১৬ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কানাডায় বাংলাদেশি ইমিগ্রেশন প্রতারক নেটওয়ার্কের উন্মোচন

নজরুল ইসলাম মিন্টো : পড়াশোনা, চাকুরি, উন্নত জীবন, নিরাপত্তা, কিংবা শুধু একটা ভালো ভবিষ্যৎ—এই স্বপ্ন নিয়েই প্রতিবছর হাজারো তরুণ-তরুণী পাড়ি জমায় কানাডার পথে। বাংলাদেশের শহর-গ্রাম থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এই স্বপ্নের খোঁজে বের হওয়া মানুষের দীর্ঘ সারি। কানাডার ইমিগ্রেশন সিস্টেমের সৌজন্যে, এইসব মানুষদের কেউ আসে স্টুডেন্ট ভিসায়, কেউ আসে পারিবারিক স্পনসরশিপে, কেউ বা বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে দেখা গেছে, এই বৈধ পথের আড়ালে তৈরি হয়েছে সুপরিকল্পিত এজেন্ট নেটওয়ার্ক, প্রযুক্তির অপব্যবহার, আর হাজারো নিরীহ মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ।

গোস্ট স্টুডেন্ট স্কিম এবং ভুয়া বিবাহের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন সুবিধা নেওয়ার অসংখ্য চক্র ধরা পড়েছে ২০২৪ সালে। কানাডার বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে অন্টারিওর ব্র্যাম্পটন, টরন্টো, মিসিসাগা, মন্ট্রিয়ল এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ার কিছু অংশে এসব কর্মকাণ্ডের বিস্তার লক্ষ্য করা গেছে। কতিপয় বাংলাদেশি RCIC লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং লাইসেন্স ছাড়া অনেকে এইসব প্রতারণায় জড়িয়েছেন, যা শুধু আইন ভঙ্গের বিষয় নয়, বরং মানবিক বিপর্যয়ের নতুন সংজ্ঞাও বয়ে এনেছে। ICCRC এর ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে তারা ২৭ জন RCIC-এর লাইসেন্স বাতিল করেছে বিভিন্ন ধরনের ইমিগ্রেশন প্রতারণায় জড়িত থাকার কারণে।

কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থা কতটা প্রযুক্তিনির্ভর ও জটিল হয়ে উঠেছে, তার পাশাপাশি কিভাবে কিছু অসাধু চক্র তা ফাঁকি দিয়ে নিজেরা লাভবান হচ্ছে—এইসব বিষয় বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে সরকারি তদন্ত প্রতিবেদন, মিডিয়ার অনুসন্ধান, ভুক্তভোগীদের বয়ান ও আইনি প্রক্রিয়ার নির্ভরযোগ্য নথিপত্রে। সেইসাথে উঠে এসেছে তাদের গল্পও, যারা প্রতারণার শিকার হয়ে ঘরবাড়ি বিক্রি করে, সর্বস্ব খুইয়ে আজ দেশে ফিরে গেছেন, অথবা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কানাডার অচেনা অলিগলিতে হারিয়ে গেছেন।

IRCC ও CBSA-এর তদন্তে প্রকাশ পায়, অন্টারিওর ব্র্যাম্পটনের একটি নির্দিষ্ট বেসমেন্ট ঠিকানায় ৩৭ জন বাংলাদেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে রেজিস্টার্ড ছিল। এই ঠিকানাটি আদতে ছিল না কোনো আবাসিক জায়গা—এটি ছিল একটি “মেইল ড্রপ” বা নামেমাত্র আবাস, যেখানে কেউ থাকত না।

তদন্তে জানা যায়, এইসব শিক্ষার্থী বাস্তবে কোনো কলেজে যেত না, কারও নাম রেজিস্ট্রি থাকলেও ক্লাসে উপস্থিতি ছিল শূন্যের কোঠায়। এরা ছিল “ভুয়া স্টুডেন্ট” স্কিমের অংশ, যারা কানাডায় প্রবেশ করেই পড়াশোনার পরিবর্তে কাজ খুঁজত ব্ল্যাক মার্কেটে, Uber Eats বা নির্মাণসাইটে। IRCC-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-এ ১,২০০+ বাংলাদেশি ছাত্রের ভিসা বাতিল হয়েছে, যাদের ৮০% পেপার (ভুয়া) কলেজের সাথে যুক্ত।

তদন্ত অনুযায়ী, এই স্কিমে যুক্ত ছিল একাধিক ধাপ। ১) ভুয়া অ্যাডমিশন লেটার তৈরি। কিছু প্রাইভেট “পেপার কলেজ” নিজেই অ্যাডমিশন লেটার তৈরি করত। ২) জাল ফিনান্সিয়াল ডকুমেন্ট। সাময়িকভাবে ব্যাংকে টাকা জমা রেখে ব্যাংক স্টেটমেন্ট তৈরি, পরে তা তুলে ফেলা হতো। ৩) একই অ্যাড্রেসে রেজিস্ট্রেশন। ৪) প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন: মেটাডেটা মুছে ফেলা (মেটাডাটা হচ্ছে ডকুমেন্টের ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’—এটি মুছে ফেললে IRCC-র পক্ষে জালিয়াতি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।), ডিপফেক ফটো, AI দিয়ে তৈরি প্রেজেন্টেশন, এমনকি বায়োমেট্রিক উপস্থিতি এড়াতে স্টুডেন্টরা 3D মাস্ক বা ভিডিও প্রজেকশন ব্যবহার করত। টরন্টোর হামবার কলেজে এমন ১২ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে।

এই গোস্ট স্টুডেন্ট বা ভুয়া ষ্টুডেন্টদের পেছনে ছিল এক সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক। তাদের মধ্যে প্রধান সংগঠক হিসেবে চিহ্নিত হন মো. রাজু আহমেদ, টরন্টো-ভিত্তিক একজন বাংলাদেশি যিনি নরসিংদীর বাসিন্দা। ব্র্যাম্পটনের বেসমেন্টের (বাড়ি) মালিক শাহিনুর আলম এই ঠিকানা জালকরণের কাজ করতেন।

বাংলাদেশে এদের অংশীদার ছিল : ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে অবস্থিত “Global Visa Consultant” ও “Dream Canada Immigration”। চট্টগ্রাম ও সিলেটের কিছু সাব-এজেন্ট। কিছু ব্যাংক কর্মচারী, যারা ভুয়া স্টেটমেন্ট তৈরিতে সহায়তা করত।

কতিপয় ভুক্তভোগি শিক্ষার্থীদের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন : শফিকুল ইসলাম (নরসিংদী), আয়েশা সিদ্দিকা (কুমিল্লা), রনি মিয়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), জাকির হোসেন (ফেনী) ও তানজিনা আক্তার (চট্টগ্রাম)।

আইন অনুযায়ী এ গ্রুপের ১৫ জনকে ইতিমধ্যে ডিপোর্ট করা হয়েছে। রাজু আহমেদের বিরুদ্ধে Criminal Code Section 368/380 অনুযায়ী মামলা হয়েছে। শাহিনুর আলমের সম্পত্তিও CBSA জব্দ করেছে।

ইমিগ্রেশন সুবিধা নেওয়ার আরেকটি বড় পথ হয়ে উঠেছে ভুয়া বিবাহ। ২০২৪ সালে IRCC কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১২৩টি নকল বিবাহের কেস চিহ্নিত হয়েছে যেখানে বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা কানাডিয়ান স্পনসরদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ভান করে পারমানেন্ট রেসিডেন্সের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে।

প্রতিটি কেসে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ ডলারের বিনিময়ে স্পনসরদের রাজি করানো হয়েছে। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশি-কানাডিয়ান নাগরিক, যারা ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই ধরণের ‘চাকরি’র অফার দিত। বিবাহের প্রমাণ হিসেবে তৈরি হতো–

১) Photoshop করা ছবি, একাধিক ব্যাকগ্রাউন্ডে কাস্টমাইজড রোমান্টিক ফটো।

২) Fake Wedding Card, ডিজাইন প্রিন্ট করে আলাদা স্টোরি বানানো হতো।

৩) সোশ্যাল মিডিয়ার নাটক, ভাড়া করা লোক দিয়ে পোস্ট, কমেন্ট, চ্যাট তৈরি করা হতো। ৪) ফেক ট্রাভেল প্রুফ: কক্সবাজার বা গুলশান লেকের ছবিকে বানানো হতো “হানিমুন” এর অংশ। কিছু মুসলিম অভিবাসী “নিকাহনামা” দেখিয়ে ভিসা চেয়ে থাকেন—এটি ‘টেম্পোরারি ম্যারেজ’ স্কিম হিসেবে পরিচিত।

এই চক্রে অংশ নিয়েছিল এমন কিছু স্পনসরদের নামও প্রকাশ পায়। এরা হলেন:

১) জেসিকা মরিস (মিসিসাগা), ৫ বছরের মধ্যে ৭টি স্পনসরশিপ।

২) ডেভিড লি (স্কারবোরো), বিবাহের বিনিময়ে $১৫,০০০ নিতেন। CBSA উল্লেখিত দুইজন সহ ৮ জন কানাডিয়ান স্পনসর ও ১১ জন বাংলাদেশি এজেন্টকে গ্রেফতার করে। জেসিকা মরিসকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও $৫০,০০০ জরিমানা করা হয়।

কিছু ICCRC রেজিস্টার্ড কনসালট্যান্টরাও এ চক্রে যুক্ত ছিলেন। তারা নিজের রেজিস্ট্রেশনের আড়ালে ভুয়া পরামর্শ দিতেন, নকল কাগজ তৈরি করতেন, এবং আবেদনকারীদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আদায় করতেন।

উল্লেখযোগ্য দুটি কেস হলো- CanGrow Immigration (Toronto) : আদনান আহমেদ নামে এক ছাত্র $১২০০০ ডলার হারিয়েছেন।

Apex Visa Consultants (Vancouver) : জারা খান নামে একজন সিলেটি নারী $১৮,০০০ ডলার খুইয়েছেন ভুয়া বিবাহে যুক্ত হয়ে।

প্রতারণা শুধু আইন লঙ্ঘন নয়, বরং মানুষের জীবন নষ্ট করে দেয়। হাজারো ভুক্তভোগীর কণ্ঠে ফুটে উঠেছে এই ক্ষতবিক্ষত বাস্তবতা।

রহিমা আক্তার (চট্টগ্রাম) : ১২ লাখ টাকা খরচ করে স্টুডেন্ট ভিসার স্বপ্নে বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু এজেন্টের ফাঁদে পড়ে তার ভিসা বাতিল হয়।

সজিব রহমান (ঢাকা) : ভুয়া বিবাহের মাধ্যমে PR পাবেন—এই আশ্বাসে ৮ লাখ টাকা খরচ করে ভুয়া কনের সাথে মিলিত হন। ইন্টারভিউতে ধরা পড়ে তার ৫ বছরের জন্য ইমিগ্রেশন ব্যান হয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

নাহিদ (মৌলভীবাজার) : দুবাই থেকে সেমিনারে অংশ নিয়ে ২০ লাখ টাকা দেন এক এজেন্টকে। আজ পর্যন্ত কোনো খবর নেই।

এমন শত শত কাহিনি ছড়িয়ে আছে ফেসবুকের গ্রুপ, ইউটিউব চ্যানেল, এবং কমিউনিটি ফোরামে। যাদের অনেকেই এখন নিঃস্ব, সমাজের কাছে অপমানিত।

২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে কানাডা সরকার প্রতারণার বিরুদ্ধে “Zero Tolerance” নীতি ঘোষণা করে। নেওয়া হয় একাধিক কঠোর পদক্ষেপ।

IRCC-এর প্রযুক্তিগত উদ্যোগ : Eagle Eye AI System : সকল অ্যাডমিশন লেটার ও স্পনসরশিপ ডকুমেন্টকে টেমপ্লেট-ম্যাচিং ও প্লেজিয়ারিজম চেকের আওতায় আনা হয়।

Voice Stress Analysis : ইন্টারভিউ অডিওর মাধ্যমে মিথ্যা বলার প্রবণতা শনাক্ত করা হয়।

CBSA-এর গোপন অপারেশন : “Ontario Sunrise College” নামে ফ্রন্ট কলেজ চালু করে চক্রের লোকদের ফাঁদে ফেলে ১৪৭ জন এজেন্ট ও ২৩৪ ভুয়া ছাত্রকে শনাক্ত করা হয়।

আইনগত যেসব পরিবর্তন এসেছে তা হলো :

১) College DLI লাইসেন্স বাতিল হলে $৫০০,০০০ পর্যন্ত জরিমানা।

২) ভুয়া বিয়ে বা স্টুডেন্ট ফ্রডের জন্য ১৪ বছর পর্যন্ত জেল (Criminal Code Section 292.1)

৩) স্পনসরদের ২০ বছরের আর্থিক দায়।

কানাডার নতুন আইন (Bill C-78): “PR পাওয়ার পরেও যদি ফ্রড প্রমাণিত হয়, জন্মসূত্রে কানাডিয়ান নাগরিকদেরও নাগরিকত্ব বাতিল করা যাবে।”

বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, “Global Visa Care” এবং “Dream Canada Immigration” নামের দুই প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি প্রবাসীদের টার্গেট করে সেমিনার করত। তাদের প্রতারণার প্যাটার্ন ছিল—

১) ‘গ্যারান্টিড ভিসা’ (যারা ইমিগ্রেশনের যোগ্য নয়; শিক্ষাগত যোগ্যতা/আর্থিক সামর্থ্য কম)।

২) ‘স্টুডেন্ট টু ওয়ার্ক পারমিট’ (পেপার সর্বস্ব তথা ভূয়া কলেজের পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার লোভ দেখানো। এসব প্রতিশ্রুতিতে মানুষ ১৫–২০ লাখ টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হয়। কানাডা-বাংলাদেশের মধ্যে ডেটা শেয়ারিং সীমিত। অনেকেই লজ্জায় বা ভয়ে অভিযোগ করে না।

একটা সময়ে কানাডা ছিল শুধু স্বপ্নের দেশ, এখন অনেকের কাছে তা বিভ্রান্তির কুয়াশা। এই ধরণের ইমিগ্রেশন ফ্রড শুধু আইনি জটিলতা তৈরি করছে না, বরং একটি জাতির ভবিষ্যৎকেই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যাঁরা প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে পা রাখতে চায়, তারা নিজেরাও বিপন্ন হচ্ছে, আর প্রতারকরা দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

স্বপ্ন দেখতে হবে—তবে চোখ খুলে, তথ্য যাচাই করে, আইন মেনে। প্রতারণা দিয়ে জীবন গড়া যায় না; বরং তা জীবনের সব অর্জনকে মুহূর্তেই ধূলিসাৎ করে দিতে পারে।

দ্রষ্টব্য : এই প্রতিবেদনটি একটি দলিলস্বরূপ ডকুমেন্ট, যার সব তথ্য বিভিন্ন সরকারি, মিডিয়া, ও আইনি সূত্র থেকে সংগৃহীত। কিছু নাম/পরিচয় গোপনীয়তা রক্ষার্থে পরিবর্তিত।