির্বাচনে কালো টাকা বা পেশি শক্তির কোনো ব্যবহার হবে না? তারা সেই সাম্প্রদায়িক শক্তি নিয়ে পথ চলবে না। বামরা নিজস্ব ধারায় এগিয়ে যাবে।’

ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেকও বিএনপির সঙ্গে প্রথম সারির বাম দলের জোট হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় বিশ্বাসী বাম দলগুলো কখনও বিএনপির সঙ্গে যাবে না। আমরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে নিশ্চয়ই এমন কাউকে বসাব না, যে একই ধারায় হত্যা-নির্যাতন অব্যাহত রাখবে।’

বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, গণমুক্তি ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চ- এ সাতটি দল মিলে নতুন একটি বাম মোর্চা গঠনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এই বাম দলগুলোও বিএনপির সঙ্গে জোটে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ-কথা জানিয়েছেন গণমুক্তি ইউনিয়নের আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন আহমেদ নাসু। তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম আমাদের করতে হবে। তা না হলে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব না। আমরা সেই দাবিতেই আন্দোলন করছি নিজেদের স্বতন্ত্র ধারায়।’

‘বলার সময় এখনও আসেনি’ : এদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে আসার পর শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও নাজমুল হক প্রধানের বাংলাদেশ জাসদকে পাশে পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। তবে এতে এখনও সাড়া দেয়নি এ দল। বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলছেন, ‘নির্বাচনের এখনও এক বছর বাকি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, কী হবে সামনে, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। তাই কার সঙ্গে কোন ধরনের জোট হবে, না কি যুগপৎ আন্দোলন হবে, তা এখনই আমরা চূড়ান্ত করে বলতে পারি না।’

এ প্রসঙ্গে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি না কি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের জোট হবে, তা এখনও বলার সময় আসেনি। এর আগে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আমরা কিন্তু জোটের বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে নির্বাচন করেছি। ভোটে অংশ নিতে জোটভুক্ত হতে হবে, এমন প্রশ্ন নেই।’

সংশয়ে বাম নেতা ও তাত্ত্বিকরা : এদিকে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজস্ব ধারা থেকে সরে আসায় বামদলগুলো ক্রমাগত জনসমর্থন হারাচ্ছে বলে মনে করছেন প্রবীণ বাম নেতা ও তাত্ত্বিকরা। এ রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে সিপিবির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য (বর্তমানে নিষ্ক্রিয়) সহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বাম রাজনীতির কোনো ধারা এখন পরিষ্কার না। তারা নির্বাচনের আগে কোন জোটে যাবে, আলাদা কোনো জোট গঠন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিবে কি না, তা পরিষ্কার করে জনগণের কাছে বলছে না। এটা আমি বলব, এক ধরনের অসৎ রাজনীতি। নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলে বাম ধারার আন্দোলনের কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না।’

বাসদের (মাহবুবুল) এক আলোচনা সভায় সম্প্রতি সিপিবি সভাপতি শাহ আলম বাম দলগুলোর ঐক্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘রাজনৈতিক বাস্তবতায় বামপন্থিদের অবস্থান হয়তো দুর্বল। তবে পাওয়ার গেমের রাজনীতিতে আমাদের ঐক্যের দরকার ছিল।’

ওই অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বামপন্থি আন্দোলনে ঐতিহাসিকভাবে একটা মনোভাব আছে যে, আমরা পারব না।বুর্জোয়ারা অনেক শক্তিশালী। সাতচল্লিশে পারলাম না। তারপর আমরা বামপন্থিরা আন্দোলন করলাম। কিন্তু পারলাম না, বিভক্ত হয়ে গেলাম। বাম নেতারা জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারছেন না। তারা সংগ্রাম করছেন। তারা হয় কখনও গোপন পার্টি, না হয় বিভ্রান্ত পার্টি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের চার মূল নীতির ভিত্তিতে রাজনীতি করছে প্রথম সারির বাম দলগুলো। মূলধারার বাম দল সিপিবি, বাসদ বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে যাবে না, কারণ তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শই ভিন্ন। এর মধ্যে প্রথম সারির কোনো বাম দল যদি বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে, তারপরও ভোটের মাঠে খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।’

বাম দলগুলোকে নির্বাচনে চায় আওয়ামী লীগ :কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিএনপি যদি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়, তবে তারা জাতীয় পার্টি ও বাম দলগুলোকে নিয়ে ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন আয়োজন করবে।

প্রসঙ্গত, কোনো কোনো বাম দল এবং বিএনপির অভিযোগ, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ‘ভোট কারচুপির মহোৎসব’। তাদের অভিযোগ, ‘রাতের ভোটে’ নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের ভোটাধিকার ‘কেড়ে নিয়েছে’। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে কোনোভাবেই অংশ নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, তারাই কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির নীতিনির্ধারক, তবে কিছু বলার নেই। কিন্তু আমরা তাদের ডাকে নির্বাচনে যাব, এ কথা তারা ভাবছে কী করে?’

তবে বাম জোটের একজন শীর্ষ নেতা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এভাবে নির্বাচন বর্জন করা হলে দলের অবস্থান নমনীয় হয়ে যাবে। দলে অনেক তরুণ রয়েছে, বাম জোটের দলগুলোর বড় ভোট রয়েছে, নির্বাচনে দলের প্রভাবও রয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপির সুরে কথা না বলে নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত।’

১৪ দলের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জানান, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাম দলগুলোকেও জোটভুক্ত করতে চাইবে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশ জাসদ এবং সিপিবিকেও নির্বাচনী জোটে টানতে চাইছে আওয়ামী লীগ।

যেসব বাম দল বিএনপির সঙ্গে জোট করেছে বা যুগপৎ আন্দোলনে যাচ্ছে, তাদের সমালোচনা করে বাম রাজনীতিক রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘একদিকে তারা বলছে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, অন্যদিকে তারা জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলাচ্ছে। এই বাম দলগুলো যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে, তা ধোপে টিকবে না। তারা আদতে কিছু সিট পাওয়ার জন্য লড়াই করছে।’- সুত্র প্রতিদিনের বাংলাদেশ

সাথী / পরিচয়

শেয়ার করুন