নিউইয়র্ক     শনিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইমরান খানকে টিকতে হলে জেনারেলদের মন যোগাতে হবে-রয়টার্সের বিশ্লেষণ

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৩ | ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৭ মে ২০২৩ | ০৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ইমরান খানকে টিকতে হলে জেনারেলদের মন যোগাতে হবে-রয়টার্সের বিশ্লেষণ

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানফাইল ছবি : এএফপি

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ পার্টির নেতা ইমরান খানের অনুসারীরা দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনীর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অভূতপূর্ব এ ঘটনার পর সেনাবাহিনী পাল্টা ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। পারমাণবিক ক্ষমতাধর দেশটির সেনাবাহিনীর একসময়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ইমরান খান ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী এখন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। মাসের শুরুতে দুর্নীতির অভিযোগে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর অভিযোগ, তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন জেনারেলরা। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেনা স্থাপনা, জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের বাসভবন লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা ঘটে। এ জন্য দায়ী করা হয় ইমরানের সমর্থকদের।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আগে কখনো এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকে দেশটির সেনাবাহিনী ভয় ও শ্রদ্ধার মিশ্রণে দেশটিতে আধিপত্য ধরে রেখেছে। তিন দশক ধরে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় থাকার পাশাপাশি বেসামরিক সরকারের ওপরেও প্রভাব বিস্তৃত করেছে। পাকিস্তানের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও আমলা নাঈম খালিদ লোধি বলেন, ‘আমি ঢাকার পতন দেখেছি। এরপরে অবশ্যই সেনাবাহিনীর আরও বিরোধিতা দেখেছি। কিন্তু এত তীব্র চ্যালেঞ্জ আগে দেখিনি।’

পুলিশি পাহারায় ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ইমরান খানফাইল ছবি : এএফপি

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ও বাংলাদেশের জন্ম হওয়া পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর থেকে দেশটির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় পরাজয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পর বেসামরিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি পাঁচ বছর সেনাবাহিনীর ওপর আধিপত্য ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তবে ১৯৭৭ সালে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সেনাবাহিনী এরপর ১১ বছর ক্ষমতা ধরে রাখে। সামরিক শাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়াউল হক ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের দুই দিন পরেই আদালত তাঁকে জামিন দেন। তবে পিটিআই নেতা–কর্মীরা এর পর থেকে সেনাবাহিনীর ক্ষোভের মুখে পড়েছেন। দেশটির হাজারো নেতা–কর্মীকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও রয়েছেন।

দেশটির সরকার বলছে, যাঁদের আটক করা হয়েছে, তাঁরা বিভিন্ন সরকারি ও সামরিক স্থাপনায় হামলায় জড়িত। তাঁদের সামরিক আদালতে বিচার হবে। সামরিক আদালতে মূলত রাষ্ট্রের শত্রুদের বিচার করা হয়ে থাকে। বর্তমানে পাকিস্তানের বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনী ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার মধ্যে ক্ষমতার প্রদর্শন ২২ কোটি জনসংখ্যার দেশটিকে চরম বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিতে পারে। দ্য ব্যাটল অব পাকিস্তান বইয়ের লেখক ও আটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের সম্মানিত ফেলো সুজা নওয়াজ বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের সামরিক শক্তি জাহির করার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে কঠোর সেনা আইন প্রয়োগের চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে তারা দেশটির নাজুক সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ বিষয়ে দেশটির সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

ইমরান খানের বাজি

এ কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শক্তির কাছে দেশটিক কোনো বেসামরিক সংস্থা দাঁড়াতে পারেনি। দেশটির নির্বাচিত কোনো সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ পার করতে পারেনি। ইমরান খান এ থেকে বেরোতে পারবেন, এমনটা ভাবার কারণ নেই। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ৭০ বছর বয়সী ইমরান খান। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন তিনি। খেলার মাঠে তাঁর আগ্রাসী, অপরাজেয় মনোভাব তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও টেনে এনেছেন।

ইমরানের বিরোধীদের অভিযোগ, রাজনীতির মাঠে দীর্ঘদিন ধরে বেশি কিছু করতে পারেননি ইমরান। তবে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়েই ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। তবে গত বছর অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরান অভিযোগ করেন, তাঁকে সরানোর পেছনে দেশটির সাবেক সেনাপ্রধানের হাত রয়েছে। অর্থাৎ যে সেনাপ্রধানের হাত ধরে তিনি ক্ষমতায় আসেন, তাঁর বিরুদ্ধেই অভিযোগ তোলেন তিনি। তবে ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পেছনে কোনো ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করে দেশটির সেনাবাহিনী।

পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের নেতৃত্বে লংমার্চ করছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের নেতা–কর্মীরাফাইল ছবি : এএফপি

ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর থেকে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু করেন ইমরান। তাতে তিনি কর্মী–সমর্থকদের উদ্বুদ্ধ করেন। অনেক বিশ্লেষক বলেন, সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তার সমর্থন রয়েছে তাঁর প্রতি। দ্য আর্মি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি ইন পাকিস্তান বইয়ের লেখক ও শিক্ষাবিদ আকিল শাহ বলেন, ‘ইমরান খান তাঁর অপসারণ ঘিরে কর্মী–সমর্থকদের অসন্তোষকে অস্ত্রে রূপ দিয়েছেন।’ ইমরান খানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রয়েছে। স্থানীয় জরিপ অনুযায়ী, প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন তিনি। এ বছরের নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

অবশ্য নানা দিক থেকে ইমরান খানের দুর্বলতাও রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর বেশ কয়েকটিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদ উসকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব মামলার কারণে তাঁকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করার ঝুঁকি রয়েছে। সেনাবাহিনীর বিশাল গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক পিটিআই নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। ইমরান খান অভিযোগ করেছেন, সেনাবাহিনীর চাপে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন নেতা পিটিআই ছেড়েছেন।

সামনে এগোনোর পথ

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেনাবাহিনী ও ইমরান খানের মধ্যে আলোচনা জরুরি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বেসামরিক সরকার পরিস্থিতি সামলাতে পারে। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকেও আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার কোনো লক্ষণ নেই। ইমরান খান অবশ্য শাহবাজ শরিফের সরকারকে গুরুত্বহীন বলে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। দেশটির তথ্যমন্ত্রী মরিয়ম আরঙ্গজেব বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ইমরানের সমর্থকেরা স্পর্শকাতর সেনা স্থাপনায় হামলা করেছেন। আইন তার নিজস্ব পথে চলবে। ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ জুলফিকার বুখারি বলেন, পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলেও কোনো জবাব মেলেনি। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত কেউ কথা শুনতে চান না।

ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরে পুলিশের সঙ্গে পিটিআইয়ের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষছবি : রয়টার্স

বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করছেন, ইমরান খানকে টিকে থাকতে হলে জেনারেলদের শান্ত করতে হবে। অন্যরা বলেন, সেনাবাহিনী ক্ষুব্ধ হয়েছে। তারা পিছু হটবে না। শিক্ষাবিদ আকিল শাহ বলেন, পাকিস্তানের ক্ষমতা বন্দুকের গুলির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শিগগিরই ইমরান খানকে দেওয়া দাবড়ানি বন্ধ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে ওয়াশিংটনের হাডসন ইনস্টিটিউটের শিক্ষাবিদ হুসেইন হাক্কানি বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান হারিয়েছে। তারা কোনো আক্রমণ বা কটূক্তি মেনে নেবে না। হুসেইন হাক্কানি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আসে ক্ষমতার প্রদর্শন করে, জনপ্রিয়তা দিয়ে নয়। পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা চান, লোকজন তাঁদের পছন্দ করুক। তবে তাঁদের আরও বেশি পছন্দ লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করা।’রয়টার্স

সাথী/পরিচয়

শেয়ার করুন