নিউইয়র্ক     সোমবার, ১লা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিতর্কে বাইডেন-ট্রাম্প: কে কত মিথ্যা বললেন

পরিচয় ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৪ | ০৭:৪২ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪ | ০৭:৪২ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
বিতর্কে বাইডেন-ট্রাম্প: কে কত মিথ্যা বললেন

যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রথম মুখোমুখি বিতর্ক হয়েছে ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জো বাইডেন ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে। বিতর্কে ট্রাম্প ও বাইডেন দুজনেই বিভিন্ন ইস্যুতে কিছু মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়েছেন। এপির সত্যতা যাচাই বলছে, ট্রাম্পের মিথ্যা বলার পাল্লা বাইডেনের তুলনায় বেশি।

প্রায় দেড় ঘণ্টার এ বিতর্কে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৩৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ড কথা বলেছেন। অন্যদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন ৪০ মিনিট ১২ সেকেন্ডের মতো। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে সিএনএন আয়োজিত এ বিতর্ক আটলান্টায় মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যমটির স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত হয়।

ভোটার ও দর্শক-শ্রোতাদের বিভ্রান্ত করতে এ দুই নেতার মধ্যে কে, কতটা মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিলেন, তা যাচাই করেছে এপি।

৬ জানুয়ারির দাঙ্গা

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি হামলা চালায় দেশটির তৎকালীন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকেরা। সে প্রসঙ্গ টেনে বিতর্কে ট্রাম্প বলেছেন, ‘সেদিন ক্যাপিটল হিলে যে অল্পসংখ্যক মানুষ গিয়েছিলেন, তা নিয়ে কথা বলে তারা। সেদিন অনেক ক্ষেত্রে পুলিশই আগ বাড়িয়ে উসকানি দিয়েছে।’

সত্যতা যাচাই: ট্রাম্পের এ কথার সত্যতা যাচাই করে দেখা গেছে, এটি মিথ্যা। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলের ওই হামলার ঘটনাটি ছিল দেশটিতে ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। ঘটনার দিন ধারণ করা ভিডিও, ছবি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুসারে, সেদিন ক্যাপিটল হিলে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। সেখানে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তির একটি নৃশংস দৃশ্য দেখা গিয়েছিল।

২০২৩ সালের ৭ মার্চ অভ্যন্তরীণভাবে লেখা চিঠিতে মার্কিন ক্যাপিটল পুলিশপ্রধান বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা দাঙ্গাকারীদের সহযোগিতা করেছে এবং তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা আপত্তিকর ও মিথ্যা।’ ক্যাপিটল পুলিশের এক মুখপাত্র ওই চিঠির সত্যতা এপিকে নিশ্চিত করেছেন।

ক্যাপিটল হিলে হামলার দিন তৎকালীন হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির কর্মকাণ্ড নিয়েও ট্রাম্পকে মিথ্যা বলতে দেখা গেছে। বিতর্কে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমি তাঁকে (পেলোসি) সেনা ও ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যদের কথা বলেছিলাম। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।’

ট্রাম্পের এ কথারও সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ন্যাশনাল গার্ড ডাকা না-ডাকার ব্যাপারে পেলোসি নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। ক্যাপিটল হিলে হামলা হওয়ার পর পেলোসি ও সিনেটের তৎকালীন সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নেতা মিচ ম্যাককনেল ন্যাশনাল গার্ডসহ সামরিক সহায়তা চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্যাপিটলে ন্যাশনাল গার্ড সেনাদের ডাকা হবে কি না, তা নিয়ে ক্যাপিটল পুলিশ বোর্ডই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্রোহ শুরু না হওয়ার আগপর্যন্ত ন্যাশনাল গার্ডের সেনাদের না ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ক্যাপিটল পুলিশ বোর্ড। তবে দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর তারা ন্যাশনাল গার্ডের সহায়তা চায়। কয়েক ঘণ্টা পর সেনারা সেখানে পৌঁছান।

কর নিয়ে বক্তব্য
ট্রাম্প দাবি করেছেন, বাইডেন জনগণের কর চার গুণ বাড়াতে চায়।

সত্যতা যাচাই: কথাটি যথার্থ নয়।

ট্রাম্প তাঁর বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশেও এমন অভিযোগ করে থাকেন। সত্যিকার অর্থে, যাঁদের আয়সীমা ৪ লাখ ডলারের কম, তাঁদের করের পরিমাণ যেন না বাড়ানো হয়, তা নিশ্চিত করতে চান বাইডেন। করদাতাদের মধ্যে এমন আয়সীমার মানুষদের সংখ্যাই বেশি। বাইডেন বিভিন্ন করপোরেশন ও ধনী মানুষদের কর বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন।আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ট্রাম্প যেমনটা দাবি করছেন, ততটা কর বাড়ানোর কথা বাইডেনের বাজেট প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি।

ইনসুলিন প্রসঙ্গ
বাইডেন দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মানুষকেই ইনসুলিন বাবদ মাসে ৪০০ ডলার খরচ করতে হতো। তিনি তা ১৫ ডলারে নামিয়ে এনেছেন।

সত্যতা যাচাই: বাইডেনের এই দাবি পুরোপুরি সঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২২ সালে বাইডেন স্বাক্ষরিত ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট নামের আইনটি পাস হয়। এর আওতায় মেডিকেয়ার নামের সরকারি স্বাস্থ্যবিমা সেবার আওতায় থাকা বয়স্ক মার্কিন নাগরিকদের জন্য পকেট ইনসুলিনের দাম ৩৫ ডলার নির্ধারণ করা হয়। গত বছর থেকে আইনটি কার্যকর হয়েছে। তখন ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর অনেকেই ঘোষণা দিয়েছিল, বেসরকারি বিমা সুবিধার আওতায় থাকা বেশির ভাগ মানুষকেও তারা এই দামে ইনসুলিন দেবে। তবে বাইডেন নিয়মিতই এ নিয়ে বাড়িয়ে বলেন। তিনি বলেন, আগে মানুষ মাসে ৪০০ ডলার করে পরিশোধে অভ্যস্ত ছিল।

অথচ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষদের, যাঁদের মেডিকেয়ার কিংবা বেসরকারি বিমা করা আছে, তাঁদের আইনটি প্রণয়নের আগে বছরে ইনসুলিন বাবদ ৪৫০ ডলার খরচ করতে হতো, মাসে নয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য জানা গেছে।

গর্ভপাত
ট্রাম্প বিতর্কে অভিযোগ করেন, বাইডেন প্রশাসন আট মাসে, নয় মাসে গর্ভপাতের এমনকি শিশুর জন্মের পরও মেরে ফেলার সুযোগ দিয়েছে।

সত্যতা যাচাই: জন্মের পর শিশুকে মেরে ফেলার কথাটি ট্রাম্প যথার্থ বলেননি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেই অবাঞ্ছিত নবজাতককে হত্যা করাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। জন্মের পর নবজাতককে হত্যার অনুমতি দিয়ে কোনো অঙ্গরাজ্যেই আইন পাস হয়নি। গর্ভপাতের পক্ষের আইনজীবীরা বলে থাকেন, গর্ভাবস্থার শেষের সময়ে গর্ভপাতকে নিরুৎসাহিত করতে এ ধরনের কথা বলা হয়ে থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভাবস্থার শেষে দিকে গর্ভপাতের ঘটনা বিরল।

রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধকেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে গর্ভাবস্থার ২১ সপ্তাহে বা পরে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে, এমন হার ১ শতাংশের কম। অন্তঃসত্ত্বার গুরুতর জটিলতা দেখা দিলে বা তাঁর জীবনের ঝুঁকি থাকলেই কেবল শেষ সময়ে গর্ভপাত করা হয়ে থাকে।

রাশিয়া
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের সংবাদকর্মী ইভান গার্শকোভিচ রাশিয়ায় আটক হয়েছেন। সিএনএনের বিতর্কে ট্রাম্প সে প্রসঙ্গ টেনে বাইডেনকে দোষারোপ করেন। বলেন, ‘তাঁর (বাইডেন) উচিত ছিল আরও অনেক আগেই তাঁকে (গার্শকোভিচ) মুক্ত করা। কিন্তু পুতিন সম্ভবত কোটি কোটি ডলার চাইছেন, কারণ এই ব্যক্তি প্রতিবারই তা পরিশোধ করেন।’

সত্যতা যাচাই: জিম্মি কিংবা অন্যায্যভাবে আটকে রাখা মার্কিন নাগরিকদের মুক্ত করতে বাইডেন ‘প্রতিবারই’ অর্থ পরিশোধ করেন বলে ট্রাম্প যে কথা বলেছেন তা ভুল। গার্শকোভিচকে মুক্তি দেওয়ার জন্য পুতিন অর্থ চাইছেন কি না, তারও কোনো প্রমাণ নেই। ট্রাম্প প্রশাসনের মতো বাইডেন প্রশাসনও অন্য দেশের সঙ্গে বন্দীবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করে থাকে। এ ক্ষেত্রে অর্থের লেনদেন হয় না।

কোভিড-১৯
বিতর্ক চলাকালে করোনা মহামারি প্রসঙ্গ টেনে ট্রাম্পকে আক্রমণ করেন বাইডেন। তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পেতে ট্রাম্প মার্কিন নাগরিকদের নিজেদের শরীরে ব্লিচের ইনজেকশন প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছিলেন।’

সত্যতা যাচাই: কথাটি বাইডেন বিকৃত করে বলেছেন। বরং ট্রাম্প করোনা থেকে রক্ষা পেতে মানুষের ফুসফুসে জীবাণুনাশক ইনজেকশন প্রয়োগ করা সম্ভব হবে কি না, তা জানতে চেয়েছিলেন।

জলবায়ু পরিবর্তন
বিতর্কে ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছরের মেয়াদকালে পরিবেশের উন্নয়নের জন্য ভালো ভালো কাজ করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিশুদ্ধ বাতাস ও পানি নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেন।

সত্যতা যাচাই: ট্রাম্পের এই দাবি বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালে ট্রাম্প উল্টো বিশুদ্ধ পানিসংক্রান্ত কিছু বিধি বাদ দিয়েছিলেন, কয়লা, তেল ও গ্যাস কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছিলেন, এমনকি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ২০২০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল দেখা দিলে বিজ্ঞানীরা একে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু ট্রাম্প বিজ্ঞানীদের সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সূত্র: প্রথম আলো।

শেয়ার করুন