নিউইয়র্ক     রবিবার, ৩০শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৬ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে পতন

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪ | ০৬:১৬ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ | ০৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে পতন

বাংলাদেশে ২০২৩ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। মোট এফডিআই এসেছে ৩০০ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০২২ সালে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল এবং আগের বছরের চেয়ে বেড়েছিল ২০ শতাংশ। দেশে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার পরও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে উদ্বেগজনক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ২০ জু বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্টে দেশওয়ারি বিদেশি বিনিয়োগ আসার এবং অন্য দেশে বিনিয়োগ করার ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান রয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে আঙ্কটাড ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট-২০২৪’ নামে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

আঙ্কটাডের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগ এলেও বাংলাদেশে বছর শেষে মোট বিদেশি বিনিয়োগ থাকার পরিমাণ বা স্থিতি কমে গেছে। ২০২২ সালেও আগের বছরের চেয়ে এফডিআই স্থিতি কমে যায়। এর মানে বাংলাদেশ থেকে গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ২০২৩ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগ থাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫ কোটি ডলার। আগের বছর যা ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ১৫৮ কোটি ডলার। ২০২১ সাল পর্যন্ত আগের কয়েক বছর এফডিআই স্থিতি বাড়ছিল। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের সর্বাধিক বিনিয়োগ এসেছিল। এর মূল কারণ ছিল জাপান টোব্যাকো ওই বছর বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের সিগারেটের ব্যবসা কিনে নেয়।

শুধু বাংলাদেশে বিদেশিদের নয়, বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের দেশের বাইরে বিনিয়োগও গত বছর কমেছে। কমার হার ৪৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিদেশে বৈধভাবে ৩ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে ৩৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে বিনিয়োগ করেছেন। ২০২২ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর ২০২১ সালে ছিল ৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের ব্যক্তি খাত এখন দেশের বাইরে বিনিয়োগ করার মতো সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।

বাংলাদেশে অবশ্য ২০২৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের (গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট) জন্য অর্থের ঘোষণার পরিমাণ বেড়েছে, যা ভবিষ্যতে প্রকৃত বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। ঘোষিত অর্থের পরিমাণ ২৮৯ কোটি ডলার। ২০২২ সালে যা ছিল মাত্র ৬৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের ঘোষণা আগের চেয়ে গত বছর বেড়েছে।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে ১৫ বছরের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাস্তবায়নে ধীরগতি থাকায় ১০০টি অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা পিছিয়ে ২০৪১ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে বিনিয়োগ উন্মুক্ত নয়। একটি নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি শর্তসাপেক্ষে উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে থাকে। কিছু প্রতিষ্ঠানের দেশের বাইরে বিনিয়োগ রয়েছে, যার মধ্যে রপ্তানিকারকের সংখ্যা বেশি। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে সাধারণত এ ধরনের অনুমোদন দেয় সরকার। আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সাল শেষে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০২২ সাল শেষে যা ছিল ৪০ কোটি ডলার। ২০২১ সাল শেষে ৩৯ কোটি ডলার ছিল।

কেন বিনিয়োগ কমলো: মতামত জানতে চাইলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাণিজ্য সংগঠন ‘ফিকি’র সভাপতি ও ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও এমডি জাভেদ আখতার সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে এফডিআই আগে থেকেই নিম্নস্তরে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রায় একই পরিমাণ জিডিপির দেশ ভিয়েতনামে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গড়ে এফডিআই এসেছে ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন, যা তাদের জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশের সমান। যে কোনো দেশের জন্য শক্তিশালী এফডিআই আকর্ষণে তিনটি বৈশিষ্ট্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। একটি দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা তখনই স্থাপিত হয়, যখন ট্রেডমার্ক, আইপিআর ও এডিআর সংক্রান্ত নিয়মকানুন ন্যায়সংগত ও কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়; আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় এবং কোম্পানিগুলো তাদের পরিষেবার জন্য নির্বিঘ্নে অর্থপ্রাপ্তি ও মুনাফা প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পায়।

তাঁর মতে, দ্বিতীয় বিষয়টি হলো নীতির ধারাবাহিকতা। এমন এক ধরনের নীতি থাকতে হয়, যা আকস্মিক পরিবর্তন হয় না। প্রতিশ্রুত করছাড় বা আমদানি-রপ্তানি সুবিধা হঠাৎ বাতিল হয় না। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয় না এবং যে কোনো প্রণোদনা বৈষম্য ছাড়াই সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়। তৃতীয় বিষয়টি হলো সামর্থ্য, অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করা, তাদের যত্ন নেওয়া এবং ভ্যাট কাঠামো সহজ করে তোলা, পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ করের ওপর অধিক জোর দেওয়া, কার্যকর আয়কর কম রাখা এবং একটি ব্যবসাবান্ধব কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পদ্ধতি।

বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ সমকালকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ও বিনিয়োগ স্থিতি দুটোই কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। এর মানে নতুন বিনিয়োগকারী আকর্ষণ এবং যারা আছে তাদেরকেও ধরে রাখার ক্ষেত্রে সাফল্য কম। কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতা। কিছু পুরোনো আইনকানুনের সংস্কার করা হয়নি। এ ছাড়া গত দুই বছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, বিশেষত মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ কিছু কারণ বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

তিনি মনে করেন, আইন ও নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। বিনিয়োগ আকর্ষণে শুধু প্রণোদনা দিলে হবে না, প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় থাকতে হবে। কারণ সবাই বিদেশি বিনিয়োগ চায়। প্রতিযোগিতা করে বিনিয়োগ আনতে হলে কৌশলগত পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মাসরুর রিয়াজ বলেন, একটা ভালো দিক হলো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে গত বছর একটি কর্মসূচি চালু করেছে। এর আওতায় দ্রুত বিভিন্ন সংস্কার করা গেলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে।

বিশ্ব ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি: আঙ্কটাডের রিপোর্ট অনুযায়ী সারাবিশ্বের দেশগুলো ২০২৩ সালে এফডিআই পেয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ডলার। আগের বছরের চেয়ে যা ২ শতাংশ কম। বিশ্ব অর্থনীতিতে ধীরগতি এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিনিয়োগ কম হয়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কারণে সার্বিকভাবে এফডিআই কমেছে ৩৮ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ এসেছে ৩ হাজার ৫৯৭ কোটি ডলার। ২০২২ সালে এসেছিল ৫ হাজার ৭৫২ কোটি ডলার। ভারতে গত বছর এফডিআই এসেছে ২ হাজার ৮১৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ কম।

শেয়ার করুন