নিউইয়র্ক     শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : সূচকেও পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০২৩ | ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৬ মে ২০২৩ | ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : সূচকেও পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত

বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে৷ সাংবাদিকদের ওপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গ আছে, সংবাদ প্রকাশের কারণে অনেকে হামলা ও ফৌজদারি মামলার শিকার হচ্ছেন৷ রিপোর্টার্স উইদাইট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় এক ধাপ পিছিয়েছে৷ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষ্যে তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩৷ স্কোর ৩৫.৩১৷ ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২, স্কোর ছিল ৩৬.৬৩৷ ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালের সূচকে বাংলাদেশের ১০ ধাপ অবনতি হয়েছিল৷ ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২, স্কোর ৫০.২৯৷ ২০২০ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১, স্কোর ৫০.৬৩৷

সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, মালয়েশিয়া৷ সূচকে যুক্তরাজ্যের অবস্থান ২৬, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫৷ নরওয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় শীর্ষে আছে ৷ বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে৷ তারা বলছে, ওই সব মামলার মধ্যে ২৭. ৪১ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে৷ এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৫৫ জন সাংবাদিককে৷

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকি ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে বাধার শিকার হয়েছেন৷ তারা বলছে, “এই সময়ের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির হেফাজতে মৃত্যু, জোরপূর্বক অপহরণ ও নিখোঁজ, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে৷”

তাদের হিসেবে ২০২২ সালে ২৫৬ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হন৷ একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷
সাংবাদিক নির্যাতনে যারা যুক্ত, তাদের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, অপরাধীরা এগিয়ে৷ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে জিজিটাল আইন ছাড়াও আরো অনেক ফৌজদারি আইনে মামলা হয়৷ প্রকাশিত খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্য ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ আরো অনেক মামলার নজীর বাংলাদেশে আছে৷

আর্টিক্যাল নাইনটিনের পরিবেশন করা তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রæয়ারি মাস পর্যন্ত সারাদেশে ২২৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১০টি মামলা হয়েছে৷ এসব মামলায় মোট ৫৪ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এই সময়ে সব মিলিয়ে ৫৭৩টি মামলা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪০৪ জনকে৷ ২০১৮ সালের অক্টোবরে মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়৷

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বাংলাদেশে সাংবাদিক ও সরকারি নীতির সমালোচনাকারীদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণে উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে৷ তাদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এইচআরডাব্লিউসহ ছয়টি সংগঠনের উদ্বেগের কথা বলা হয়েছে৷ সংগঠনগুলো হলো: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ), কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন৷

বিবৃতিতে তারা বলছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে যে নির্বাচন হওয়ার কথা, তার আগে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সীমিত করায় তা মুক্ত রাজনৈতিক বিতর্কের পরিবেশকে দুর্বল করছে ৷ তারা বলছে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে আছেন৷ তারা হয়রানি, নজরদারি ও সরকার-সমর্থকদের দ্বারা শারীরিক হামলার শিকার হচ্ছেন৷ ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশে ৫৬ জন সাংবাদিক সরকার ও তার সমর্থকদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন৷

তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গত ৩০ মার্চ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাকে মধ্যরাতে আটক করা হয়৷ একই প্রতিবেদনের কারণে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়৷ পরে শামসুজ্জামান জামিনে মুক্তি পান৷

তারা বলছেন, বার্তাকক্ষগুলো আরো সেলফ সেন্সরশিপের দিকে যাচ্ছে৷ সরকারি কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট থেকে প্রতিবেদন সরাতে বলছে ৷ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অন্যান্য আইনও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন ও দণ্ডবিধির আওতায় মামলার তদন্ত চলছে৷

তারা সরকারের কাছে পাঁচটি দাবি জানিয়েছে৷ দাবিগুলো হলো- জিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল বা স্থগিত করতে হবে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনটি সংশোধন করতে হবে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতার দ্রুত, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও কার্যকর তদন্ত করতে হবে, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের কারণে যারা মামলার শিকার হয়েছেন সেইসব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার খর্ব করে এমন আইনের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে৷

আর্টিক্যাল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান ফারুক ফয়সাল বলেন, “সামনে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সংবাদমাধ্যম এবং বাক স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হচেছ৷ আমাদের অবস্থান এখন আফগানিস্তানেরও নীচে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা আছে৷ আইন আছে৷ আর বাংলাদেশে সাংবাদিকদের হয়রানি ও হেনস্থা করার আইন হয়৷ ডিএসএ তার একটি৷ সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে নড়বড়ে অবস্থায় আছে৷ তাই বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে চায়৷ কিছু প্রকাশ করতে দিতে চায় না৷”

“আমি বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে আছি৷ এখানেও বাংলাদেশের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে৷ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না, তথ্য প্রকাশ করা যাবে না০ এটা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হয় না৷ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র থাকবে না,” বলেন ফারুক ফয়সাল৷

এদিকে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব দীপ আজাদ বলেন, ” বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের এই অবস্থার জন্য শুধু সরকারকে এককভাবে দায়ী করা যাবে না৷ এখানে মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক স্বার্থসহ নানা ধরনের স্বার্থ আছে৷ সেই স্বার্থের বিরুদ্ধে সাংবাদিকরা যেতে পারেন না৷ মুক্ত গণমাধ্যমের প্রথম সমস্যা হলো মালিকপক্ষ এটাকে তাদের ব্যবসা ও স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন৷ আবার অনেক সিনিয়র সাংবাদিকের ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে৷ তারা বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের পিআর-এর কাজ করেন, তারাও খবর আটকে দেন৷ তারা মুক্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কাজ করেন৷ এর পরে আছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থা, তারাও মুক্ত গণমাধ্যমের অন্তরায়৷ বড় বড় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ আছে গণমাধ্যমের ওপর৷”

তার কথা, “এসব নিয়ন্ত্রণ ও বাধার মধ্যেও বাংলাদেশের সাংবাদিকরা মুক্ত ও স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে চান৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে চান৷ কিন্তু এর পথে প্রধান বাধা এখন জিজিটাল নিরাপত্তা আইন৷ আমরা তাই এই আইনের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছি৷ মুক্ত সাংবাদিকতার পথে যেসব আইন ও ধারা অন্তরায় আমরা সেগুলো বাতিল চাই৷”- সুত্র জার্মান বেতার ডয়চে ভেলে

সাথী / পরিচয়

শেয়ার করুন