নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিপজ্জনক খেলায় চীন-আমেরিকা, কে কার জন্য হুমকি ?

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৩ | ১০:৪৯ অপরাহ্ণ | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৩ | ১০:৪৯ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
বিপজ্জনক খেলায় চীন-আমেরিকা, কে কার জন্য হুমকি ?

ইয়েকিং সাঙ : চীনের হুমকি নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শিক আধিপত্যের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। আমেরিকার অভিজাত রাজনৈতিক সমাজ এবং গণমাধ্যম থেকে শুরু করে জনমত পর্যন্ত প্রতিটি কোণে পৌঁছে গেছে চীনের নাম। প্রাথমিকভাবে আমেরিকানরা চীন ও আমেরিকার রাজনৈতিক বিতর্ককে বিপুলভাবে প্রচার করেছেন। ফলে বহু মানুষ বিশ্বাস করেন চীনের উত্থান আমেরিকার অস্তিত্বের জন্য একটি বিরাট হুমকি। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর এবং নব্য উদারপন্থি উভয়ই প্রচার করে। তাদের সবার বিশ্বাস যে, চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘উদারপন্থি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার’ জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে যা ঘটছে তাকে বলা যায় কাউকে একঘরে করার প্রক্রিয়া অথবা এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো কিছুকে হুমকি হিসেবে দেখা যায়।

নিরাপত্তা জোট গঠনের হিড়িক

চীনা হুমকি মোকাবিলায় চীনকে ঘিরে নিরাপত্তা জোট গঠন করা হয়েছে। এটি চীনকে একঘরে করার আয়োজন। অর্থনৈতিক এজেন্ডা চীন-আমেরিকার মধ্যকার প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে দাঁড়িয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে ‘শিকারি অর্থনীতি’, ‘ঋণ ফাঁদ’ চুক্তি এবং ‘অর্থচালিত সাম্রাজ্য’ হিসেবে নেতিবাচক প্রচার চালিয়ে চীনকে একঘরে করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, যা প্রচলিত বাজার ব্যবস্থাকে স্পষ্টতই পাশ কাটিয়ে চলেছে। এসব পদক্ষেপ চীনকে কট্টর বাণিজ্যবাদী নীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সদস্যরা এই প্রকল্পের বিষয়ে যাই ভাবুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারকারীরা এটিকে চীনের সাম্রাজ্যবাদী নীতি হিসেবে প্রচার করেন। তারা প্রচার করেন, চীনের উত্থান কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্যকেই হুমকির মুখে ফেলবে না বরং এর ফলে চীন ছোট রাষ্ট্রগুলোকে নিজের অধীনস্থ করে নেবে।

চীনভিত্তিক টেক জায়ান্ট হুয়াই এবং টিকটকও মার্কিন অপপ্রচারের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আজকাল কোনো বড় চীনা কোম্পানিই মার্কিন এবং তাদের অংশীদারদের আরোপ করা নির্বিচার বিধিনিষেধ থেকে নিরাপদ নয়। এসব চীনবিরোধী প্রতিক্রিয়া আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা এবং পশ্চিমা মূল্যবোধ রক্ষার শর্তে তৈরি করা হয়েছে। পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের নামে এসব প্রচার ‘ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল’ নামে চীনকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট গঠনকে বৈধ হিসেবে তুলে ধরে।

মার্কিন হুমকি মোকাবিলায় চীনের নিজস্ব নিরাপত্তা জোট গঠনের চেষ্টা

চীনের হুমকি মোকাবিলায় চীনকে ঘিরে মার্কিন নিরাপত্তা জোট গঠন চীনের জন্য সামগ্রিক জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই ‘মার্কিন হুমকি’ চীনকেও তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়াশীল নিরাপত্তা জোট গঠনের জন্য উস্কে দিয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীনও মার্কিন হুমকি থেকে তার সরবরাহ কাঠামো সুরক্ষিত করাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ মোকাবিলাকে চীন তার জাতীয় গর্ব এবং বেঁচে থাকার অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করছে। চীন সরকারের মতে, ‘বিস্তৃত জাতীয় নিরাপত্তা’র স্বার্থে চীন সরকার সামরিক হুমকির বাইরেও চীনের উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে এমন যে কোনো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক ক্রিয়াকলাপকে জাতীয় নিরাপত্তার নীতির মধ্যে আনতে পারবে।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উভয় পক্ষ পরস্পরবিরোধী নিরাপত্তা জোট গঠনের একটি বিপজ্জনক খেলায় গভীরভাবে আবদ্ধ। এই উচ্চ নিরাপত্তামূলক পরিবেশে, আপাতদৃষ্টিতে ছোটখাটো ক্রিয়াকলাপ বা একপক্ষের বক্তব্য অন্যদিক থেকে কঠোর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ‘সিকিউরিটি ফার্স্ট’ দৃষ্টান্তটি তাদের দ্বিপাক্ষিক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ব্যাপকভাবে পুনর্নির্মাণ করেছে। তদুপরি, প্রতিটি দেশের শক্তিশালী বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে, চীন-আমেরিকার উত্তেজনা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন কি সত্যিই একে অপরের জন্য প্রধান হুমকি?

যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণ বৈশ্বিক সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের বিস্তৃত পরিসরের মোকাবিলায় তাদের একে অপরকে প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ‘নিরাপত্তাকরণ তত্ত্বের’ শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত ওলে ওয়েভার বিশ্বাস করেন, নিরাপত্তার ধারণাটি সর্বজনীন কিন্তু এটি একটি খোলস মাত্র। কোনো কিছুকে সিকিউরিটাইজ করার মানে হলো এটাকে হুমকির পরিচয় দিয়ে দেওয়া। আমেরিকার অভিজাতরা যদি চীনকে নিরাপত্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সত্যিকারের হুমকি কিনা তা বিবেচ্য নয়। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে হুমকি হিসেবে দেখাতে চায় কিনা। মজার বিষয় হলো, চীন একবার তার নিজস্ব নিরাপত্তা জোটে ঢুকে গেলে তখন তা নিছক নিরাপত্তার সমস্যা থেকে অনেক বেশি হয়ে যায়।

চীনের হুমকিকে একটি বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে দেখানো হয়েছে যেখানে আমেরিকার অভিজাতরা বিভিন্ন উপায়ে তাদের সুবিধা পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কাউকে বলির পাঁঠা বানানো, কারও সমর্থন পাওয়া এবং অর্থসম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে। অন্যথায় মেরুকৃত রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যে সবকিছুর জন্য চীনকে দোষারোপ করে সহজে সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়া ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের জন্য একটি সাধারণ রাজনৈতিক কৌশল। দুর্ভাগ্যবশত, চীন একইভাবে সিকিউরিটাইজেশনের এই তথ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এখন উভয় পক্ষই বিতর্কিতভাবে একে অপরকে ক্ষতিকারক হিসেবে উপস্থাপন করছে।

‘থুসিডাইডস ট্র্যাপ’ এড়ানো

সিকিউরিটাইজেশনের এই খেলা শুধু বাগাড়ম্বর আর প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ব্যাপক প্রভাবসহ ভয়ানক রাজনৈতিক পরিণতি প্রকাশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হতে পারে। যতক্ষণ না এই সমস্যাটি সমাধান করা যায়, এর প্রভাব কেবল খারাপ হতে থাকবে। চীন-আমেরিকার পারস্পরিক দোষারোপের খেলা উভয় দেশের প্রচারকদের শয়তানি ও রাজনীতিকরণকে উৎসাহিত করেছে এবং প্রকৃতপক্ষে একে অপরের জনসাধারণের ধারণা এবং পারস্পরিক বিশ্বাসকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। এই নেতিবাচক মানসিকতা চীন-আমেরিকার সম্পর্কের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভিত্তির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক যে, দুটি বড় শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে পারস্পরিক অবিশ্বাস, বিশেষ করে তাইওয়ান প্রণালি এবং দক্ষিণ চীন সাগরে যুদ্ধের দিকে ধাবিত করছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের এত অবনতি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সহযোগিতার সম্ভাবনা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। এতে বিশ্ববাসী হতাশ।

নীতিনির্ধারকরা যদি ‘থুসিডাইডস ট্র্যাপ’-এর ভবিষ্যদ্বাণীতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তাহলে চীন বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটানোর জন্য কোনো ধরনের প্রচেষ্টাই বাকি রাখবে না, যা মার্কিন ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্বকে যৌক্তিক এবং অনিবার্য করে তুলবে। এই সিকিউরিটাইজেশন গেমের বিপদ উপলব্ধি করে এখন যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- মূলধারার আউটলেটগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা হুমকির বর্ণনাগুলোর সম্পর্কে দ্বিতীয়বার চিন্তা করা এবং সহযোগিতা ও বিশ্বাসের জন্য উপযুক্ত একটি বিতর্কমূলক পরিবেশের দিকে সরে যেতে সহায়তা করা। সিকিউরিটাইজেশনের প্রকৃতি (যা সাধারণত একাডেমিয়ায় বোঝা যায়), সমস্যাটি আরও ভালোভাবে বোঝার আশা করে এবং সমাধানগুলোও উপলব্ধি করতে পারে। নিরাপত্তার বিষয়বস্তু বোঝা এবং স্বীকার করা উভয় পক্ষের মধ্যে আরও গঠনমূলক বিতর্ককে উত্সাহিত করতে এবং সংলাপের জন্য উন্মুক্ত ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। – ইয়েকিং সাঙ, সহযোগী অধ্যাপক, সরকার ও জনপ্রশাসন বিভাগ, ম্যাকাও বিশ্ববিদ্যালয়, আনাদলু এজেন্সি থেকে ভাষান্তর : মুজাহিদুল ইসলাম

শেয়ার করুন