নিউইয়র্ক     মঙ্গলবার, ২১শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এইচ বি রিতা 

ডায়েরি

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১০:২১ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১০:৪১ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
ডায়েরি

(১)  আত্মজীবনী লেখার উদ্দেশ্য-লেখকের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং অর্জনগুলিকে চিত্রিত করা। আর তাই বেশিরভাগ আত্মজীবনী সাধারণত লেখা হয়, জীবনের শেষ সময়কালে।  তাই, আমিও চেষ্টা করছিলাম কিছু লেখার। কিন্তু অধ্যাবসায় বজায় রেখেও সেটা হয়নি, বা হচ্ছে না।  আত্মজীবনী লিখার বিশেষ ক্ষমতা কেবল বিশেষ মানুষদের থাকে। সে ক্ষমতা আমার নেই। আমি বিশেষ কেউ নই। আমি খুব সাধারণ, একেবারেই সাধারণ একজন। অনেকটা শিল্প ও ফুলের মতো। “A work of art is useless as a flower is useless”- যে কোন শিল্প উদ্দেশ্যহীন, কারণ এর উদ্দেশ্য কেবল একটি ভাব তৈরি করা। এটি কোন ভাবেই কারো কর্মকে প্রভাবিত করেনা। ফুল শুধুই নিজের জন্য ফুটে। তার নিজের আনন্দের জন্য ফুটে। আমরা এটি দেখার মাধ্যমে একটি আনন্দঘন মুহূর্ত লাভ করি। ফুলের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবল দেখার, অনুভব করার। ফুল বা শিল্প আমাদের প্রভাবিত করে; আন্দোলিত করেনা।

 আত্মজীবনী তৈরি করা দুঃসাহসের কাজ। আজ পর্যন্ত কেউ সম্পূর্ণরুপে নিজেকে আত্মজীবনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। কে চায় নিজের অক্ষমতা বা অপরাধ বেরিয়ে আসুক প্রকাশ্যে? যারাই আত্মজীবনী লিখেছেন, তারা সকলেই কৌশলে চরম সত্যকে আড়াল করে গেছেন। আর আমি তো সে অর্থে খুবই দুর্বল। সব সত্য বলতে নেই। তাই আজকাল আলাপে মগ্ন হই, খাতা টেনে মাঝে মাঝে হিজিবিজি লিখি। কি লিখি নিজেরই বোধগম্য নয়। হতে পারে সেগুলি তড়িৎ রেসপন্স কিংবা ভেতরের শোক-তাপ। কবিদের মতো কলমের ঝঙ্কারে জীবনের নানা দিক ঈঙ্গিত করা আমার কাজ নয়। আমি অতি সাধারণ। সাধারণ মানুষ হয় সস্তা গদ্যের মত; কাবিক পদ্যে রূপকের জন্ম দিতে তারা ব্যর্থ। ভেঙে পড়তে পড়তে খাতা টেনে লিখি,  

‘ভালবাসা কি আমি বুঝিনা

ভালবাসার সংজ্ঞাও জানা নেই 

শুধু জানি, ভুল ব্যাকরণে গুলিয়ে যায় শেষ রাতের 

কাব্যিক দৃশ্যপট

মেদহীন খাঁজকাটা শরীরে তোমাকে ধারণ করার লিপ্সায়

সুগন্ধি রুমাল বুকে গুঁজে দিতে গিয়ে দেখি; 

বুকের গহীনে জমে আছে বরফবৃষ্টি।’

 এসব মূলত কবিতা নয়, এসব ভীরু মগজে শুধুই আত্মজীবনের গোপন কুঠুরিতে বন্ধি একটি দীর্ঘশ্বাসকে মুক্ত করার কৌশল। এই ক্রীয়ায় কোন প্রতিক্রীয়া নেই। কিন্তু যখন আমার প্রিয় কবি তাতে লাইন সংযোজন করে বলেন,

‘ছন্নছাড়া মন হেঁটে যায় একা উদ্দেশ্যহীন

কেন জানিনা

শুধু জানি, ভালবাসাহীন অরণ্যে তোমাকে ছোঁয়ার 

ব্যাকুলতা

বিরহ ছুঁয়ে জোৎস্না রাতে এই চোখ অকারণে কাঁদে।’- 

তখন আবার বন্ধ কুঠুরিতে আমি ফুঁপিয়ে কাঁদি। সাধারণ মানুষ বলেই কাঁদি। 

 সমরেশ তার আট কুঠুরিতে নয় দরজার কথা বলেছেন। তিনি জ্ঞানী বিজ্ঞজন, তাঁর বিশ্লেষণ ব্যাপক। এতো জ্ঞানের ভাষা ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার কেবল এক কুঠুরিতে নয় দরজা, সেখানের দরজাগুলো বন্ধ বলেই মৃত্যু অবধারিত মনে হয়। মনে হয়, বহুদিন গায়ে আলো স্পর্শ করেনি। বহুদিন কারো স্পর্শে নিশিতে জেগে উঠিনি, ব্যাকুল হয়ে বলিনি-আমায় ঘুম পারিয়ে দাও। সত্য বলার সাহস আমার কখনোই হবেনা। তাই নিজেকে আজকাল বড় বেশি ছদ্মবেশী মনে হয়। মনে হয় বড় চতুরতায় নিজেকে আড়াল করে রাখছি সত্য থেকে। এই যে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাই, খাওয়ার কথা বলতে পারিনা। ব্যাথায় পাঁজরের নিচে ফাটল ধরে, কাউকে দেখাতে পারিনা। মধ্যরাতে পাশের ঘরে সরলার অস্ফুট গোঙানিতে খিলখিয়ে হেসে উঠায় কোথায় যে টান পড়ে, সে কথাও বলা হয়না। এতো কপটতা, এত ভণ্ডামি আছে বলেই আমি মানুষ। আমরা মানুষ। এই যে এতো কথা বলছি, এসব আমার কথা নয়, আমাদের সবার কথা। আজকাল মাথার ভিতর থেকে ঘুনপোকা অসুখটা বের হতে চায়না। সারাক্ষণ ওরা আমার মগজ খুঁটে খুঁটে খায়। আমি ঘাপটি মেরে মরার মতো পড়ে থাকি বিছানায়। তৃপ্তিতে খেয়ে যাক ওরা আমার মগজ। কেউ ক্ষুধায় না মরুক।  

(২) প্রায়শই ফ্লাশিং এর পথে হাঁটি। হেঁটে হেঁটে ফ্লাশিং এর পথে ঝরা পাতাদের সাথে কথা বলি। পাতাদের রঙ, কাঠবিড়ালীর লুকুচুরি খেলার প্রেমে পড়ি। মেইনস্ট্রিটের সাবওয়ে-তে পড়ে থাকা গৃহহীন লোকটার ঝাঁকড়া কুঁকড়া চুলের প্রেমে পড়ি। কারো কারো লেখায় গভীর ভাবনা ও বিশ্লেষণের মহত্বের প্রেমে পড়ি। কারো জীবনকে ভিন্ন এক দৃষ্টিতে দেখার অসাধারণ শক্তির প্রেমে পড়ি। মানুষ হিসাবে আমরা নিজের সাথে সাথে অন্যকে নিয়েও ভাবতে পছন্দ করি। জীবনবোধ থেকেই ভাবনা আসে।  

জীবনানন্দ দাস তাঁর ‘বোধ’ কবিতায় লিখেছেন, 

 ‘আলো-অন্ধকারে যাইমাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;

স্বপ্ন নয়শান্তি নয়ভালোবাসা নয়,

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;

আমি তারে পারি না এড়াতে…..’

 হ্যাঁ! আলো-অন্ধকারে ডুবে গিয়েই পার্থিব-অপার্থিব সকল কিছুর উপর বোধের স্পর্শ মিলে। সেই ‘বোধ’ জীবনকে টেনে তুলে ভিন্ন সংখ্যা, দৃষ্টি ও শক্তির আলোকে। পথে পড়ে থাকা একটা ঝরা পাতা কিংবা ফাটলকে যে ‌অন্তরদৃষ্টিতে উপলদ্ধি করতে জানে, সে-ই তো খোঁজে পায় জীবনের মানে, বেঁচে থাকায় ভিন্নতা! তাই বলে, যে পথিক পথে হেঁটে যেতে যেতে খুঁজে ফিরে জীবনের মানে কিংবা স্বাভাবিক বাযুর বৈরীতা, তাকে আমরা বিষাদের পথিক কিংবা হতাশার প্রতীক বলে আখ্যায়িত করতে পারি না। এ কেমন ভাবনা নিয়ে কবিরা বাঁচেন যারা নিজ চিন্তা-ভাবনার গণ্ডি পেড়িয়ে আঁধারে আলোর ঝলকানি দেখতে পান না? এ কেমন দৃষ্টি নিয়ে কবিরা বাঁচেন যাদের লিখতে গিয়ে দৃশ্যত খোলা দুটো চোখের খুব প্রয়োজন হয়? যদি কাল তারা অন্ধ হযে যান, তবে কী হবে?

 পাখিরাও আজকাল আমার কানে কানে বলে যায়….

“আমি আমাকে নিয়ে লিখি না

আমি তোমাদের নিয়ে লিখি।

তোমাদের ভেতরেই আছে একটি জ্বলন্ত উনুন

তাতে দাউ দাউ আগুনে সিদ্ধ হয় রক্তমাংসের শরীর

আছে একটি আইজেনব্র্যান্ট কফিন

সেখানে তোমরা আধা-মরা জীবন নিয়ে রোজ;

সুই-সুতোয় গাঁথো নকশীকাঁথা। 

আমি আমাকে নিয়ে ভাবি না

আমি তোমাদের নিযে ভাবি।”

 (৩) সত্যের অন্বেষণে বহু জ্ঞানীগুণী জনের রচনাকে আমরা নানানভাবে বিশ্লেষণ করে থাকি। কখনো বোধ, কখনো অর্থালঙ্কারে সিদ্ধান্তে উপনিত হই। কিন্তু ব্যক্তির ভাষার নির্দিষ্ট কোন তাৎপর্য খুঁজে পেতে আমরা অনেক সময় ব্যর্থ হই। শুধুমাত্র লেখকই বলতে পারেন তার ভাষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।

আমি যে খুব ভালো একজন পাঠক, তা নয়। ভালো পাঠক হওয়ার কোন গুণাবলী আমার আছে কিনা, জানা নেই। তবে, মানুষ হওয়ার সকল উপকরণ আমার মধ্যে বিদ্যমান। হাত, পা, চোখ, মুখ, অনুভুতি, আবেগ, রাগ, হিংসা, ঘৃণা, লোভ, অহংকার, সব মিলিয়েই আমি মানুষ। যদি বলা হয়, মানুষ শব্দের ব্যাখ্যা এ নয়, ‘মানুষ’ এর উপরে আরো মহৎ কিছুকে বোঝায়, তবে প্রশ্ন জাগে মনে, মানুষের ভিতর কেবল ‘মানুষ’ হওয়ার উপকরণ দিয়েই স্রষ্টা আমাদের পাঠালেন না কেন? এতো লোভ, আকাঙক্ষা, হারানোর ব্যাথা, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসাবে কেনো মুমূর্ষ হই আমরা! কেনো কারো প্রাপ্তিতে  আমাদের বুক ভেঙ্গে অপ্রাপ্তির ঢেঁকুর উঠে? আমরা মানুষ বলেই অনৈতিক হই। মানুষ বলেই লোভী হই, ঈর্শান্বিত হই। মানুষ বলেই বুকে ব্যাথা অনুভব হয়; চোখে পানি আসে। ফেরেশতাদের চোখে পানি আসেনা! তারা মনুষ্যকূলের উর্ধ্বে। নিউ ইয়র্ক ফেব্রুয়ারী ২০২৩

শেয়ার করুন