নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হলুদ ড্যাফোডিল

সোহানা নাজনীন

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
হলুদ ড্যাফোডিল

লালের উপরে সাদা রঙ দিয়ে “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” লেখা বাসটা জোড়া দোয়েল পাখীর ছাই রঙের কংক্রিটের শরীর পার হয়ে সকাল নয়টা নাগাদ কার্জন হলের লাগোয়া ফুটপাথ ঘেঁষে থামল। হুড়মুড় করে সবাই বের হচ্ছে, বের হচ্ছেন সোবহান করিম। লোহার বিশাল ফটক ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে কব্জিতে বাঁধা কালো সিকো হাত ঘড়িটার দিকে তাকালেন বারকয়েক। আজকেও দেরী হয়ে গেল, সকাল দশটায় পরীক্ষা শুরু হবার কথা, অথচ উনি কিনা এখনো গেটের গোড়াতেই খাবি খাচ্ছেন। বুক পকেট টা হাতড়ালেন, বাইরে থেকে প্রবেশ পত্র অনুভব করা যাচ্ছে। নাহ! জোর পায়ে হাটতে হবে নাহলে পৌঁছানো সম্ভব না। আরো দ্রুত পা চালাতে গিয়ে সোবহান করিম পড়ে গেলেন ফুটপাতের ধারে। পাশ দিয়ে ছেলে মেয়ের দল তোয়াক্কা না করেই চলে যাচ্ছে কোলাহল করে। কালো পীচের পাশে নাগকেশর গাছের নিচে যেখানে কলাবতীর লম্বা শীষগুলো বাতাসে দুলছে ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন সোবহান করিম। হঠাৎ হাত ঘড়িটায় সময় দেখলেন, দশটা বেজে গেছে! সর্বনাশ! তারমানে তো পরীক্ষা শুরু হয়েছে এতক্ষণে। উনি প্রাণপনে ওঠার চেষ্টা করছেন, হাত-পা ছুড়ছেন ওল্টানো তেলাপোকার মতো, কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা হয়ে যাচ্ছে।

ধাতব শব্দে ফোনটা কতক্ষণ বেজে চলেছে সোবহান করিম জানেন না। ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলেন, ঘামে বুকের কাছটায় শার্ট ভিজে গেছে। বুঝলেন এতোক্ষন উনি সেই পুরনো স্বপ্নটাই দেখছিলেন। আঁতিপাঁতি করে খোজার পর সোফার কুশনের নীচ থেকে সেলফোন উদ্ধার হল। খুজে পেতে কলটা ধরেই হাপিয়ে উঠলেন,

“হ্যালো, বিথী……বল?……”

“কখন থেকে ফোন দিচ্ছি, ঘুমাচ্ছিলে নাকি?”

সোবহান করিম তখনো ঘামছেন, হয়তো হিটারটা অটোমেটিক অন হয়েছে, ঘরটা বেশ উষ্ণ। উনি বিথীর কর্কশ আওয়াজের সাথে বিরক্তিমাখা চেহারাটা মনে ভাসাতে পারছেন। আঠাশ বছরের সংসার বলে কথা, অভিযোগ মেনে কথার উত্তর না দিয়ে নিরব থাকলেন।

“শোন বারবার কল দিচ্ছি এই কারনে যে বারোটার সময় মেইল দিতে আসবে, আজকেও যদি বরফ পরিষ্কার না করা থাকে তবে তো মেইল ম্যান ফেরত যাবে। কষ্ট করে বুটটা পরে যাওনা একটু। শুধু রাস্তা থেকে মেইল বক্স পর্যন্ত ক্লিন করলেই চলবে।”

সোবহান করিম জানালা দিয়ে শামুকের মতো উঁকি দিলেন, চেহারায় একটা ভয়ার্ত ভাব ফুটিয়ে ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। সেই শনিবার থেকে বরফ জমে আছে, এতো সহজে গলবে না মনে হচ্ছে। এই সপ্তাহেই একটা দরকারী চিঠি আসার কথা, বাড়িটা রেনোভেট করাবেন বলে ব্যাংকের কাছে লোনের আবেদন করেছিলেন।

“দেখি কি করা যায়, তুমি চিন্তা করো না, রাখছি এখন।”

গৃহপালিত স্বামীর মতো গলার সুরে সম্মতি জানিয়ে সোবহান করিম ফোনটা রেখে দিয়ে বস্তার মতো ভারী ঝোলানো শরীরটা টেনে তুলে বাথরুমের দিকে রওনা হলেন। সারারাত ভালো ঘুম হয়না দেখে সকালে নাস্তা খাবার পর উনার ভীষণ ভাবে ঘুম পায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও লেয়ারের মতো একগাদা কাপড় পরলেন, শরীরে রক্ত কমে গেছে, নার্ভেও প্রচুর সমস্যা, অল্পতেই খুব শীত লাগে আজকাল। ফিতার মতো চিকণ একটা রাস্তা কাটতেই সোবহান সাহেবের বুক ধড়ফড় শুরু হল। উনি লোহার বেঞ্চিটাতে বসে পড়ে হা করে বার কয়েক শ্বাস নিলেন, বীথির ভ্রু কোঁচকানো চোখ জোড়া মনে হতেই আবারো শাভলটা হাতে ধরলেন।

সেই ভোরে সবাই ওঠার আগেই বীথি অফিসের জন্যে বের হয়, মেয়েটা পারেও বটে। ব্রেস্ট ক্যান্সারের দ্বিতীয় স্টেজে বীথি এতোটা সচল থাকে কিভাবে সোবহান করিম ভেবে পান না। অফিস থেকে ফিরে এক ঝটকায় একটা ম্যাক্সি পরে বীথি দাড়িয়ে যায় রান্নাঘরে, প্রতিদিন নতুন কিছু তার রান্না করা চাই। সন্ধ্যে সাতটার বসার ঘরের বিশালকায় টিভির সামনে ডাবল সোফায় নিজেকে ছেড়ে দেন। আর সোবহান করিম ঢুলতে থাকেন বেতের চেয়ারে, আধোঘুমেই কিছু ফোন ধরেন, বিড়বিড় করে কথা বলে রেখে দেন। রনকনকমা’র গাছে ঘেরা ছোট্ট বাড়িটার উপরে ততোক্ষনে চাঁদ উঠে গেছে। ঝকঝকে চারিদিক, সাদা ক্ষীরের মতো বরফ জমে আছে, পরিবেশটায় কেমন যেন একটা মোহনীয় আলো ছড়ানো। ছোট শহরে রাত আরো গভীর হয়, যানবাহন চলাচল কমে আসে কিন্তু সোবহান করিমের চোখে ঘুম আসেনা। উনি তখন জীবনের হিসেবের খাতাটা খুলে বসেন, যোগ-বিয়োগ শুরু করে দেন। বীথি আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে, তার নিঃশ্বাসের ভারী আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেমোর প্রভাবে মেয়েটা রীতিমত দুর্বল, মাথার চুল একদফা ঝরে গিয়ে নতুন চুল গজিয়েছে। বীথির গোল মুখটা আর সেরকম কমনীয় নেই, চোখের কোটরে ক্লান্তির বাসা, ছয়দিনের জায়গায় আজকাল চারদিন অফিসে যায়। ত্রিশ বছর আগে এই বীথিকে দেখতে গিয়েই বিয়েতে রাজী হয়েছিলেন সোবহান করিম। একহারা লম্বা গড়নের বীথি তখন চব্বিশ বছরের যুবতী, গোল মুখটায় রাজ্যের লাবন্য ঝরে পড়ছে যেন। সোবহান করিমও কম যান না, টগবগে তরুন ব্যাবসায়ী। ভার্সিটি থাকাকালীন রাজনীতি করতেন, মেধাবী ছিলেন, লম্বা একহারা অবয়ব দেখে অনেক মেয়েই উনার প্রেমে পড়েছিল। সেইসব প্রেম ধুলিস্যাত করে প্রথম দেখায় বীথিকেই পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী প্রবাসী জীবন সুখের হয়নি তাদের, ছোট দুইটা মেয়ে নিয়ে আমেরিকায় আসার পর রোড এক্সিডেন্টে সব কিছু মুহূর্তে উল্টে গিয়েছিল। দুই বছর লাইফ সাপোর্টে থাকার পর বছরখানেক হুইল চেয়ারে বসে থাকতে হয়েছিল সোবহান করিমকে। দুবেলা ফিজিও থেরাপিস্টের সাথে একজন সাইকো থেরাপিস্টও আসতো। জীবনের প্রতি রুষ্টতা মানসিক ভারসাম্যেও আঘাত হেনেছিল। কিন্তু বীথি পুরো ব্যাপারটার প্রতি ভীষণ যত্নবান হয়ে সামলেছিল সব। নিউইয়র্কের মতো ব্যায়বহুল শহরে একনিষ্ঠ ভাবে একলা হাতে সংসার চালানো, মেয়েদের বড় করা, আবার স্বামীর সেবাযত্ন কিছুই বাদ দেয়নি। মেয়েরা এখন বড়, নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে তারা সচেতন। অথচ বিথীকে দুর্ভাগ্য ছাড় দিল না, ক্যান্সারটা প্রথম স্টেজে ধরা পড়লেও ভোগান্তির কমতি নেই। শরীরের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে দেড় বছর যাবত, মনোবলের এতোটুকু কমতি নেই মেয়েটার।

আজ কতকিছু মনে পড়ছে, প্রায়ই এমন হচ্ছে আজকাল, রাত যত গভীর হয় ততোই যেন মাথার ভিতর নানান ঘটনা ঠেলাঠেলি করে। ওয়াটার হিটারটা মঝে মাঝে হিস্‌হিস আওয়াজ তুলে নীরবতা ভাঙ্গে, তবুও বাসার সবাই অতল ঘুমের সাগরে তলানো। মাঝরাত পার হয়েছে, ছোট্ট শহরটায় অনেকেই তখন জেগে নেই। সোবহান করিম জানালার ধারের উঁচু বেতের চেয়ারটায় বসে বাইরে তকিয়ে আছেন, এটা উনার বহুদিনের পুরনো অভ্যাস। বরফে ডোবা রাস্তা ঘাট দেখতে এখনো উনার ভালো লাগে, সেই প্রথম প্রবাস জীবনের মতো। শিমুল তুলোর মতো সাদা সাদা তুষারকনা আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে, এই দৃশ্য দেখে সোবহান করিম বাকহীন হয়ে যেতেন। বাড়ির সামনের আঙ্গিনাটুকু পায়েসের পেয়ালার মতো দুধ-সাদা হয়ে আছে। সদ্য পরিষ্কার করা লেটার বক্সের গোড়াতে তাকালেন, ওখানেই শেষ সামারে ফুটেছিল একগোছা হলুদ ড্যাফোডিল। মনে পড়লো গ্রীক পুরান কাহিনী, নারসিসাস নিজের সৌন্দর্যে নিজেই বিমোহিত হয়ে পানিতে পড়ে সলিল সমাধি হয়েছিল। আর ঐ জমিনেই ফুটেছিল ড্যাফোডিল ফুল, তাদের ঘাড় বাকানো গঠন বলে দেয় নারসাসিসের সেই পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখার উদ্ধত ভঙ্গি। কিন্তু সোবহান করিম ভাবেন অন্যকথা, ড্যাফোডিল ফুলের শীষ তাকে নারসিসিজমের কথা মনে করায় না। বরং তিনি ভাবেন অন্য তুলনা, জীবনের কোথায় যেন ক্ষণস্থায়ী হলুদ ড্যাফোডিলের সাথে মিলে-মিশে যায়। বসন্তের শুরুতে মাটি ফুঁড়ে বের হওয়া শীষগুলো সবাইকে চমকে দিয়ে খুব দ্রুত নুইয়ে পড়ে। ওই শীষগুলোর মতোই নিজেকে ভাবেন তিনি। বালুর কণার মতো আঙ্গুল গলে সুখগুলো কখন বেরিয়ে গেছে সোবহান করিম টেরই পাননি। আজ জীবনের প্রতি পৃষ্ঠাজুড়ে শুধু অসুখের বিলাপ আর হাহাকার।

শেয়ার করুন