নিউইয়র্ক     শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নরেন্দ্র মোদিকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছে আমেরিকা

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩ | ০৬:৪২ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২২ জুন ২০২৩ | ০৬:৪২ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
নরেন্দ্র মোদিকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছে আমেরিকা

হোয়াইট হাউসে মোদিকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন জো ও জিল বাইডেন। ছবি: সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদির এটাই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে স্টেট ভিজিট বা রাষ্ট্রীয় সফর। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তিনি মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। উইনস্টন চার্চিল, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো অল্প কয়েকজন রাষ্ট্রনেতা এই সম্মান পেয়েছেন। জো ও জিল বাইডেন বুধবার রাতে মোদিকে হোয়াইট হাউসে নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন। বোঝা যাচ্ছে, এই সফরকে আমেরিকা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে।

ভারতে বিশেষজ্ঞরা কেমনভাবে দেখছেন এই সফরকে

দিল্লির কূটনীতি বিশেষজ্ঞ প্রবীণ সাংবাদিক প্রণয় শর্মা বলেন, ‘আমেরিকা পুরো রেড কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে মোদির জন্য। এই প্রথম মোদি আমেরিকায় স্টেট ভিজিটে গেলেন। আগে বহুবার গেছেন। কিন্তু সেগুলো স্টেট ভিজিট নয়।’ প্রণয়ের ব্যাখ্যা, ‘নানা ধরনের সফর হয়। ওয়ার্কিং ভিজিট হয়। অল্প সময়ের জন্য এসে কিছু বিষয়ে আলোচনা করে রাষ্ট্রনেতা চলে যান। মধ্যাহ্নভোজ বা এই ধরনের একটা অনুষ্ঠান থাকে সেখানে। কিন্তু স্টেট ভিজিটে যিনি আসবেন তাকে ২১টি তোপধ্বনি দিয়ে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানানো হয়। সাউথ লনে সকলের সাথে আলাপ করানো হয়। নৈশভোজ বা ব্যাঙ্কোয়েট দেন প্রেসিডেন্ট। সেখানে আমেরিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা থাকেন।’

প্রণয়ের মতে, ‘মোদির প্রতি বাইপার্টিজান সমর্থন আছে। তার অর্থ, শুধু বাইডেন বা তার দল নয়, বিরোধী রিপাবলিকানরাও মোদিকে একইরকমভবে স্বাগত জানাচ্ছেন। তারাও চান, ভারতের সাথে সুসম্পর্ক। হাউসের স্পিকার ম্যাকার্থি মোদিকে যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিতে ডেকেছেন। ফলে বাইডেন এবং রিপাবলিকান দুই পক্ষই চাইছে, দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হোক।’
আমেরিকার কিছু পার্লামেন্ট সদস্য চিঠি লিখে অনুরোধ করেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে যেন মানবাধিকারের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন মার্কিন কর্তৃপক্ষ।

এই প্রসঙ্গে প্রণয়ের বক্তব্য, ‘গণতন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের মত থাকবে। সকলের মত এক হবে, তা নয়। আমেরিকা ভাইব্র্যান্ট গণতন্ত্র। তাদের নিজেদের প্রেসিডেন্টকে নিয়েও কত মত রয়েছে। তাই নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে সরকারি একটা মত থাকতে পারে, কিছু প্রতিনিধির অন্য মত থাকতে পারে। তারা সেটা তুলতে পারেন। কিন্তু সরকারিভাবে এমন কোনো প্রশ্ন তোলার চেষ্টা হচ্ছে না, যাতে তিক্ততা বাড়ে। ইতিবাচক দিকটা তুলে ধরার চেষ্টা চলছে।’

সামরিক দিক থেকে

অবসরপ্রাপ্ত লেফটোন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য মনে করছেন, ‘সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সফর। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন শুধু ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশ থেকে কেনা অস্ত্র দিয়ে লড়েছি। যখন সোভিয়েত ভেঙে যায়, আমাদের খুব অসুবিধা হয়েছিল। এখন আমরা ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত দেশ থেকে অস্ত্র পাচ্ছি। আমেরিকা থেকে প্রচুর অস্ত্র পাচ্ছি বা পেতে পারি। যেমন ড্রোন, সাবমেরিন ও জেটইঞ্জিনের কথা হচ্ছে।’

উৎপল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘২০০০ সালের পর থেকে যখন আমরা আমেরিকা থেকে বেশি করে অস্ত্র কেনা শুরু করলাম, তখন ওরা সর্বশেষ প্রযুক্তির অস্ত্র দিত না। কিছুটা পুরনো অস্ত্র দিত। এখন অবস্থা পাল্টেছে। আমরাও আশা করব, সর্বশেষ অস্ত্র, প্রযুক্তি আমাদের দেবে আমেরিকা। পাকিস্তানকে ওরা সর্বশেষ প্রযুক্তির এফ-১৬ দিয়েছে।’

কেন আমেরিকার এই আগ্রহ

প্রণয় শর্মা মনে করেন, ‘ভারতের একটা বিশাল বাজার আছে। যেখানে আমেরিকা শুধু যে অস্ত্র বিক্রি করতে পারবে তাই নয়, বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাজার তাদের কাছে আকর্ষণীয়। ভারতের নলেজ পুল আছে। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলোতে উৎপাদন খরচ অনেক কম। ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায়। তারা আগে চীনে বিনিয়োগ করেছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় করেছে। কিন্তু চীনের পর ভারতের মতো এত বড় বাজার নেই।’ প্রণয়ের মতে, ‘কোভিডের পর অনেকের মনে হচ্ছে, একটা মাত্র বাজারের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। তাই ছড়িয়ে থাকতে হবে। তারা কিছু দেশ বেছে নিয়েছে। ভারত তার মধ্যে অন্যতম।’

মাথায় চীন

উৎপল ভট্টাচার্য মনে করছেন, ‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো প্রশান্ত মহাসাগর। চীন এটাকে সাউথ চায়না সি-এর সাথে মিলিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে। তার মোকাবিলায় কোয়াড হয়েছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত মিলে কোয়াড তৈরি করেছে। এটা চীনের প্রতি বার্তা। সেই দিক থেকে ভারতের গুরুত্ব আমেরিকার কাছে বাড়ছে।’

প্রণয় শর্মাও মনে করেন, ‘চীনের কারণে আমেরিকার কাছে ভারত বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। বাইডেন দেখেছেন, আমেরিকার আধিপত্যকে কোনো দেশ যদি চ্যালেঞ্জ করতে পারে, সেটা চীন। তাই চীনকে তারা সবচেয়ে বড় বিপদ মনে করে। এশিয়া-প্যাসিফিকে বিভিন্ন দেশ আছে, চীনের এই উত্থানে যারা প্রচুর সমস্যায় আছে। আমরা জানি, ভারতের সাথে চীনের সীমান্তে ২০২০ থেকে সংঘাতের পরিস্থিতি রয়েছে। চীন একতরফা চুক্তি ভেঙে সীমানা বদলাতে চেয়েছে।’ তার বক্তব্য, ‘আমেরিকা অন্য দেশগুলোকে সাথে নিয়ে চীনের মোকাবিলা করতে চাইছে। তবে আমেরিকা যেভাবে চীনকে দেখবে, ভারত সেভাবে দেখতে পারে না। চীন ভারতের প্রতিবেশী দেশ। আমাদের সমস্যার মোকাবিলা অন্যভাবে করতে হবে।’

রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ব্যালেন্স

প্রণয় শর্মার বক্তব্য, ‘ভারতের নীতি যা এখন অনেক দেশ নিচ্ছে তা হলো, আমি কোনো দেশের সাথে এমন শত্রুতা রাখব না যাতে ক্ষতি হয়। গায়ে পড়ে ঝগড়া করলে অন্য কথা। তাছাড়া যত বেশি দেশের সাথে সম্ভব সুসম্পর্ক রাখব। অনেক বিষয়ে একমত না হলেও রাখব। আমেরিকার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা মানে রাশিয়ার সাথে রাখতে পারব না, এমন নয়। আরো অনেক দেশের সাথে ভারত সম্পর্ক মজবুত করতে চাইছে। তাতে ভারতের লাভ। কোনো দেশের প্রাথমিকতা তো তার নিজের স্বার্থ দেখা। সকলেই এটা করে।’

উৎপল ভট্টাচার্যের মতে, ‘আমরা রাশিয়া বা ইউক্রেন কারো পক্ষে নেই। আমরা রাশিয়া থেকে তেল নিয়ে অন্য দেশে বিক্রি পর্যন্ত করছি। কারণ, আমরা নিজেদের স্বার্থ দেখছি। আমরা বলছি, যুদ্ধ কোনো বিকল্প নয়।’ তিনি বলেন, ‘আমেরিকা ও রাশিয়া দু’দেশের সাথেই সুসম্পর্ক চায় ভারত। এটা একটা ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট। যা এখনো পর্যন্ত ভারত ঠিকভাবেই করে চলেছে।’ সূত্র: ডয়চে ভেলে

শেয়ার করুন