নিউইয়র্ক     শনিবার, ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পুরুষ আধিপত্যের শুরু ১২ হাজার বছর আগে, কেমন ছিল পূর্ববর্তী সমাজ

পরিচয় রিপোর্ট

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৩ | ০৬:২৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৩ | ০৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
পুরুষ আধিপত্যের শুরু ১২ হাজার বছর আগে, কেমন ছিল পূর্ববর্তী সমাজ

জাহাঙ্গীর আলম :বর্তমান বিশ্বের বেশির ভাগ সংস্কৃতিতেই পিতৃতান্ত্রিকতার দাপট। এসব সংস্কৃতিতে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা নারীদের চেয়ে পুরুষদেরই বেশি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং পরিপার্শ্ব ঘিরে এই সংস্কৃতিই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহাল থাকায় জ্ঞানী ও সচেতন মানুষও এমন ধারণা করতে প্রলুব্ধ হন যে, এটিই স্বাভাবিক অবস্থা, কারণ পুরুষেরা গড়পড়তা নারীদের চেয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী।

কিন্তু মানবজাতির শিকড় সন্ধানে নেমে এই ধারণার ব্যত্যয় খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্ত্বিকেরা। দীর্ঘ গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবী কেন আজ এমন পুরুষতান্ত্রিকতার চক্রে বাঁধা পড়েছে, সেটির উত্তর খুবই সহজ।

বিবর্তন তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে প্রাপ্ত নানা জীবাশ্মের বয়সের ভিত্তিতে নির্ধারিত মানবজাতির উদ্ভবের যে কালক্রম পাওয়া যায় তাতে—শিম্পাঞ্জিদের কোনোভাবেই মানুষের পূর্বপুরুষের কোনো অংশ বলে দাবি করার উপায় নেই। কারণ ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি বছর আগেই প্রাইমেটদের দুটি পরিবার আলাদা হয়ে ধারাবাহিক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে।

কিন্তু শিম্পাঞ্জিদের সামাজিক কাঠামোর দিকে নজর দিলেও আধুনিক মানবজাতির মধ্যে পুরুষের আধিপত্য বিকাশের ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণত শিম্পাঞ্জির দলগুলো স্পষ্টতই পিতৃতান্ত্রিক। পুরুষেরা নারীদের প্রতি রূঢ়, এরা নারীদের খাবার কেড়ে খায়, পরিপক্ব ডিম্বাণুধারী নারীদের সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করে এবং এমনকি শুধু দল থেকে দূরে সময় কাটানোর কারণে সেই নারীকে হত্যা করে!

নারী ও পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা নিয়ে বিতর্ক বহু দিনের। বিশ শতক থেকে এ বিতর্ক তুঙ্গে। এখনো বহু বুদ্ধিমান ও সচেতন মানুষ পুরুষতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো—পুরুষশাসিত সমাজ থেকে কোনো পক্ষই উপকৃত হয় না। সমাজ বিশ্লেষণে খুব সহজেই বোঝা যায়, পুরুষতান্ত্রিকতা পুরুষের জন্যও কতটা বাধার কারণ হতে পারে।

তাহলে এখন প্রশ্ন হলো—এমন নেতিবাচক একটি ব্যবস্থা মানবসমাজে কীভাবে বিকশিত হলো? আর এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিণতিই বা কী?

শিম্পাঞ্জির ক্ষেত্রে পুরুষেরা যেই দলে জন্মায়, বাকিটা জীবন তারা সেখানেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু নারীরা সাধারণত বয়ঃসন্ধির পরেই চলে যায় আরেক দলে। ফলস্বরূপ একটি গোষ্ঠীতে পুরুষেরা নারীদের তুলনায় একে অপরের সঙ্গে বেশি সময় ও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত থাকতে পারে। সামাজিক জীব হওয়ায় আত্মীয়দের মধ্যে একে অপরকে সাহায্য–সহযোগিতা করার স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে, পুরুষ শিম্পাঞ্জিরা এই সুবিধাটি বেশি পায়।

মানবসমাজের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য: এখানে নারীরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর স্বামীর পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে চলে যায়। এই ক্ষেত্রে পুরুষদের বেশি ক্ষমতা এবং বিশেষাধিকার থাকে। ডেভিসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ এবং প্রাইমাটোলজিস্ট সারাহ হার্ডি বলেন, এই রীতিকে বলা হয়—পিতৃস্থানীয় বাসস্থান। এটিও পিতৃতন্ত্রের অনুষঙ্গ।

আদি মানবজাতির ইতিহাস বলে, আদিকালে মানুষ শিকারি–সংগ্রাহক ছিল। আধুনিক শিকারি–সংগ্রাহক সমাজের মধ্যেও কিন্তু ‘পিতৃস্থানীয় বাসস্থান’ সংস্কৃতিকেই আদর্শ মনে করা হয় না। পরিবর্তে হয় স্বামীই শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বসবাস করেন অথবা দম্পতি উভয় পরিবার থেকে দূরে কোথাও গিয়ে বসবাস করতে থাকে। হার্ডির মতে, এই সমাজ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সমতা তৈরি হয়।

প্রাগৈতিহাসিক শিকারি–সংগ্রাহক মানবজাতির যে চর্চা ছিল সেটির ধারাবাহিকতাই যদি আধুনিক শিকারি সম্প্রদায় বহন করে থাকে, তাহলে এটি ধারণা করা যেতে পারে যে, সেই প্রাথমিক সমাজের নারীরা যে গোষ্ঠীর মধ্যে বড় হয়েছে, এক সময় গিয়ে সেই গোষ্ঠীর সমর্থন না পেলে বা নিপীড়নের শিকার হলে তাদের থেকে দূরে কোথাও গিয়ে বসবাসের বিকল্প তার হাতে ছিল।

বিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করেন, প্রায় ১২ হাজার বছর আগে সমাজের চরিত্র বদলে যেতে শুরু করে। কৃষি ও বসতবাড়ির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য মানুষ তখন সম্পদ অর্জন ও সংরক্ষণ করতে শুরু করে। পুঞ্জীভূত সম্পদের উত্তরাধিকার স্থানান্তরিত হতে শুরু করে পুরুষদের মধ্যে, কারণ তারাই শারীরিকভাবে শক্তিশালী, ফলে সমাজে ক্ষমতাচর্চাও তাদের কুক্ষিগত হয়।

তখন থেকেই পিতা, পুত্র, চাচা এবং পিতামহ একে অপরের কাছাকাছি বসবাস করতে শুরু করে। বংশলতিকা ও সম্পত্তি বণ্টন পুরুষদের দিক থেকে হিসাব করা শুরু হয় এবং নারীদের আত্ম নিয়ন্ত্রণের চর্চা লোপ পায়। ধারণা করা হয়, পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব এখান থেকেই।

পিতৃতন্ত্রের উৎসের এই ধারণা ২০০৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। ইতালির রোমের স্যাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সাব–সাহারান আফ্রিকার ৪০ সদস্যের একটি গোষ্ঠীর ওয়াই ক্রোমোজোমের (বাবার কাছ থেকে প্রাপ্ত) জেনেটিক চিহ্নগুলো এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ (মায়েদের কাছ থেকে প্রাপ্ত) পর্যবেক্ষণ করেন। বিজ্ঞানীরা দেখেন, শিকারি–সংগ্রাহক জনগোষ্ঠী যেমন: কুং এবং হাদজার নারীদের কৃষিতে জড়িত নারীদের তুলনায় বিয়ের পর মায়ের সঙ্গে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। পুরুষদের ক্ষেত্রে বিপরীত ঘটনা ঘটে। এতে ধারণা করা যেতে পারে, কৃষিভিত্তিক সমাজের সঙ্গে ‘পিতৃস্থানীয় বাসস্থান’ চর্চার সম্পর্ক রয়েছে।

বলা যেতে পারে, পুরুষ আধিপত্যকে মানবসমাজের স্বাভাবিক অবস্থা বলে ধরে নেওয়াটা একটা বিভ্রান্তি। লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যামি প্যারিশ বলেন, সমাজে পুরুষতন্ত্র বা পুরুষ আধিপত্য বা কর্তৃত্ব যাই বলা হোক না কেন, এটি ঠিকঠাক করতে হলে দরকার পারস্পরিক সংহতি।

তিনি বোনোবো (বানর জাতীয় প্রাণী) সমাজগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, এই প্রাইমেট সমাজ ‘পিতৃস্থানীয়’ কিন্তু নারী–প্রধান। যদিও নারীদের ওজন পুরুষদের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম। সে অর্থে শারীরিক শক্তিতেও নারীরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে; মানুষ এবং শিম্পাঞ্জিদের মতোই।

প্যারিশ বলেন, এরপরও বোনোবোরা মানুষ বা শিম্পাঞ্জির মতো না হওয়ার কারণ হলো, এরা পরস্পরের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ। জোট ও ঐক্য গঠনে দক্ষ। আধুনিক নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সমান্তরালে একটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন প্যারিশ, সেটি হলো: ‘লক্ষ্য হওয়া উচিত সম্পর্কহীন (রক্তের সম্পর্কীয় নয়) নারীদের সঙ্গে এমন আচরণ করা যেন তারা বোন।’

এটি বলা যতটা সহজ বাস্তবে এটির চর্চা করা তত সহজ নয়। হার্ডি বলেন, ‘কিন্তু স্বজন নয় এমন মানুষদের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা কঠিন।’ রক্তের সম্পর্কহীন পরিবেশে প্রতিযোগিতামূলক প্রবৃত্তিই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে পারে। অনেক ঘটনা সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট করতে পারে। যেমন: যুদ্ধ। হার্ডি বলেন, ‘নারীরা তখন নিজের সন্তান এবং স্বামীর নিরাপত্তার দিকে নজর দিতে শুরু করেন।’ সাম্প্রতিক সময়ের চলমান সংঘাত এই সম্পর্কগুলোর ক্ষয়ের কারণ হতে পারে বলে উদ্বেগ জানান হার্ডি।

সবশেষ কথা হলো, মানবসমাজে সমতা পুনরুদ্ধার এবং সমাজকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য একাধিক ফ্রন্টে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব যদি হয় স্থায়িত্বকামী সামাজিক কাঠামোর আকাঙ্ক্ষা থেকে, যেখানে পুরুষদের মালিকানা এবং উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, তাহলে আইন করে নারীদের সম্পত্তির মালিক করতে হবে। এটি সমতা বিধানে অনেকখানি সহায়তা করতে পারে।

অবশ্য নারীদের সম্পত্তির অধিকারী করতে অনেকে সমাজেই আইন বিদ্যমান—তাহলে একুশ শতকে এসেও সমাজগুলোতে কেন পিতৃতন্ত্র টিকে থাকছে? এ ব্যাপারে শিকাগোর রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিজ্ঞানী লিস এলিয়ট যুক্তি দেন, সমাজ যখন আইন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধকে মূর্ত করে তুলবে তখনই প্রকৃত পরিবর্তন আসবে। আইন হলো প্রথম ধাপ। সমাজের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনই এরপর সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন।

হাজার হাজার বছর ধরে বিশেষাধিকার পেয়ে আসা পুরুষ হঠাৎ ‘সমান অধিকার’ নিতে গিয়ে নিজেকে নিপীড়িত বঞ্চিত ভাবতে শুরু করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। তথ্যসূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট

শেয়ার করুন