নিউইয়র্ক     শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রাণরক্ষায় প্রাণান্ত চেষ্টা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১২:৪৫ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
প্রাণরক্ষায় প্রাণান্ত চেষ্টা

ফাইল ছবি

নগরীর মাঝে মাঝে এখানে-সেখানে যেন ছোট ছোট ইট, বালু আর সিমেন্টের টিলা। দুই দিন আগেও যেগুলো ছিল প্রাণের স্পন্দনে কম্পিত অট্টালিকা, ভূমিকম্পের আঘাতে সেগুলো এখন এমনই ধ্বংসস্তূপ। এর চারপাশে বড় বড় ক্রেনের নড়াচড়া আর মানুষের ছোটাছুটি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই ছুটছেন তাঁরা। চাইছেন, যদি বাড়তি একটি প্রাণও রক্ষা করা যায়!

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের পর দুই দিন পেরিয়ে গেল। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই দেশে নিহতের সংখ্যা ৫ হাজার ৪০০ ছাড়িয়েছে। দুই দেশের কর্তৃপক্ষের বরাতে গতকাল সিএনএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের শহরগুলোতে মারা গেছে ৩ হাজার ৭০৪ জন। আর সিরিয়ায় নিহত বেড়ে প্রায় ১ হাজার ৭০০ জনে দাঁড়িয়েছে। দুই দেশে আহত হয়েছে ২৬ হাজারের বেশি।

ধ্বংসস্তূপের যে বিস্তৃতি, তা থেকে উদ্ধারকারীদের ধারণা, এখনো বহু মানুষ চাপা পড়ে আছে। অনেক জায়গায় তাঁরা ইট-বালুর স্তূপের নিচ থেকে বাঁচার জন্য মানুষের আর্তিও শুনছেন। অসহায় হয়ে ছোটাছুটি করছেন উদ্ধারকারীরা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে তুরস্কের ১০ শহরে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলের সাংবাদিক ইব্রাহিম হাসকোলোগলু বলেন, ‘অনেক মানুষ এখনো ভবনের নিচে আটকা পড়ে আছে। তাদের সাহায্য দরকার। অনেকে আমাদের কাছে ভিডিও, খুদে বার্তা ও ভয়েস নোটের মাধ্যমে অবস্থান জানাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে জানাচ্ছে বাঁচার আকুতি। তবে অনেককেই উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা সাংবাদিকেরাও নিজেদের মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।’—কাঁপা কাঁপা গলায় এভাবেই বিবিসির প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রতিকূলতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ইব্রাহিম হাসকোলোগলু।

ভেতরে অসাড় বাইরে তুষার
সোমবারের সকালটা হাহাকারে শুরু হয়েছিল। গতকালের সকালেও সেই একই চিত্র। অ্যাডানার ১০ তলা এক ভবনের পাশে দেখা গেল দুই নারীকে। ভবনটি পুরোটাই মাটিতে মিশে গেছে। ভাঙা টুকরাগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে আছেন তাঁরা। শীতে কাঁপছেন। গায়ে জড়ানো কম্বলেও মানছে না শীত।

ভূমিকম্পের পর ধ্বংসস্তূপের নিচে অসাড় পড়ে ছিলেন। বেরিয়ে আসার পর মুখোমুখি হন প্রকৃতির আরেক বিরূপ আচরণের—তুষার। বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কের অ্যাডানা শহরের এই চিত্র।

আল জাজিরা বলছে, প্রথম ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল তুরস্কের গাজিয়ানতেপের বেশির ভাগ মানুষ এখনো ঘোর থেকে বের হতে পারছে না। মাটিতে মিশে যাওয়া বাড়ির কাছেই কোনো অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে কোনোমতো ঘুমহীন রাত কাটছে তাদের। খাওয়ার পানি আর বিদ্যুতের দেখা নেই। সামনে বিপর্যয়ের চিত্র নিয়ে চোখের পাতা এক করতে পারেনি।

বাধা আর বাধা
তুরস্কে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। এর মধ্যে উদ্ধারকারীদের কাজ আরও কঠিন করে তুলছে তুষারপাত ও বৃষ্টি। জীবিতদের উদ্ধারে উদ্ধারকারী দলগুলো তৎপরতা জোরদার করেছে। অ্যাডানা শহরে সোমবার দিবাগত রাতভর ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে উদ্ধারকাজ চলেছে। ধসে পড়া ভবন এবং কংক্রিটের বিশাল স্ল্যাবগুলো আলোকিত করে রাখছেন উদ্ধারকারীরা। দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে একই দৃশ্য।

গোটা অ্যাডানা শহরে এখন প্রায় সবাই গৃহহীন। ঘরবাড়ি টিকে গেছে এমন অনেকে আবার ভূমিকম্পের ভয়ে ঘরেও ফিরতে চাচ্ছে না। অবস্থান করছে খোলা আকাশের নিচে। পায়ে জুতা নেই, শীতের কাপড় নেই।

কেউ কোথাও নেই
তুরস্কের হাতায়া প্রদেশের বাসিন্দারা বলছেন, সেখানে অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। কিন্তু তাদের উদ্ধার করতে তেমন কেউ এগিয়ে আসছে না। ভূমিকম্পের পর থেকে এখন পর্যন্ত খুব সামান্যই সরকারি সাহায্য পাওয়া গেছে।

ডেনিজ নামের হাতায়ার এক বাসিন্দা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘মারা যাচ্ছি, মারা যাচ্ছি … ও আল্লাহ … আমাদের বাঁচাও … বাঁচাও বলে আটকে পড়া মানুষেরা চিৎকার করছিল। কিন্তু আমরা কীভাবে তাদের বাঁচাব? সকাল থেকে এখানে কেউ নেই (সরকারি উদ্ধারকর্মী)।’

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের কারণে হাতায়া প্রদেশের প্রধান বিমানবন্দরের রানওয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে।

মিডল ইস্ট আই নিউজের তুরস্কের ব্যুরোপ্রধান রাগিপ সোয়লু এক টুইটার পোস্টে বলেছেন, ‘প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু উদ্ধারকারীরা এখনো সেখানে (হাতায়া প্রদেশে) পৌঁছাতে পারেননি। শহর থেকে যারা কথা বলে, তারা শুধু নাকি কান্না করতে পারে। এটাই তাদের একমাত্র কাজ। এ ছাড়া তারা আর কিছু পারে না।’

জীবন বাঁচাতে আসছে বিশ্ববাসী
ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজে তুরস্ক ও সিরিয়ার পাশে দাঁড়াচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশ। পাঠানো হচ্ছে মানবিক সহায়তা। অনেক দেশের সাহায্য গতকালও পৌঁছাতে পারেনি। এর কারণ বিরূপ আবহাওয়া।

এরই মধ্যে কাতার জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্তদের থাকার জন্য ১০ হাজার মোবাইল হোম দেবে দেশটি। পাঠানো হবে ১২০ জন উদ্ধারকারী। আহতদের চিকিৎসার জন্য একটি ফিল্ড হাসপাতালও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। যুক্তরাজ্যের অনেকে মানবিক সহায়তা নিয়ে তুরস্কে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।

সিরিয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি সহায়তা গ্রুপকে আরও ১০ লাখ ইউরো দিচ্ছে জার্মানি। মানবিক সহায়তা আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে দেশটি।

শঙ্কায় শিশুরা
গত সোমবার জোড়া ভূমিকম্প ও পরাঘাতে দুই দেশের হাজারো শিশু নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। সংস্থাটির মুখপাত্র জেমস এলডার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ শঙ্কার কথা জানান। তবে তাঁরা নিহতের সঠিক সংখ্যাটি জানাতে পারেননি।

বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। সিরিয়া ও তুরস্কে অনেক পরিবারকে তাদের সন্তানদের খুঁজতে দেখা গেছে। আর কাঁদতে কাঁদতে বাবা-মাকে খুঁজতে দেখা গেছে হাজারো শিশুকে। এদের অনেকেই জানেও না, তাদের বাবা-মা আর বেঁচে নেই।

গত সোমবার ভোরে তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। কয়েক ঘণ্টা পরই আরেকটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। উৎপত্তিস্থল ছিল তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশ। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫।

শেয়ার করুন