নিউইয়র্ক     বৃহস্পতিবার, ১৬ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউরোপীয়রা দরিদ্র হচ্ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৩ | ১১:১১ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৩ | ১১:১১ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
ইউরোপীয়রা দরিদ্র হচ্ছে

প্যারিসের একটি রেস্তোরাঁ। ছবি: ব্লুমবার্গ নিউজ

অবসর সময়কে গুরুত্ব দেওয়া বয়স্ক জনসংখ্যা অর্থনৈতিক স্থবিরতা মঞ্চ প্রস্তুত করেছেন। এরপর এসেছে কোভিড-১৯ মহামারি এবং রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপীয়রা নতুন এক অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে, যে অভিজ্ঞতা তারা গত কয়েক দশকের মধ্যে পায়নি। তারা দরিদ্র হচ্ছে। ইউরোপ মহাদেশের জীবনধারাকে ‘জীবনযাপনের শিল্প’ হিসেবে ঈর্ষা করতেন বহিরাগতরা। কিন্তু ইউরোপীয়দের ক্রয় ক্ষমতা কমতে থাকায় দ্রুত তারা এই ঔজ্বল্য হারাচ্ছে।

ফরাসি কম ফুয়া গ্রা (হাঁসের কলিজার বিশেষ খাবার) খাচ্ছে এবং কম লাল ওয়াইন পান করছে। স্প্যানিয়ার্ডরা ওলিভ তেল ব্যবহারে কৃচ্ছতা দেখাচ্ছে। ফিনদের আহ্বান জানানো হয়েছে বাতাস থাকা দিনগুলোতে যখন বিদ্যুৎ কম ব্যয়বহুল তখন সনাজ (উষ্ণতা উপভোগের বিশেষ কক্ষ) ব্যবহার করতে। জার্মানিজুড়ে মাংস ও দুধ ভোগ তিন দশকের মধ্যে তলানিতে পৌঁছেছে এবং এক সময় দ্রুত ছড়ানো ওর্গানিক খাবারের বিক্রি একেবারে কমে গেছে। ইতালির অর্থনৈতিক উন্নয়নমন্ত্রী আডোলফো উরসো মে মাসে দেশটির জনপ্রিয় খাবার পাস্তার চড়া মূল্য নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক করেছেন। দেশের জাতীয় মূল্যস্ফীতির তুলনায় দ্বিগুণের বেশি মূল্যবৃদ্ধির পর এই বৈঠক হয়েছিল।

ভোগ ব্যয় কমে যাওয়াতে ইউরোপ বছরের শুরুতে মন্দার দ্বারপ্রান্তে ছিল, চলতি শতাব্দীর শুরুতে যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক হ্রাসের ধারণার সূত্রপাত হয়েছিল তা আবার ফিরে আসে তাদের মনে।

ইউরোপের এই কঠিন পরিস্থিতি দীর্ঘ দিনে তৈরি হয়েছে। বয়স্কদের অবসর সময় কাটানোতে আগ্রহ এবং কর্মসংস্থানের সুরক্ষা থাকা বছরের পর বছর ধরে অর্থনৈতিক ও উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি দুর্বল ছিল। এরপর আসে একে একে দুটি বড় ধাক্কা, কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাশিয়ার যুদ্ধ। এই দুই সংকটে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন এলেমেলো হয়ে যায়, জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম হয় আকাশ ছোঁয়া। কয়েক দশক ধরে চলমান নিম্নধারা এই দুই সংকটে আরও তীব্র হয়।

সরকারগুলো শুধু জটিল সমস্যা মোকাবিলায় উদ্যোগ নেয়। কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে তারা প্রথমত নিয়োগকর্তাদের ভর্তুকি দেয়, যখন মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা এসে লাগে তখন ভোক্তাদের হাতে নগদ অর্থ ছিল না। বিপরীতে, মার্কিনিরা ইউরোপীয়দের তুলনায় সস্তায় জ্বালানি এবং সরকারি সহযোগিতা সরাসরি নাগরিকদের হাতে পৌঁছার সুবিধা পেয়েছে। এর ফলে তাদের ব্যয় অব্যাহত থাকে।

অতীতে এমন পরিস্থিতিতে মহাদেশটির শক্তিশালী রফতানি খাত হয়ত উদ্ধারে এগিয়ে আসত। কিন্তু ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ বাজার চীনা অর্থনীতির ধীরগতির পুনরুদ্ধার সেই প্রবৃদ্ধির কার্যকারিতা কমিয়ে দিচ্ছে। জ্বালানির চড়া দাম এবং ১৯৭০ দশকের পর অদেখা মূল্যস্ফীতির মাত্রা আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদনকারীদের মূল্যের সুবিধা এবং শ্রমিক সম্পর্ককে নাজুক করে দিয়েছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য যখন স্থিতিশীল হচ্ছে তখন ইউরোপকে ব্যাপক রফতানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। যা ইউরোজোনের জিডিপির ৫০ শতাংশ, বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের এই হার ১০ শতাংশ। ক্রমেই এটি মহাদেশটির দুর্বলতায় পরিণত হচ্ছে।

প্যারিসভিত্তিক ধনী দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকনোমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর তথ্য অনুসারে, ২০ দেশের ইউরোজোনে ২০১৯ সালে মূল্যস্ফীতি সমন্বয়ের পর ব্যক্তিগত ভোগের হার ১ শতাংশ কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাসা-বাড়িগুলো যখন শক্তিশালী শ্রমবাজার ও আয়ের বৃদ্ধি দেখছে, যা বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। মোট বৈশ্বিক ভোগ ব্যয়ের ১৮ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ)। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে তা ২৮ শতাংশ। পনেরো বছর আগে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র মোট ভোগ ব্যয়ের প্রায় ২৫ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করত।

ওইসিডি’র তথ্য অনুসারে, জার্মানিতে ২০১৯ সাল থেকে সমন্বিত মূল্যস্ফীতি এবং ক্রয় ক্ষমতা, মজুরি কমেছে ৩ শতাংশ, ইতালি ও স্পেনে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং গ্রিসে ৬ শতাংশ। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ৬ শতাংশ।

মধ্যবিত্তের জন্য এই দুর্ভোগ অনেক ভয়াবহ আকারে এসেছে। ইউরোপের অন্যতম ধনী শহর ব্রাসেলসে শিক্ষক ও নার্সরা অর্ধেক মূল্যের মুদি সামগ্রী সংগ্রহ করতে একটি ট্রাকের পেছনে সারিতে দাঁড়িয়েছিলেন। হ্যাপি আওয়ার্স মার্কেট নামের বিক্রেতা সুপারমার্কেট থেকে ও নিজেদের অ্যাপে বিজ্ঞাপন দিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণের কাছাকাছি থাকা খাদ্য পণ্য সংগ্রহ করে। ক্রেতারা দুপুরে অর্ডার দিয়ে সন্ধ্যায় ছাড়কৃত মূল্যে তা সংগ্রহ করতে পারে।

একই ধরনের সেবা অঞ্চলটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এই সেবা দাতারা নিজেদের খাবারের অপচররোধকারী ও অর্থ সাশ্রয়ী হিসেবে হাজির করছে। ২০১৫ সালে ডেনমার্কে প্রতিষ্ঠিত টুগুডটুগো নামের কোম্পানিটি খুচরো বিক্রেতা ও রেস্তোরাঁ থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার সংগ্রহ করে। ইউরোপজুড়ে তাদের ৭৬ মিলিয়ন নিবন্ধিত ব্যবহারকারী রয়েছে। ২০২০ সালের শেষের তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। জার্মানিতে ২০১৭ সালে সারপ্লাস নামে একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা খাবার ‘উদ্ধারের’ প্রস্তাব দিচ্ছে। এমনকি মেয়াদোত্তীর্ণ খাবারও তারা অনলাইনে বিক্রি করছে। ২০১৪ সালে সুইডেনে গঠিত মটাটোস নামের কোম্পানিটি এখন ফিনল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক ও যুক্তরাজ্যে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে।

উচ্চমূল্যের মুদিপণ্যে ব্যয়ে ধস নেমেছে। ২০২২ সালে জার্মানরা মাথাপিছু ৫২ কিলোগ্রাম মাংস ভোগ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ কম এবং ১৯৮৯ সালে পরিসংখ্যান রাখা শুরুর পর যা সর্বনিম্ন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হ্রাসের পেছনে স্বাস্থ্য সম্মত খাবার গ্রহণ ও প্রাণীর কল্যাণ নিয়ে সামাজিক উদ্বেগের প্রতিফলন থাকলেও প্রবণতাটি বেড়েছে মূলত সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মাংসের মূল্য ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে। ফেডারেল ইনফরমেশন সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচার-এর তথ্য অনুসারে, জার্মানরা গরু এবং বাছুরের মাংসের বদলে কম দামি হাঁস-মুরগির মাংসের দিকে ঝুঁকছে।

ব্যয় কম এবং দুর্বল জনতাত্ত্বিক প্রত্যাশার কারণে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ইউরোপ এখন কম আকর্ষণীয়। ভোগ্য পণ্য জায়ান্ট প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল থেকে শুরু করে বিলাসী সাম্রাজ্য এলভিএমএইচ এখন তাদের বিক্রির বড় অংশ পাচ্ছে উত্তর আমেরিকা থেকে।

এপ্রিলে ইউনিলিভারের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা গ্রায়েম পিটকেথলি বলেছিলেন, ইউরোপের তুলনায় মার্কিন ভোক্তাদের সহনশীলতা বেশি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরের ডলারের হিসাবে ইউরো জোনের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ শতাংশের বেশি। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের এই হার ৮২ শতাংশ। ব্রাসেলসভিত্তিক স্বাধীন থিংক ট্যাংক ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল ইকনোমি-এর চলতি মাসের প্রতিবেদন অনুসারে, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো ও মিসিসিপি বাদে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের তুলনায় ইইউ দেশগুলো দরিদ্র। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ-এর মাথা পিছু অর্থনৈতিক উৎপাদনের ব্যবধান এত বেশি হবে বর্তমানে যেমনটি আছে জাপান ও ইকুয়েডরের। সূত্র: ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল

শেয়ার করুন