নিউইয়র্ক     শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারুন উর রশীদ স্বপন

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছর : ৭০ অনুচ্ছেদে বলীয়ান ‘এক দলের শাসন’

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১০:৫২ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১০:৫২ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৫০ বছর : ৭০ অনুচ্ছেদে বলীয়ান ‘এক দলের শাসন’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল৷ তাই এই ৭ এপ্রিলে পূর্ণ হলো সংসদের ৫০ বছর ৷ সংসদ সদস্য এবং বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, জাতীয় সংসদ এখন আর রাজনীতিকদের হাতে নেই, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে৷ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা খর্ব করেছে, যা একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷

জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশন : জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশেষ অধিবেশন শুরু হয়েছে ৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার৷ ৭ এপ্রিল শুক্রবার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন৷ রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেছেন, ‘‘ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো নির্বাচন৷ আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ-সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না৷ সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত করা উচিত৷” ‘‘গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয়৷ গণতন্ত্রহীন অবস্থায় যে উন্নয়ন হয় তা কখনো সার্বজনীন হতে পারে না৷ চর্চার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়,” বলেন রাষ্ট্রপতি৷ তার কথা, ‘‘দেশের উন্নয়ন স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত করতে হবে৷”

আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেছেন, ‘‘সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সংসদ অনন্য ভূমিকা পালন করছে৷’’ তিনি সংসদে তার উত্থাপিত প্রস্তাবে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুরূপে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং আশা-আকাঙ্খার সফল বাস্তবায়নে অব্যাহতভাবে কার্যকর ও সক্রিয় ভুমিকা রাখবে৷ গণতন্ত্র হবে সুসংহত. শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, সকলের জন্য সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে৷’’

সংসদ নিয়ে দুই দলের ভাবনা : সরকার দলীয় সংসদ সদস্য এবং নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় সংবিধান হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে- যে সংসদে ১৫৬টি আইন পাস হয়েছে৷ তারপর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তো দীর্ঘদিন সংসদীয় রাজনীতি আলোর মুখ দেখেছি৷ দীর্ঘদিন স্বৈরাচার, সামরিক স্বৈরাচার ছিল৷ ৯০-এর গণ অভ্যুত্থানের পর আমরা সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে আসি৷ তারপরও সংসদ বাধাগ্রস্ত হয়েছে; কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিকে হত্যা করতে পারে নাই৷’’ তার কথা, ‘‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো স্বাধীনতা৷ আর গত ১৫ বছর সংসদীয় রাজনীতির নিরবচ্ছিন্ন চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে গেছে৷ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ এর কৃতিত্ব শেখ হাসিনার৷’’

তবে সংসদ থেকে বিএনপির পদত্যাগকারী এমপি হারুনুর রশিদ বলেন, ‘‘সংসদের ৫০ বছর পূর্তিতে সংসদে কেন বিরোধী দল নাই৷ এটা খুবই দুঃখের বিষয়৷ এটা একটি এক দলীয় সংসদ৷ সংসদকে কার্যকর করতে হলে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকতে হবে৷ যারা নির্বাচিত. তারাই সংসদে থাকবেন, অনির্বাচিতরা নয়৷’’ তার কথা, ‘‘সংসদে দয়িত্বশীল যারা ৫০ বছর পূর্তিতে বক্তৃতা দিয়েছেন, তারা বাস্তবতার ধারেকাছে নাই৷ তারা সত্য বলছেন না৷ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আজকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং সংসদকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘আমরা যেভাবে বাকশালকে বিদায় করেছি তেমনি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবো, সংসদকে কার্যকর করবো৷’’

৭০ অনুচ্ছেদের ভূমিকা : জাতীয় পার্টির এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী মনে করেন, ‘‘সংবিধানে যতদিন ৭০ অনুচ্ছেদ থাকবে, ততদিন সংসদ সদস্যরা স্বাধীন নন৷ তাদের কোনো বাকস্বাধীনতা নাই৷ কারণ সংসদ সদস্যরা এই বিধির কারণে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না, গেলে সংসদ সদস্য পদ বতিল হয়ে যায়৷ ফলে কোনো আইন খারাপ হলেও সমর্থন দিতে হয়৷” তার কথা, ‘‘এই অনুচ্ছেদের কারণে সংসদীয় ব্যবস্থা একদলীয় শাসনের দিকে চলে যাচ্ছে৷ একদলীয় আবার একজনের শাসন ব্যবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে৷” তিনি মনে করেন, ‘‘সংসদে জবাবহিতার জায়গা তৈরি হয়নি৷ মন্ত্রী এমনকি প্রধান মন্ত্রীও সংসদে জবাবদিহি করবেন৷ কিন্তু তা হয়নি৷ সংসদীয় কমিটিগুলো কাউকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারে না৷ আর দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র হয় না৷’’

ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘জাতীয় সংসদ এখন ব্যাবসায়ীদের দখলে চলে গেছে৷ ৯০-এর পর থেকে এই পরিস্থিতি শুরু হয়েছে৷ ৬৫-৭০ ভাগ এমপি এখন ব্যবসায়ী৷ আগে সংসদে প্রাধান্য থাকতো আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের৷ ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় রাজনীতিবিদদের প্রাধান্য ছিল৷’’ তার কথা, ‘‘ব্যবসায়ীরা শুধু বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য কাজ করেন৷ তাই এখনকার সংসদ সদস্যরা জনগণের জন্য নয়, মুনাফার জন্য কাজ করেন৷ এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভালো হয় না৷’’

তিনি বলেন, ‘‘সংসদ সদস্যদের মূল কাজ আইন প্রণয়ন করা৷ কিন্তু এখন তারা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা নিয়ে কাজ করেন৷ ফলে এটা ব্যবসায়ী-বান্ধব সংসদে পরিণত হয়েছে৷” তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ভোটের অধিকার সংকুচিত হয়েছে৷ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়ায়নি৷ গণতান্ত্রিক মানসিককতার পরিবর্তে ফিউডাল মানসিকতা প্রাধান্য বিস্তার করছে৷ তাই সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশকে আরো অনেক দূর যেতে হবে৷’’হারুন উর রশীদ স্বপন, জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে, ঢাকা

এসএ/এমএএস/এমউএ/টিএ/পরিচয়

শেয়ার করুন