দীর্ঘদিন ধরে চলা বাণিজ্য যুদ্ধের উত্তাপ কমাতে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এক বছরের জন্য একটি ট্রেড ট্রুস বা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন। আপাতত দুই দেশ পারস্পরিক শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা স্থগিত রাখবে। এতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার যে আবহ তৈরি হয়েছিল, তা সাময়িকভাবে হলেও প্রশমিত হলো।
বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কোরিয়ায় বুসান শহরে অ্যাপেক সম্মেলনের ফাঁকে দেড় ঘণ্টা ধরে হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের এই বৈঠকটি হয়, যা ২০১৯ সালের পর তাদের প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তি বাণিজ্য যুদ্ধের মূল সমস্যাগুলো সমাধান করেনি, বরং সাময়িক বিরতি দিয়েছে। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ডেনিস ওয়াইল্ডার আল জাজিরাকে বলেন, ‘এটা মূলত একধরনের বিরতি এবং খুব সামান্য পিছু হটা। দুপক্ষই এখনও তাদের বাণিজ্য অস্ত্র নামিয়ে রাখেনি, শুধু ব্যবহার বন্ধ করেছে যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তি বহাল থাকে।’
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, চীন বিরল খনিজ বা ‘রেয়ার আর্থস’-এর ওপর পরিকল্পিত রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এক বছরের জন্য স্থগিত রাখবে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ নতুন শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা বাতিল করবে।
এ ছাড়া ফেন্টানিল (এক ধরনের সিনথেটিক মাদক) সংক্রান্ত পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল, ট্রাম্প তা কমিয়ে ১০ শতাংশে নামানোর ঘোষণা দেন। শি প্রতিশ্রুতি দেন, চীন ফেন্টানিল পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে। ট্রাম্প বিমানবাহিনীর বিমানে দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়ার সময় বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, তিনি (শি) এই মৃত্যুর স্রোত থামাতে কঠোর চেষ্টা করবেন।’
৯০ মিনিটের বৈঠককে ‘অসাধারণ’ অভিহিত করে ট্রাম্প বলেন, ‘এটা ছিল অসাধারণ একটি বৈঠক। আমি এটিকে ১০-এর মধ্যে ১২ দেব।’ তিনি জানান, চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ৫৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪৭ শতাংশ করা হবে। বিশেষ করে ফেন্টানিল উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর আরোপিত শুল্ক অর্ধেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে।
ফেন্টানিল এক ধরনের কৃত্রিম ও অত্যন্ত প্রাণঘাতী মাদক, যা যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান একটি কারণ। ট্রাম্প বলেন, ‘শি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি ফেন্টানিল প্রবাহ রোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন।’
ট্রাম্প জানান, বিরল খনিজ ইস্যুটি সম্পূর্ণভাবে সমাধান হয়েছে এবং এই চুক্তি প্রতি বছর নবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, ‘রেয়ার আর্থস এখন আর কোনো ‘প্রতিবন্ধক’ নয়। আশা করি, কিছুদিনের জন্য এই শব্দটা আমাদের অভিধান থেকে মুছে যাবে।’ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ট্রাম্পের এটি ছিল মালয়েশিয়া ও জাপান সফরের পর শেষ বৈঠক। তিনি জানান, চীন বিপুল পরিমাণ মার্কিন সয়াবিন কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি বলেন, দুপক্ষ সমস্যাগুলো মোকাবিলায় একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে তিনি চুক্তির নির্দিষ্ট বিবরণ প্রকাশ করেননি। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানায়, শি উভয় পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন দ্রুত চুক্তি বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে, যাতে এর ফল দৃশ্যমান হয় এবং উভয় দেশ ও বৈশ্বিক অর্থনীতি আশ্বস্ত হয়।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরে চুক্তির বিভিন্ন দিক নিশ্চিত করেছে। মন্ত্রণালয় জানায়, ট্রাম্প ওয়াশিংটনের কালো তালিকা সম্প্রসারণ স্থগিত করতে সম্মত হয়েছেনÑ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ও ব্যক্তির সঙ্গে ব্যবসা করতে নিষিদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় নতুন নাম যোগ করা হবে না। উভয় দেশই পারস্পরিক বন্দর ফি বৃদ্ধিও স্থগিত রাখবে।
চীনের বিরল খনিজ রপ্তানির ওপর লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। বিশ্বের অধিকাংশ বিরল খনিজ উৎপাদনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে যা স্মার্টফোন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান পর্যন্ত নানা প্রযুক্তিপণ্যে ব্যবহৃত হয়।
সাংহাইভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘হুতং রিসার্চ’-এর পার্টনার শান গুও বলেন, ‘ফেন্টানিল সম্পর্কিত শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তটা অনেকটা প্রত্যাশিতই ছিল। চীন এই দাবি তুলেছিল আগেই, আর রেয়ার আর্থস ইস্যুকে ব্যবহার করেছে দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামানো হলেও যুক্তরাষ্ট্র এখনও কিছু প্রভাব ধরে রাখতে চাইছে, যাতে ভবিষ্যতের আলোচনায় সেটি কাজে লাগে। তবে এই হ্রাস চীনা পণ্যের জন্য আসিয়ান দেশগুলোর তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক অসুবিধা কিছুটা কমাবে।’ সম্মেলনের আগে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন বড় কোনো চুক্তি হবে না। বাস্তবেও দেখা গেল, বেশিরভাগ শুল্ক ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আগের মতোই বহাল থাকছে।
ট্রাম্পের ঘোষণামতে, ফেন্টানিল শুল্ক অর্ধেকে নামলেও যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের গড় শুল্ক প্রায় ৪৭ শতাংশেই থাকবে, আর চীনের গড় শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর প্রায় ৩২ শতাংশে স্থির থাকবে। এখনও যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজারেরও বেশি চীনা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ তালিকায় রয়েছে, বিপরীতে চীনের অবিশ্বস্ত সত্তা তালিকায়ও রয়েছে বেশ কয়েকটি মার্কিন কোম্পানি।
বৈঠকে শি বলেন, ‘মাঝে মাঝে কিছুটা টানাপড়েন হওয়া স্বাভাবিক।’ অনুবাদকের মাধ্যমে ট্রাম্পের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘চীনের উন্নয়ন ও পুনরুত্থান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘আমেরিকাকে আবার মহান করা’র লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।’
দুই দেশ এ সময় নৌবন্দর ফি-সংক্রান্ত প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যা জাহাজ নির্মাণ, সমুদ্রবাণিজ্য ও লজিস্টিক খাতে আধিপত্য রোধে নেওয়া হয়েছিল।
ট্রাম্প জানান, যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করবে চীন। তিনি ইঙ্গিত দেন, আলাস্কার ৪৪ বিলিয়ন ডলারের তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্রকল্পে বড় চুক্তি হতে পারে। ট্রাম্প আরও বলেন, তিনি আগামী এপ্রিল মাসে চীন সফরে যাবেন এবং পরবর্তীতে শি যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন।
সিঙ্গাপুর ভিত্তিক হিনরিচ ফাউন্ডেশনের ট্রেড নীতি বিশেষজ্ঞ ডেবোরা এলমস বলেন, ‘এটাকে পুরোপুরি সমঝোতা নয়, বরং একধরনের আংশিক ফ্রিজ বা সামান্য পিছু হটা বলা যেতে পারে।’
অন্যদিকে সাংহাইয়ের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘টাইডালওয়েভ সলিউশনস’-এর পার্টনার ক্যামেরন জনসন বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে ভালো ফল দুপক্ষের পক্ষে পাওয়া সম্ভব ছিল না। অন্তত স্বল্পমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক আর অবনতির দিকে যাবে না।’
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ট্রাম্পের ঘোষণামতে এই চুক্তি প্রতি বছর পর্যালোচনার আওতায় থাকবে, ‘এতে উভয় পক্ষ প্রতি বছর সম্পর্ক ও পারস্পরিক কেনাবেচার ক্ষমতা পুনঃমূল্যায়নের সুযোগ পাবে।’
যাহোক, চুক্তি হয়তো তাৎক্ষণিক সংঘাত কমাবে, কিন্তু দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তির দ্বন্দ্ব এখনও অবসান হয়নি, বরং সাময়িক বিরতিতে ঢেকে রাখা এক অমীমাংসিত প্রতিযোগিতা এখন নতুন এক বছরের সময়সীমায় প্রবেশ করেছে।
বিশ্ববাজারে শান্ত প্রতিক্রিয়া : শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠকটি হয় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ুংয়ের সঙ্গে এক সম্মেলনের পর। সেখানেই যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া কয়েক মাস ধরে চলা শুল্কসংক্রান্ত আলোচনার প্রায় সব খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করে।
তবে চীনের সঙ্গে এই সমঝোতার পরও বিশ্ববাজারে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। হংকং, সাংহাই ও সিডনির সূচকগুলো নিম্নমুখী থেকে লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে, আর জাপানের প্রধান সূচক অপরিবর্তিত ছিল। সাংহাই কম্পোজিট সূচক দশ বছরের সর্বোচ্চ থেকে কিছুটা নেমে আসে, আর যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন ফিউচারও দুর্বল হয়ে পড়ে।
অস্ট্রেলিয়ার অর্থনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান উইলিয়াম বাক-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ বেসা ডেদা রয়টার্সকে বলেন, ‘বাজারের প্রতিক্রিয়া অনেক সংযত—ট্রাম্প বৈঠকটিকে যেভাবে উচ্ছ্বাসভরে বর্ণনা করেছেন, তার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।’
মার্কিন সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার বৃহস্পতিবার এক্স-এ লিখেছেন, ‘ট্রাম্পের কথায় বিশ্বাস করবেন না। তিনি চীনের কাছে নতি স্বীকার করেছেন।’ এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে শুধু ব্রাজিল ও ভারতই অতিরিক্ত শুল্কের আওতায় রয়েছে।
বৈঠকের আগে থেকেই ওয়াল স্ট্রিট থেকে টোকিও পর্যন্ত বিশ্ব শেয়ারবাজারে আশাবাদের সঞ্চার হয়েছিল—বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির এই বাণিজ্যযুদ্ধ হয়তো এবার প্রশমিত হবে, এমন প্রত্যাশায়।
রবিবার (২৬ অক্টোবর) মার্কিন আলোচকরা জানায়, চীনের সঙ্গে একটি প্রাথমিক কাঠামোতে তারা একমত হয়েছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ থেকে বিরত থাকবে এবং চীনও রেয়ার আর্থের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা শিথিলতা আনবে।
এনভিডিয়া ও তাইওয়ান ইস্যু আলোচনায় আসেনি : বৈঠকে এনভিডিয়ার নতুন ব্ল্যাকওয়েল চিপ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান ট্রাম্প, যা চীনের ৫০ বিলিয়ন ডলারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাজারে প্রতিষ্ঠানের অবস্থানকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
ট্রাম্পের বিদায়ের পরপরই দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছানো এনভিডিয়ার প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, ট্রাম্প ও শি ভালোভাবে কথা বলেছেন এবং উভয় দেশ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করবে।’
তাইওয়ান প্রসঙ্গেও কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানান ট্রাম্প। তবে তাইওয়ানের প্রধান বাণিজ্য আলোচক জানিয়েছেন, তিনি অ্যাপেক সম্মেলনের ফাঁকে এক মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যদিও আলোচনার বিস্তারিত জানাননি।
বৈঠক শুরুর কয়েক মিনিট আগেই ট্রাম্প ৩৩ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দেন—রাশিয়া ও চীনের বাড়তে থাকা অস্ত্রভাণ্ডারের উদাহরণ টেনে। এ বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা আশা করে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক পরীক্ষার নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখবে।
এভাবেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আপাতত কিছুটা উষ্ণ হলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কেবল একটি ‘ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি’। মূল সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে, যা যেকোনো সময় নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।