নিউইয়র্ক     সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পড়ে আছে শুধু হাড়গোড়, ম্লান হয়ে আসছে আশা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০২:০৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০২:০৯ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
পড়ে আছে শুধু হাড়গোড়, ম্লান হয়ে আসছে আশা

তুরস্কে ভূমিকম্পের এক সপ্তাহ হলো আজ সোমবার। স্বজনদের জীবিত পাওয়ার আশাও হয়ে আসছে ক্ষীণ, বাড়ছে আহাজারি। ছবি: এএফপি

গত সপ্তাহে তুরস্কে ভূমিকম্প আঘাত হানার পর এরদেম আভসারোগ্লুর বোন, তাঁর স্বামী এবং তাঁদের দুই সন্তান আটকা পড়েন আন্তাকায় ধসে পড়া অ্যাপার্টমেন্টে। তবুও তাঁরা জীবিত ছিলেন এবং উদ্ধারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। এর দেড় দিন পরের রাতে ধ্বংসস্তূপের গভীরে একটি জেনারেটর থেকে আগুন লাগে। ফায়ার ফাইটার আভসারোগ্লুর চোখের সামনেই সেই আগুন জ্বলে ঘণ্টা খানিক ধরে। এরপর ধ্বংসাবশেষ থেকে আর কারও বাঁচার আকুতি আসেনি। প্রায় পাঁচ দিন পরও গতকাল রোববার ভবনের অবশিষ্টাংশ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে।

এখন উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপটি সরিয়ে ফেলার কাজ করছেন। তবে আভসারোগ্লু আটকে পড়া পরিবারের কাউকেই জীবিত পাওয়ার আশা করছেন না। তিনি বলেন, ‘এখন সপ্তম দিন, সবাই ক্লান্ত, আমরা শুধু এক টুকরো লাশ খুঁজে পেতে চাই। কিন্তু আমরা কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। তাঁরা হয়তো আগুনে পুড়ে গেছে।’ আভসারোগ্লু আরও বলেন, ‘এই ব্লকে প্রায় ৮০ জন লোক বাস করতেন। অগ্নিকাণ্ডের আগে ২১ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছিল এবং ১২ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। বাকি ৪৭ জন এখনো নিখোঁজ। উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলোর অবস্থা বেদনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছু পরিবার শুধুমাত্র আগুনের কারণে হাড়গোড় সংগ্রহ করেছে।’

নির্মাণের ১০ বছরের মাথায় বিল্ডিংটি ভেঙে পড়া নিয়ে স্থানীয় উদ্ধারকর্মী এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন, আশপাশের অনেক পুরোনো ভবনগুলো যখন দাঁড়িয়ে ছিল তখন নতুন ভবনটি ভেঙে পড়ে কীভাবে? তবে উদ্ধারকারীরা ভবনটির নিচতলার সুপারমার্কেট থেকে গুরুত্বপূর্ণ কলাম সরিয়ে দেওয়ার প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। এদিকে ভূমিকম্পের পর রাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্ধারকাজে ধীর গতি ছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান গত বুধবার দেশটির ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণাঞ্চল পরিদর্শনের পর এ কথা স্বীকার করেন।

আরেক উদ্ধারকারী সেরহাত দেদে। তিনি ধ্বংসাবশেষ থেকে বেশ কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের উদ্ধার করলেও নিজের বাবার লাশও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষে দাঁত দেখে বাবার লাশ শনাক্ত করেন। সেরহাত দেদে বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। যদি আমাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করত তাহলে আমরা ৪০-৫০ জনকে বাঁচাতে পারতাম।’

আজ সোমবার পর্যন্ত ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তুরস্কে ৩০ হাজারের কাছাকাছি এবং সিরিয়ায় সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি। ঐতিহাসিকভাবে অ্যান্টিওক নামে পরিচিত প্রাচীন শহর আন্তাক্যাতে, সর্বত্র ধসে পড়া ভবনগুলির মধ্যে ধ্বংসের মাত্রা বোঝা কঠিন। দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় প্রতিটি ভবনেই ফাটল, ভয়ংকরভাবে বিকৃত অথবা ঝুঁকিপূর্ণভাবে হেলে পড়েছে। ভেঙে পড়া ভবনগুলো এক দুঃখময় স্মৃতিকাতর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কোথাও পড়ে আছে হাস্যোজ্জ্বল পরিবারের ফটোগ্রাফ, কোনো বাথরুমের দেয়ালে ঝুলে আছে জ্যাকেট ও কোনো আলমারিতে শিশুর খেলনা। ফলে বেশির ভাগ মানুষ শহর ছেড়ে গেছেন। তবে এখনো কেউ কেউ গাড়িতে বা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের রয়েছেন।

অগ্নিকাণ্ডের পরের দিনগুলোতে আভসারোগ্লু এবং অন্যরা লুটেরাদের হাত থেকে তাঁর বোনের বিল্ডিংকে রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু গতকাল রোববার থেকে সেনাবাহিনী রাস্তায় টহল দিচ্ছে। আপাতত নিরাপত্তা ফিরে এসেছে।

তবে এখনো ধ্বংসস্তূপের আশপাশে অ্যাম্বুলেন্সগুলো ঘুরছে। জীবিত উদ্ধার আশা এখনো সবাই ছেড়ে দেননি। কিন্তু এই ধরনের উদ্ধার ক্রমশ বিরল হয়ে উঠেছে। আন্তাক্যায় ভবনের ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধানকারী একটি ভারতীয় দলের একজন উদ্ধারকারী বলেছেন যে তাঁরা চার দিন আগে তুরস্ক এসেছেন। আসার পর থেকে তাঁরা কেবল মরদেহই উদ্ধার করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় ওই উদ্ধারকর্মী আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত, আমরা জীবিত কাউকে খুঁজে পাইনি। আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’ যখন তিনি কথা বলছিলেন, তখন অন্য স্থানে লাশ পাওয়া গেছে বলে সহকর্মীদের কাছ থেকে একটি কল আসে। এ সময় রাস্তায় শোকে কাতর এক মহিলা মাথা নিচু করে লাশের ব্যাগের পাশে বসেছিলেন।

‘আমাদের মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে’
আন্তাক্যায় উপকূল থেকে একটু ওপরে ইস্কেন্দারুনে ছোট্ট টেক্সটাইলের দোকান ছিল সেরিজান আগবাসের। তিনি এ দোকান ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চালিয়ে আসছিলেন। এখন তা পাঁচ তলার মতো উঁচু ধ্বংসস্তূপের নিচে। এই এলাকার ১০০ জন নিখোঁজ বলেও জানিয়েছেন তিনি। সেরিজানের অ্যাপার্টমেন্ট এখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও তাতে ফাটল ধরেছে এবং অনিরাপদ। বিল্ডিং থেকে আগবাস এবং তাঁর কিছু প্রতিবেশী জানিয়েছেন, তাঁদের তাঁবু এবং অন্যান্য সহায়তা প্রয়োজন।

সেরিজান বলেন ‘আমাদের পুরো সম্প্রদায়ের জন্য মানসিক সাহাজ্য দরকার। সরকারের কাছ থেকে আমরা কেউ কিছু আশা করছি না। আমাদের নিজেদেরই সবকিছু ঠিক করতে হবে। এদিকে সরকার জোর দিয়ে বলেছে, দুর্যোগের মাত্রা বিবেচনা করে তাঁরা সবকিছুই করছে। এই ভূমিকম্প বিশাল এলাকা জুড়ে হয়েছে যা ব্রিটেনের আকৃতির। এতে আনুমানিক ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আগামী এক বছরের মধ্যে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকা পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

শেয়ার করুন