নিউইয়র্ক     শুক্রবার, ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে অপরাজনীতি ও ‘অধর্মের’ ছত্রছায়ায় বেপরোয়া সাম্প্রদায়িকতা

বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১২:২১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৩ | ০১:৫০ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশে অপরাজনীতি ও ‘অধর্মের’ ছত্রছায়ায় বেপরোয়া সাম্প্রদায়িকতা

নির্বাচনকে অদূরে রেখে রাজনীতির ময়দানে মৃদু উত্তাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ সংখ্যালঘুদের মনেও বাড়ছে হামলার শিকার হয়ে ধর্মচর্চা বা নিজগৃহে নিরাপদে বসবাসের অধিকার হারানোর আতঙ্ক৷ এক রাতে ১৪টি মন্দিরে হামলার ঘটনায় আতঙ্কিত অনেকেই৷ এ ধরনের হামলায় কে বা কারা বেশি লাভবান হয়? এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, ‘‘রাজনৈতিক লাভের চেয়ে আর্থিক লাভই এখানে বেশি৷ সংখ্যালঘুদের উপর যত বেশি হামলা করা যাবে, তারা দেশ ছেড়ে দেবে৷ আর সেই জমি-সম্পদ আমরা দখল করে নেবো৷ এই হামলাগুলো করছে স্বার্থান্বেষী মহল৷ যে গ্রুপে সব রাজনৈতিক দলের লোকই আছে৷ এই ধরনের হামলা বন্ধে কোনো সরকারই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কখনো নেয়নি৷ ফলে এটা কমছে না ৷’’

সর্বশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাত থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডঙ্গী উপজেলার ধনতলা, চাড়োল ও পাড়িয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের ১৪টি মন্দিরে ভাংচুরের ঘটনা ঘটানো হয়েছে৷ যারা করেছেন তারা একই সময়ে একযোগে এটা করেছেন৷ বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিদ্যানাথ বর্মন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ধনতলা ইউনিয়নে ৯টি, চাড়োল ইউনিয়নে একটি এবং পাড়িয়া ইউনিয়নে চারটি মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে৷ সবচেয়ে বড় মন্দির ধনতলার সিন্দুর পিন্ডির মন্দিরের আটটি প্রতিমার সবকটিই ভেঙে ফেলা হয়েছে৷ তার উত্তর দিকে দুইটি মন্দিরের দুইটি প্রতিমা ভাঙা হয়েছে৷ এখানেই ভাঙা হয়েছে ১০টি প্রতিমা৷’’

এই ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ অপরাধীদের গ্রেপ্তারে এত সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেসন্স) হায়দার আলী খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ৷ কিছু মানুষ মাঝে মধ্যেই এটা করার চেষ্টা করে৷ কিন্তু পুলিশ প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত করে অপরাধীদের আদালতে সোপর্দ করছে৷ আমরা দেখেছি, কিছু ক্ষেত্রে জমি-জমা নিয়ে একই সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে বা আলাদা সম্প্রদায়ের মধ্যে কতিপয় মানুষ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে৷ আমরা এ ব্যাপারে সবসময় কঠোর অবস্থানে থেকে ব্যবস্থা নিয়েছি৷ মাঠ পর্যায়েও সেই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ৷’’

গত জুলাই মাসে নড়াইলের একটি কলেজের শিক্ষককে জুতার মালা পরানো নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়৷ কিছুদিন পরই নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টকে কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি বাড়ি, দোকান ও মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷ পুলিশ ওই ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলেও মূল হামলাকারী ও অগ্নিসংযোগকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি ৷

সামনে তো নির্বাচন, এখন কতটা শঙ্কায় সংখ্যালঘুরা? এ বিষয়ে হিন্দু,-বৌদ্ধ-খিস্ট্রান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘এখন তো আর মাঝে মধ্যে হামলা হয় না, প্রতিদিনই হচ্ছে৷ এসব ঘটনায় প্রশাসনকে তো আমরা কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখছি না৷ আর নির্বাচন এলে এই হামলা বেড়ে যায়৷ ফলে এখন বাংলাদেশের প্রতিটি সংখ্যালঘু শঙ্কা নিয়েই দিন পার করছেন৷ গত নির্বাচনের আগে আমরা বলেছিলাম, বিদ্যামান আইনে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না, তাই বলেছিলাম সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করতে৷ যেটা মেনে নিয়ে নিজেদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখও করেছিল বর্তমান শাসকদল৷ কিন্তু আবার নির্বাচন চলে এলো, অথচ সেই আইন তৈরির কোনো প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে আমার জানা নেই ৷’’

সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালের অক্টোবরে, দূর্গাপূজার সময়৷ কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর ওই ঘটনার জের ধরে ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনি, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলা, পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা হয়৷ মারাও যান বেশ কয়েকজন৷ ওই ঘটনায় কয়েকটি মামলার চার্জশিট দিলেও বিচার শুরু হয়নি ৷

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের কখনো কোনো হামলার বিচার বা প্রতিকার না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বরাবরই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে৷ আর এখন মূলত রাজনৈতিক অস্থির অবস্থা এবং নীতিহীন রাজনীতি এর জন্য দায়ী৷ বাংলাদেশ যতই তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থেকে সরে যাচ্ছে, ততই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন বাড়ছে৷ শাসক দলের পরিচিতি বা সমর্থন ছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ খুবই কম৷ নেই বললেই চলে৷ তাই এই ধরনের অপরাধ যারা করে, তারা সব সময়ই রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকতে চায়৷ যেহেতু এই মূহূর্তে বাংলাদেশে শাসক দলের বাইরে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির তেমন কোনো অবস্থান নেই বললেই চলে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সরকারি দল বা সরকারি দলের মধ্যে ঢুকে দুষ্কৃতকারীরা বা ওই দলের নেতা-কর্মীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে৷ এটা নীতিহীন রাজনীতির ফল ৷’’

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ বছরে হিন্দুদের উপর সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি হামলা হয়েছে৷ প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন নতুন একটা দিক আমাদের সামনে এসেছে৷ আগে তো রাজনৈতিক নেতারা সংখ্যালঘুদের উপর হামলার কথা স্বীকারই করতো না৷ এখন তারা স্বীকার করছে৷ ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনার পর মির্জা ফখরুল সাহেব বিবৃতি দিয়ে বললেন, যারা এই হামলা করেছে তারা নরকের কীট৷ আর ওবায়দুল কাদেরও একই ধরনের কথা বলেছেন৷ ফলে তারা এখন স্বীকার করছেন, কিন্তু ব্যবস্থা নিচ্ছেন না ৷’’

তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনে করে এই হামলাগুলোর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত চক্র জড়িত৷ দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেলন হক বলেন, ‘‘বিএনপি-জামায়াত চক্র অশান্তি সৃষ্টির জন্য প্রায়ই এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছে৷ আমরা শক্তভাবে এগুলো প্রতিহত করছি৷ সামনে নির্বাচন, তাই এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এই ধরনের নাশকতা করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়৷ কিন্তু আমরা প্রতিটি ঘটনায় অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের মুখোমুখি করেছি৷ ভবিষ্যতে তারা ছাড় পাবে না ৷’’

অন্যদিকে বিএনপি মনে করে, সরকারই এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত৷ দলটির সংগঠনিক সম্পাদক ইমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতে সব সময় আমাদের উপর তারা দায় চাপানোর চেষ্টা করে৷ অথচ ঠাকুরগাঁওয়ে যে ঘটনাটি ঘটে গেল, সেখানে তো পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, কারা এটা করেছে৷ কয়েকদিন আগে ওই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তো প্রেস কনফারেন্স করেই বলেছে, স্থানীয় এমপি চা বাগান করার কারণে হিন্দুদের জমি দখল করতে চায়৷ স্থানীয় এমপি যেখানে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তাহলে প্রশাসন কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? আওয়ামী লীগ মনে করে, হিন্দুরা তাদের ভোট ব্যাংক৷ আর দেশ ছেড়ে গেলে জমি তাদের৷ ফলে এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে যদি কেউ দেশ ছেড়ে যায়, তাহলেও লাভ! আর থাকলেও লাভ! তারা তো হামলা করে দুই দিক থেকেই সুবিধা ভোগ করছে৷’’-সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে, ঢাকা

শেয়ার করুন