নিউইয়র্ক     রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যা কিছু করেছি সবই সাধারণ মানুষের জন্য, রাজনীতিতে জড়ানোর ইচ্ছে নেই সিএনএনকে ড. ইউনূস

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০১:১২ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০১:১২ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
যা কিছু করেছি সবই সাধারণ মানুষের জন্য, রাজনীতিতে জড়ানোর ইচ্ছে নেই সিএনএনকে ড. ইউনূস

‘আমরা কথা বলছি একটা ব্যতিক্রমী সভ্যতা গড়ে তোলার। আজকের সভ্যতা একটি ভুল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা বলছি, এই ভিত্তিটাকে নতুন করে নির্মাণ করতে চাই। আমরা এমন একটি সভ্যতা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে আজকের সমস্যাগুলো থাকবে না। সিএনএনকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ২৬ ফেব্রুয়ারী সোমবার সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।

নিজের দেশেই বিচারের মুখে। তার সমর্থকরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর টার্গেটে পরিণত হয়েছেন তিনি। শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে বাংলাদেশের আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয় বলে জানিয়েছে সরকার। ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণের সাহায্যে সারাবিশ্বের দরিদ্র, দুস্থ ও অসহায়দের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি এখন জামিনে আছেন এবং রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। সিএনএনের ক্রিস্টিয়ান আমানপোর কথা বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: অধ্যাপক ইউনূস, আপনাকে অনুষ্ঠানে স্বাগতম।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: আপনি সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে বিশেষ করে নারী ও লাখো দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যতা থেকে বের করে আনতে যা করেছেন সেসব বিষয় নিয়ে এর আগে বহুবার আমাদের মধ্যে আলাপ হয়েছে। কিন্তু এখন আপনার বিরুদ্ধে খুবই গুরুতর আইনি অভিযোগ আনা হয়েছে। আপনাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে আমরা দেখলাম এবং জানলাম যে আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেওয়া হচ্ছে। আপনি কি বলবেন যে আসলে কী হচ্ছে? কী হচ্ছে বিজনেসের ক্ষেত্রে। কারণ আপনি বলেছেন সেগুলো জোর করে দখলে নিয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: হ্যাঁ। ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটছে। ৩৫ জনের একটি দল আমাদের ভবনে জোর করে ঢুকে পড়ে। আমরা যে সামাজিক ব্যবসাগুলো তৈরি করেছিলাম, যার অনেকগুলো দেশের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যবসা, সেই ভবন থেকে পরিচালিত হয়। কী হচ্ছে সেখানে, এটা নিয়ে সবাই ভয় পাচ্ছিলেন, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তারা তখন জানায় যে তারা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এসেছে। তারা কিছু কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। তাদের দাবি এগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এবং এ জন্য তারা এখন সেগুলো নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে এবং তারা এইসব কোম্পানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিচ্ছে।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: সরকার গ্রামীণ ব্যাংকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে। সেখানে কিছুই জোর করে বা বেআইনিভাবে করা হচ্ছে না বলে বলা হচ্ছে। তাহলে কেন এটা ঘটছে? আপনাকে কি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে? আপনাকে কি বলা হয়েছে যে এটা কেন হচ্ছে?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আপনার যদি কোনো দাবি থাকে, কোনো আইনি ইস্যু থাকে, তাহলে সেগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য আপনি আদালতে যেতে পারেন। কিন্তু সেগুলোর জন্য আপনি হঠাৎ করে জোর করে কোনো ভবনে ঢুকে যেতে পারেন না এবং বলতে পারেন না যে এগুলো আমরা নিয়ে নিচ্ছি।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: তারাই কি এখন সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে? নাকি আপনি আপনার প্রপার্টি ফিরে পেয়েছেন? কী অবস্থা এখন সেগুলোর?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা সেগুলো ফিরে পেয়েছি। আমরা গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদ সম্মেলন করেছি। সেখানে আমরা আমাদের ভবনে দেশের সব গণ্যমাধ্যমকর্মীকে আসার অনুরোধ করি এবং কী ঘটছে সেগুলো বিস্তারিতভাবে জানাই। তারপর থেকে আমরা আমাদের ভবনের নিয়ন্ত্রণে আছি এবং তারা আর আসেনি।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: বোঝার চেষ্টা করি কী হচ্ছে—আপনার বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে, এসব ইস্যুতে আপনাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের অনেক বিশিষ্টজন, যাদের মধ্যে নোবেল জয়ীরা আছেন, নোবেল জয়ী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আছেন—তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছেন। মূলত তারা অনুরোধ করেছেন ক্রমাগত এই বিচারিক হয়রানি বন্ধের। আপনার কী মনে হয়, এরপর কী হবে? আপনাকে কারাভোগ করতে হবে?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমি এরই মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত। যেকোনো সময় আমার জামিন বাতিল হতে পারে। তারা আমার জামিন বাড়াতে পারে, নয়তো আমার কিংবা আমার সঙ্গে আরও যারা অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের সবাইকে জেলে দিতে পারে। মার্চের ৩ তারিখে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা নতুন একটি মামলার—যেখানে আমাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে মানি লন্ডারিং ও আরও বেশকিছু ইস্যুতে—কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা যদি পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাই, তাহলে ওই মামলায় আরও দীর্ঘ সময়ের কারাদণ্ডও দিতে পারে। আমরা জানি না এগুলো কবে শেষ হবে।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: শ্রমিকদের জন্য আপনি কল্যাণ ফান্ড গঠন করতে পারেননি—সরকার এমন অভিযোগ করেছে। এ ধরনের আরও অনেক অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। আপনি এসব অভিযোগ নাকচ করেছেন। আপনার কী মনে হয়, কেন আপনার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে? এর কারণ কী?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমিই শুধু নাকচ করেছি তা নয়। এ নিয়ে দেশের ও দেশের বাইরের যেসব আইনজীবীর সঙ্গেই আলোচনা করেছি, তারা সবাই সম্মত হয়েছে যে এসব মামলার কোনো ভিত্তি নেই এবং তারা এ ধরনের কোনো মামলা এর আগে দেখেননি ও পরিচালনা করেননি। এটা একধরনের হয়রানি। এটা নিশ্চিত করা যে আমি বা আমরা এই বার্তা পাচ্ছি যে আমাদেরকে ভালোভাবে নেওয়া হচ্ছে না।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: কিন্তু আপনার নিজের দেশেই কেন এমন পরিস্থিতি? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাকে ‘গরিবের রক্তচোষা’ বলেছেন। শেখ হাসিনা কী মনে করছেন যে আপনি তার ক্ষমতার জন্য হুমকি?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমি জানি না তিনি কী মনে করেন। কিন্তু আমি রাজনীতির মাঠে নেই, আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন কোনো তথ্যও নেই। একবার আমি সরকার প্রধান হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। তবে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছি। রাজনীতিতে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি অনেকবার এসব কথা বলেছি এবং এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: অধ্যাপক ইউনূস, আপনার বয়স এখন ৮৩। এখন আপনি গ্রেপ্তার হতে পারেন, জেলে যেতে হতে পারে কিংবা কে জানে কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি ইউক্রেনে বসে কথা বলছি এবং প্রতিবেশী রাশিয়ায় রাজনৈতিক বন্দী অ্যালেক্সি নাভালনিকে হত্যা করা হয়েছে। সবাই অভিযোগ করছে যে সেদেশের সরকারই এই কাজ করেছে। কিন্তু আমি আশ্চর্য এই কারণে যে আপনাকে দেশ ছাড়তে বলা হলেও এ ধরনের কোনো চিন্তা-ভাবনা আপনার নেই।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: হ্যাঁ, আমি অনেক বিদেশি বন্ধুর কাছ থেকে এই দেশ ছেড়ে তাদের দেশে চলে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। তারা আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমার কাজ যাতে সারাবিশ্বে চলতে পারে তার সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে এগুলো শুরু করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমি শিক্ষকতা করতাম। তারপর আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে আমি যা করেছি, তা সবই সাধারণ মানুষের জন্য। আমি দুর্ভিক্ষ দেখেছি, মানুষের বিভিন্ন সমস্যা দেখেছি। যে কারণে আমি চিন্তা করেছি গরিব মানুষ যেন উপকৃত হয়। এটাই আমার আকাঙ্ক্ষা, এটাই আমার জীবন। যার ফলে ক্ষুদ্র ঋণ এসেছে এবং বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছে।

আমরা কথা বলছি একটা ব্যতিক্রমী সভ্যতা গড়ে তোলার। আজকের সভ্যতা একটি ভুল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা বলছি, এই ভিত্তিটাকে নতুন করে নির্মাণ করতে চাই। আমরা এমন একটি সভ্যতা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে আজকের সমস্যাগুলো থাকবে না।

বর্তমান সভ্যতা একটি দুর্যোগ, আত্মবিনাশী সভ্যতা। ফলে মানুষ ক্ষুদ্র ঋণকে গ্রহণ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যে কারণে গ্রামীণ আমেরিকা ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে পেরেছে।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: কিন্তু আপনি জানেন যে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে অ্যাকাডেমিক ও ইকোনোমিক সার্কেলে একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে। বলা হয় যে এর সুদ বেশি, গরিবকে আরও গরিব করে ইত্যাদি। বিষয়টা আসলে কী?

ড. মুহাম্মদ ইউনূস: ক্ষুদ্র ঋণ সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। আমরা সামাজিক ব্যবসা হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণ তৈরি করেছি। আমরা ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে টাকা অর্জনের চিন্তা করিনি। আমরা গরিব মানুষকে সাহায্যের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ এনেছি।

কিছু মানুষ গরিবের কাছ থেকে টাকা উপার্জনের উপায় হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণের ধারণাটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা ‘লোন শার্ক পাথ’কে ব্যবহার করছে। উচ্চসুদসহ যে বিষয়গুলো শুনছেন এগুলো তাদের দিক থেকে আসছে। কারণ, তারা টাকা আয়ের চিন্তা করছে। এটা ক্ষুদ্র ঋণের ভুল ধারণা। সঠিক ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা হলো সামাজিক ব্যবসা। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করা নয়, যতসামান্য যা নেওয়া হয় তা কেবলই প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য। এটুকুই।

আপনি চ্যারিটি প্রোগ্রাম চালাতে চাইবেন না। আমরাও এটি পছন্দ করি না। চ্যারিটি প্রোগ্রাম দীর্ঘদিন পরিচালনা করা যায় না। যে কারণে টেকসই কিছুর প্রয়োজন। যে কারণে আমরা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে এসেছি।

ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে আমরা আছি, কাজ করে যাচ্ছি এবং আমরা বেশ খুশি। কেননা আমরা সারাবিশ্ব থেকেই ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। তবে কোনো না কোনো কারণে আমার নিজের দেশে এটি সমস্যায় পড়েছে।

ক্রিস্টিয়ান আমানপোর: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য।

ডেইলি ষ্টার এর জন্য অনুবাদ করেছেন আরাফাত সরকার ও সোহানা পারভীন

শেয়ার করুন