নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চিপ খাতে নিষেধাজ্ঞা

নিজস্ব সক্ষমতার পথে চীন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৩ | ০৯:০৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৩ | ০৯:০৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
নিজস্ব সক্ষমতার পথে চীন

ছবি: সংগৃহীত

নিরাপত্তাজনিত কারণে চীনের কাছে প্রযুক্তিপণ্য সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে সংশ্লিষ্ট উৎপাদক দেশগুলোর সঙ্গে চীন প্রযুক্তিপণ্য নিয়ে কোনো চুক্তি করতে পারছে না। নিষেধাজ্ঞার জবাবে চীনও বিভিন্ন বিষয়ে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। চিপ সংকট বৈশ্বিক পর্যায়ে প্রভাব ফেলতে পারে। কোনো পদক্ষেপই আপাতত চীনের ক্ষতি পোষাতে সক্ষম নয়। তবে নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় দীর্ঘমেয়াদে চীন এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গিজমো চায়নায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে চীনের কাস্টমস বিভাগের বরাতে বলা হয়, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশটির ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) আমদানি আগের বছরের তুলনায় ১৮.৫ শতাংশ কমেছে। বাজারসংশ্লিষ্টদের শঙ্কা এর ফলে দেশটির সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ চেইনে সমস্যা তৈরি হবে। দেশটির জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে চীনের ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট আমদানি ২২ হাজার ৭৭০ কোটি ইউনিটে নেমে এসেছে। ২০২২ সালের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৯৬০ কোটি ইউনিট। সার্বিকভাবে দেশে বৈদ্যুতিক উপাদানের যে চাহিদা তৈরি হয়েছে তা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে চীন। চিপ আমদানিতে দেশটির ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বছরের প্রথমার্ধে এর পরিমাণ ২২.৪ শতাংশ কমে ১৬ হাজার ২৬০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।

চিপ আমদানিতে চীন যে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে সেটি নিশ্চিত করে যে, ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিবাজারে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তার কারণে চীন উন্নত চিপ পাচ্ছে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ফাইভ-জি টেলিযোগাযোগ ও উচ্চ ক্ষমতার কম্পিউটিংয়ের জন্য এ চিপ প্রয়োজন।

এদিকে চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি শ্লথ হয়েছে। দেশটিতে চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থনীতিতে বেশ ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বেকারত্বের হার কমানো ও অর্থনৈতিক অবস্থার পুনরুদ্ধার করার বিশাল চাপ পড়েছে চীনা কর্তৃপক্ষের ওপর। এ বাস্তবতায় যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত দেশটির ঋণ এবং কাঠামোগত পরিস্থিতির জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। গত ১৭ জুলাই চীনের ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্সের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, গত এপ্রিল-জুনে দেশটিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে আগের ত্রৈমাসিকের তুলনায় ০.৮ শতাংশ বেশি। বার্ষিক হিসাবে দেশটিতে জিডিপি ৭.৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস থাকলেও এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৩ শতাংশ।

সিডনির কমনওয়েলথ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিবিদ ক্যারল কং বলেন, ‘এসব তথ্যে বোঝা যায়, চীনের কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক উল্লম্ফন এখন আর নেই।’ অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর জন্য বড় প্রকল্পে অর্থ ব্যয়, ভোক্তা ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য আরও সহায়তা, সম্পত্তি নীতি সহজীকরণসহ আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদেরা। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।

সিঙ্গাপুরের আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটসের এশিয়া এফএক্স স্ট্র্যাটেজির প্রধান আলভিন ট্যান বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬.৩ শতাংশ বেশ হতাশাজনক সংখ্যা এবং স্পষ্টতই চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই মন্থরগতি জিডিপির ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জরুরি ভিত্তিতে নীতি পরিবর্তন করা উচিত।’

বেশিরভাগ বিশ্লেষক বলছেন, ক্রমবর্ধমান ঋণের ঝুঁকি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নীতিনির্ধারকেরা সীমিত আকারে নীতি পরিবর্তন করছে, যেন কোনো সিদ্ধান্ত আক্রমণাত্মক না হয়। এ অর্থনৈতিক মন্থর অবস্থার কারণে অনেকেই চাকরি হারাতে পারে এবং জ্বালানি মুদ্রাস্ফীতিজনিত ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, যা বেসরকারি খাতের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, এই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার জন্য জমার অনুপাত রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট রেশিও (আরআরআর) ও মধ্যমেয়াদি ঋণ সুবিধার মতো নীতি অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির হার গত মাসে ৪.৪ শতাংশে পৌঁছেছে; কিন্তু কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এখনো যথেষ্ট আড়ষ্ট।

প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে চীন এখন অনেক এগিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক ও দৈনন্দিন প্রযুক্তি, সব আছে হাতের কাছে। চীনের কাস্টমস বিভাগ চিপ উৎপাদনে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণের কথা জানিয়েছে। চীন অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো এবং বিদেশনির্ভরতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজস্ব পর্যায়ে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন বাড়াতে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে চীন সরকার। পাশাপাশি সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন কেন্দ্র বাড়াতেও কাজ করছে।

প্রযুক্তিবিদদের মতে, নিজস্ব উদ্যোগে চিপ উৎপাদনের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হতে আরও সময় লাগবে চীনের। সে পর্যন্ত প্রযুক্তি খাতের চাহিদা পূরণে দেশটিকে হিমশিম খেতে হবে। আইসি আমাদানিতে চীন যে সমস্যার মধ্যে রয়েছে সেটি দেশটির অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার বিষয়টিকে নিশ্চিত করে।

ইতোমধ্যে সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে গ্যালিয়াম ব্যবহার করা হয়। চিপ উৎপাদনে ব্যবহৃত এ ধাতু রপ্তাানি বন্ধের কথা জানিয়েছে চীন। বর্তমানে উৎপাদনকাজে যেসব বিশেষ ধাতু ব্যবহার করা হয় সেগুলোর অধিকাংশই চীনের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্লেষকদের মতে, চীনের এ নিষেধাজ্ঞা প্রযুক্তি খাতে চলমান যুদ্ধে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জরিপ অনুযায়ী, চীন ৯৪ শতাংশ গ্যালিয়াম ও ৮৩ শতাংশ জার্মেনিয়াম সরবরাহের সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালে দেশটি ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের গ্যালিয়াম আমদানি করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, চীনের এ নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘমেয়াদে পশ্চিমাদের জন্য তেমন ক্ষতিকর হবে না। তবে পশ্চিমাদের তৈরি সেমিকন্ডাক্টর খাতের অগ্রগতি কমানোই এর প্রধান লক্ষ্য। বিকল্প মাধ্যম থেকে গুরুত্বপূর্ণ এসব ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিত করতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এ সময়ে চীন নিজস্ব উৎপাদন বাড়িয়ে নিতে চাইছে। টিএসএমসি ও স্যামসাং বর্তমানে উন্নতমানের চিপ উৎপাদনে সক্ষম, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ফাইভ-জি বা এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে ব্যবহার করা হয়। চীন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ দুটি কোম্পানির মতো উন্নতমানের চিপ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। সূত্র : সাম্প্রতিক দেশকাল

শেয়ার করুন