নিউইয়র্ক     শনিবার, ৬ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ২২শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সঙ্গীতজ্ঞ মুত্তালিব বিশ্বাসকে সাহিত্য একাডেমির পক্ষ হতে সম্বর্ধনা প্রদান

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪ | ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪ | ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
সঙ্গীতজ্ঞ মুত্তালিব বিশ্বাসকে সাহিত্য একাডেমির পক্ষ হতে সম্বর্ধনা প্রদান

গত ২৮ জুন জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’র মাসিক সাহিত্য আসরটি। পুরো আসর সঞ্চালনায় ছিলেন একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন। এবারের আসর দু’টি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম পর্বে সঙ্গীতজ্ঞ মুত্তালিব বিশ্বাসকে সাহিত্য একাডেমির পক্ষ হতে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। দ্বিতীয় পর্বে ছিল একাডেমির নিয়মিত আয়োজন, স্বরচিত পাঠ, সাহিত্য আলোচনা, পাঠের জন্য বই বিতরণ ও বই আলোচনা।

মুত্তালিব বিশ্বাসকে নিবেদন করে রবীন্দ্রনাথের ‘স্মরণ’ কবিতাটি আবৃত্তিকার পারভীন সুলতানার আবৃত্তির মধ্য দিয়ে আসরের সূচনা হয়। মুত্তালিব বিশ্বাসের পরিচিতি পাঠ করেন, কবি বেনজির শিকদার। তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান, রাহাত কাজী শিউলি, এবং তাঁকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সাংবাদিক সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ ও সাংবাদিক, লেখক মঞ্জুর আহমদ।

মুত্তালিব বিশ্বাস বলেন, আমার আব্বা অর্থ সম্পদে বলীয়ান না হলেও আমাকে অমূল্য কিছু উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, জীবনে অন্যের চিঠি বিনা অনুমতিতে পড়বেনা, এমনকি সে চিঠি যদি পোস্ট কার্ডেও লেখা হয়। কখনো আড়ি পেতে অন্যের কথা শুনবে না। যা তুমি নিজে অর্জন করো নি এমন ধন উপভোগের কোনো অধিকার তোমার নেই। এমন অনেক উপদেশের মধ্যে কয়েকটি আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম। তো, তাঁর উপদেশগুলো আমি মেনেও চলেছি, কিন্তু আজ মানতে পারলাম না। সাহিত্য একাডেমিতে এতক্ষণ ধরে আপনারা যা বলেছেন আমি এগুলো করি নি, কিন্তু চুপচাপ বসে থেকে উপভোগ করতে হলো। মা যখন তাঁর অবোধ সন্তানকে কোলে নিয়ে আমার সোনা, মাণিক বলে আদর করেন, সেই অবোধ সন্তান সোনা, মানিকের অর্থ না বুঝেও শুনতে হয়। কিন্তু মা যাকে সোনা বলছে সে সোনা নয়, এই কথা যেমন সত্য, তেমনি মা যাকে সোনা বলছে সেটির মধ্যেও কোন গরমিল নেই। নিজের অনুভূতি হতে বলছি, যত দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে সাহারা মরুভূমির সমস্ত বালুর মধ্যে আমি একটা বালুকণা মাত্র। সারমর্ম হলো, আপনাদের এই প্রেরণা, প্রশংসা আমি মাথা পেতে নিলাম।

সাহিত্য একাডেমিতে যারা আসে, পড়ে, তাদের পাঠ শুনে, লেখা পড়ে মুগ্ধ হই, আর ভাবি তারা এত শব্দ কোথায় পায়, এতো শব্দ তো আমি জানি না। আমি কেনো ওদের মতো লিখতে পারি না। সাহিত্য একাডেমি একটি শিক্ষালয়, কিন্তু এখানে কেউ কারো শিক্ষক নয়, আবার সকলে সকলের শিক্ষক।

‘যদি গোকুল চন্দ্র ব্রজে না এলো’ গানটির কিয়দংশ খালি গলায় গেয়ে উপস্থিত সকলকে তিনি মোহিত করে তোলেন।

সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, মুত্তালিব বিশ্বাস হলো সূর্য, আমি তাঁর কাছে কুপির মতো। গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনেছি। গান পরিবেশনের আগে তিনি গানের বৃত্তান্ত যেভাবে তুলে ধরেন, আমি বিস্মিত হই।

মঞ্জুর আহমদ বলেন, মুত্তালিব বিশ্বাসের বই আমি পড়েছি, এবং আমার পত্রিকার জন্য তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছি। তাঁর লেখার যে বিষয়টি আমার ভালো লাগে তা হলো, তাৎক্ষণিক তীব্র বিষয়টিও তিনি এমন ভাষায় লেখেন, এমন শব্দ ব্যবহার করেন, যেখানে কষাঘাত আছে, সমালোচনা আছে, কিন্তু যা পড়ে তিক্ততা তৈরি হয় না, খারাপ লাগে না। আমি অশীতিপর, পেছনের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে না, ভুল হয়ে যায়। অথচ, মুত্তালিব বিশ্বাস অসাধারণ স্মৃতিধর ব্যক্তি, তিনি বিস্ময় আমার কাছে।

লেখক হাসান ফেরদৌস বলেন, জাতীয় সংগীতের স্বরলিপি করেছেন মুত্তালিব বিশ্বাস। ভালো মানুষের গুণ হলো তিনি বিনয়ী হোন, আর ভালো লেখক মানে তিনি অনুসন্ধিৎসু হোন। মুত্তালিব বিশ্বাসের দুটো বই পড়ে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি, তিনি অতি কঠিন, অতি শুকনো, অতি কট্টর বিষয়গুলোকে ভেঙে সহজভাবে বলতে পারেন। অর্থাৎ, বিষয়বস্তু আত্মস্থ করে তিনি লেখেন। তিনি কৌতুহলী, তাঁর মধ্যে নতুন জিনিস খোঁজার আগ্রহ রয়েছে, কৌতুহল রস গ্রহণে যেমন তিনি অকুণ্ঠ তেমনি তীক্ষ্ণ বিচার বিশ্লেষণে তিনি অতন্দ্র, প্রায়োগিক ভাষা কৌতুক রসে স্নিগ্ধ – কথাগুলো তিনি মুত্তালিব বিশ্বাসের ‘সংগীত ভাবনা’ বইটির ভূমিকা থেকে তুলে ধরেন।

ঠিকানা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমান বলেন, মুত্তালিব বিশ্বাস আমার অভিভাবক, নাকি বন্ধু, আজও আমি সেটি নিশ্চিত হতে পারি নি। তিনি বলেন, মুত্তালিব ভাই আপনি একেবারে নিউইয়র্ক ছেড়ে যাবেন না, ফিরে ফিরে আসবেন। আমরা আপনাকে মনে রাখবো, আপনিও আমাদের মনে রাখবেন।

লেখক আহমাদ মাজহার বলেন, নব্বই এর দশকে মুত্তালিব বিশ্বাসের ‘সংগীত বিমর্শ’ বইটি প্রথম হাতে এলে ‘বিমর্শ’ বানানটি দেখে বিস্মিত হই, পরে অবশ্য এর অর্থ আবিষ্কার করি। সঙ্গীতজ্ঞ বলতে যা বোঝায়, যিনি সংগীত চর্চা করেন, সংগীতের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক নিরুপণ করতে পারেন, এবং জীবন ও সংগীত তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে একাকার হয়ে এমন একটি জায়গ রচিত হয়, যিনি সেটি তৈরি করতে পারেন, তিনি হচ্ছেন সঙ্গীতজ্ঞ। মুত্তালিব বিশ্বাস হলেন সেরকম একজন সঙ্গীতজ্ঞ।

কবি কাজী আতীক বলেন, ঢাকায় আমরা একই শহরে থাকলেও মুত্তালিব বিশ্বাসকে আমি সাহিত্য একাডেমি থেকেই চিনি। আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে সাহিত্য একাডেমিতে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। মুত্তালিব বিশ্বাস নিরবচ্ছিন্নভাবে নিউইয়র্কে এখন থাকেন না বলেই সাহিত্য একাডেমির পক্ষ হতে এই সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে।

লেখক নীরা কাদরী বলেন, মুত্তালিব বিশ্বাস আমার খালু, কৈশোরেই দেখেছি তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে গানের চর্চা করছেন। তাঁর দিকে তাকালে এখন আমার বাবার কথাই মনে পড়ে।

লেখক এ.বি.এম সালেহ উদ্দিন বলেন, মুত্তালিব বিশ্বাস আমাদের প্রাণের মানুষ। তাঁকে কখনো বিমর্ষ হতে দেখি নি, তিনি সদা প্রাণবন্ত। তিনি জীবনভর যে আলো ছড়িয়েছেন, আশা করি সেটি অব্যাহত থাকবে।

কবি সুমন শামসুদ্দিন মুত্তালিব বিশ্বাসের কিছু উল্লেখযোগ্য উক্তি ও তাঁকে নিয়ে গুণী কয়েকজনের উপলব্ধি তুলে ধরেন।

দ্বিতীয় পর্বে আলোচনায় অংশ নিয়ে কবি তমিজ উদদীন লোদী বলেন, ১৯২১ সালে টি.এস.এলিয়ট তাঁর ‘দ্যা ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতাটি নিয়ে ফ্রান্সে ছুটে যান কবি এজরা পাউন্ডের কাছে। এজরা পাউন্ড কবিতার প্রথম ৫৪ লাইন বাদ দিয়ে ৫৫ লাইন থেকে শুরু করেন। এক বছর পর কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। তিনি বলেন, এখন আমাদের কী সেই ধৈর্য আছে! লেখালেখির জন্য ধৈর্য ধারণের বিকল্প নেই।

লেখক আদনান সৈয়দ এবারের আসরে লেখক শাঁওলী মিত্রের ‘ত্রস্ত সময় ধ্বস্ত সংস্কৃতি’ এবং কাফকার ‘দি লাভ অফ ফ্রানৎস কাফকা’ বই দু’টো নিয়ে আলোচনা করেন। প্রথম বই সম্পর্কে তিনি বলেন, এই বইটি বর্তমান সময়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই। আমাদের যে সময়টা যাচ্ছে, আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, নৈতিক অবস্থান, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিনয় এগুলো যেন এখন ফাঁকির কাজ। মানুষ এখন খুব দ্রুত নাম, যশ, সুনাম, খ্যাতি চায়। সাহিত্য একাডেমিতে আজ আমরা বিখ্যাত মানুষ মুত্তালিব বিশ্বাসের বিনয় দেখেছি। তিনি এতটাই বিনয়ী, তাঁর প্রশংসাও করা যাবে না। এমন মানুষগুলো এখন খুব বেশী নেই, তাঁরা হারিয়ে যাচ্ছেন। এই বইটির বিষয় ঠিক তাই।

দ্বিতীয় বই সম্পর্কে তিনি বলেন, বইটি নির্বাচন করেছি কারণ, জুন মাস কাফকার মৃত্যু বার্ষিকী। কাফকা যখন কঠিন যক্ষা রোগে আক্রান্ত তখন তিনি প্রেমিকা মিলেনাকে লিখেছেন, ‘আমি তোমাকে গভীরভাবে, অচেতনভাবে, অর্থহীনভাবে, এবং মারাত্মকভাবে ভালোবাসি।’ একজন শিল্পী হয়ত সবসময় অন্য জগতের মানুষ, কিন্তু সবসময় ভালোবাসার সঙ্গেই তাদের বসবাস।

এবারের আসরে আবৃত্তি করেন মুমু আনসারী, এবং স্বরচিত পাঠে ছিলেন হুসাইন কবীর, কাউসার রোজী ও মণিকা চক্রবর্তী।

আসরে উপস্থিত ছিলেন ফেরদৌস সাজেদীন, আবেদীন কাদের, রেখা আহমেদ, হুসনে আরা, শামস আল মমীন, ফরিদা ইয়াসমিন, প্রতাপ দাস, ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন, রাণু ফেরদৌস, হাসানুজ্জামান সাকী, নাসির শিকদার, সুরীত বড়ুয়া, আবু সাঈদ রতন, ধনঞ্জয় সাহা, মিনহাজ আহমেদ, সাদিয়া খন্দকার, সেমন্তী ওয়াহেদ, রিমি রুম্মান, মনিজা রহমান, এলি বড়ুয়া, জেবুন্নেসা জ্যোৎস্না, আকবর হায়দার কিরণ, হুমায়ুন কবির ঢালী, মাহফুজ আলম, বিশ্বাস করবী ফারহানা, বিশ্বাস কেতকী ফারহানা, ফ্লোরা, মিয়া এম আছকির, নাসিমা আক্তার, ওয়াহেদ হোসেন, শহীদ উদ্দীন, সবিতা দাস, এস.এম মোজাম্মেল হক, আবু রায়হান, আব্দুল কাইয়ুম, শফিক ইসলাম, পলি শাহীনা প্রমুখ।

সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা সহ আগামী আসরের আমন্ত্রণ জানিয়ে আসরের সমাপ্তি টানেন মোশাররফ হোসেন। -পলি শাহীনা পেরিত

শেয়ার করুন