২৫শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কমিউনিটি

বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদের

বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদের

গত ১৪ই নভেম্বর শুক্রবার নিউইয়র্ক শহরের ফ্লোরাল পার্কে, গোল্ডেন ইয়ার্স কম্যুনিটি সেন্টারে যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নবেন্দু দত্তের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণু গোপের সঞ্চালনায় ১৫০ জনের অধিক সদস্য ওশুভানুধ্যায়ীদের উপস্থিতিতে পাঁচ ঘন্টা স্থায়ী উক্ত সভায় মঞ্চে সভার সভাপতি ছাড়াও উপবিষ্ট ছিলেন সংগঠনের তিন সভাপতি ডা. টমাস দুলু রায়, ড. দ্বিজেন ভট্টাচার্য্য ও রণবীর বড়ুয়া এবং ট্রাষ্টী বোর্ডের চেয়ারম্যান সুশীল কুমার সাহা।
সংখ্যালঘু বলে নির্যতনে নিহতদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের সঙ্গে “দেখ আলায় আলো আকাশ…” গানটি পরিবেশন করে সভা শুরু করা হয়।
এর পরই বাংলাদেশ থেকে সম্প্রতি আগত ভোরের কাগজের সিনিওর রিপোর্টার অভিজিৎ ভট্টাচার্য ও নারায়নগঞ্জের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর প্রদীপ ভৌমিক দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তাঁদের বক্তব্য শুরু হলে, ২০২৪ সালের ৪ঠা আগষ্ট থেকে এ’পর্যন্ত সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাবলীর সচিত্র বর্ণনা ও পরিসংখ্যান সম্বলিত ছ’পাতার একটি ব্রোশার সভায় অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে বিলি করা হয়, যাতে নিহত- ধর্ষিতাদের সংখ্যা ছাড়াও অভয় নগর, গঙ্গাছড়া, হাজারিগল্লি, পার্বত্য চট্টগ্রামে গোটা বৌদ্ধ পাড়ার ১০০টি বাড়ি ও ক্রিসমাস ঈভে খৃষ্টান পাড়ার ১৭টি বাড়িকে অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করা, ও গুইমারায় নাবলিকা ধর্ষণের প্রতিবাদরত তিন জন মারমা আদিবাসীকে হত্যার বিশদ বর্ণনা ছিল।

তার পর ইউনাইটেড হিন্দুজ অফ ইউ. এস. এ, বাংলাদেশে পূজা সমিতি, শ্রী কৃষ্ণ ভক্ত সংঘ, গীতা সংঘ, রাধামাধম মন্দির, মহামায়া মন্দির, জগন্নাথ হল এলামনাই এসাসিয়েশন, হিন্দু হেরিটেইজ অফ নিউ ইয়র্ক সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ এবং সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সংখ্যলঘুদের সুরক্ষা প্রদানে ড. ই্উনূস সরকারের ব্যর্থতা ও অনীহার তীব্র নিন্দা করেন এবং গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁদের কয়েকজন দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সামপ্রতিক কালে অত্যাচারের ঘটনাবলী বর্ণনা করা ছাড়াও ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে রামু, নাসির নগর, মুরাদনগর, সাঁথিয়া, নানুয়ার দিঘীর পাড় সহ ভয়াবহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো কারা ঘটিয়েছিল এবং তাতে কোন সরকারের কী ভূমিকা ছিল সে’ ইতিহাসও নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তুলে ধরেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন শিতাংশু গুহ, ড. জিতেন রায়, ড. সব্যসাচী ঘোষ দস্তিদার, রূপকুমার ভৌমিক, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তি, প্রদীপ মালাকার, তপন সেন, রীণা সাহা, পার্থ তালুকদার, সুভাষ সাহা, নির্মল পাল, রমেশ নাথ, রণবীর বড়ুয়া, ড. টমাস দুলু রায়, ভজন সরকার, রামদাস ঘরামী, সুশীল সিনহা, নিতাই নাথ, বিশ্বজিৎ সাহা, রাজীব দে, এফ. শাওন দেবনাথ, এডওয়ার্ড হলসানা, অঞ্জন চক্রবর্তি প্রমুখ্। সভায় ২৬জন নবাগত তরুণ-তরুণী সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁদের অভিজ্ঞতা, আশা প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করতেও দেয়া হয়।

এর পর, সাধারণ সম্পাদক বিগত এক বছরে দেশের বিপন্ন সংখ্যালঘুদের সাহায্য ও সুরক্ষার্থে গৃহীত উদ্যোগের বিবরণী দেন, এবং সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ্ চন্দন সেনগুপ্ত, গত এক বছরের আয় ব্যায়ের হিসাব পেশ করেন, এবং বিপন্ন সংখ্যালঘুদের সাহায্যকারী দাতা ও নবাগত সদস্যদের ধন্যবাদ জানান।
এই পর্যায়ে, সংগঠনের অন্যতম সভাপতি ড. দ্বিজেন ভট্টাচার্য্য সভার পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রস্তাব পড়ে শুনিয়ে উপস্থিত সকলের মতামত জানতে চান, যাতে কারও আপত্তি না থাকায় সেই প্রস্তাবসমূহ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবসমূহ নিম্নরূপ::
যেহেতু,২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে নিরন্তরভাবে বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বর্বর অত্যাচার সংঘটিত হয়ে চলেছে; যেহেতু, সকল সংখ্যালঘু নাগরিকের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং আইনের সমান সুরক্ষা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক শর্ত; এবং যেহেতু, দেশের সংবিধান এবং জাতিসঙ্ঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বাংলাদেশ সরকারের সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে;

অতএব, আজকের সভা নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহন করছে:
১/ সভার পক্ষ থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে অনুরোধ করা হচ্ছে যে, তিনি যেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে নিম্নোক্ত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপরাধে তাদের সদস্যদের অবিলম্বে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ গ্রহনের অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন, এবং জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে ষ্পষ্ট ভাষায় এই মর্মে অবহিত করেন যে, সেই যোগ্যতা ফিরে পেতে তাদের উক্ত অপরাধসমূহের জন্য অবিলম্বে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, এবং তারা ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। উক্ত অপরাধসমূহ হচ্ছে: (ক) সকলের মধ্য থেকে বাছাই করে হিন্দু সাব-ইন্সপেক্টর সন্তোষ চৌধুরীকে করে জনতার হাতে লিঞ্চিঙের জন্য তুলে দেয়ার মত সাম্প্রদায়িক আচরণ; (খ) হাজারী গল্লিতে সি. সি. টি. ভি. ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর অত্যাচার চালানো; (গ) গুইমারা, খাগড়াছড়িতে আদিবাসী নাবালিকা ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় তিনজন মারমা আদিবাসী তরুণকে গুলিকরে হত্যা করা; (ঘ) মেজেসেট্রসি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় উগ্রপন্থী ও জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী কর্তিৃক সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিহত না করা। এই প্রসঙ্গে, সভার পক্ষ থেকে মহাসচিব গুতেরেসের উদ্দেশ্যে আরও বলা হয় যে, ২০২৪ সালের আগষ্ট মাসে: ফলকার টুর্কের সতর্ক বার্তার মুখে নির্বাচিত সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে বাংলাদেশে সেনা বাহিনী যেভাবে হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত করে দিয়েছিল ঠিক তেমনি দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনও চিরতরে বন্ধ করে দিতে তিনি যেন বাংলাদেশে সেনাবাহিনী প্রধানকে পরামর্শ দেন।
২/ সভার পক্ষ থেকে সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয় অস্বীকার করার দু:খজনক অপপ্রয়াস না করে বরং অবিলম্বে এর বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ে শূন্য সহনশীলতার নীতি ঘোষণা ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানানো হয়;

৩/ সভা ২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপরাধে অপরাধী সকল মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার, বিচার এবং দণ্ডবিধান নিশ্চিত করে সকল ভুক্তভোগীকে ক্ষয়ক্ষতি এবং ধ্বংসকৃত সম্পত্তির জন্য তাঁদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্য ড. ইউনূস সাহেবকে অনুরোধ জানায়।
৪/ সভা ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে এই মর্মে অনুরোধ করে যে, তিনি যেন অবিলম্বে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব এবং পুলিশের মহাপরিদর্শকদের সম্পৃক্তকরে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সময় এবং এর পূর্বপর কালে সংখ্যালঘুদের ওপর সম্ভাব্য সহিংসতা প্রতিরোধ কল্পে নজরদারি বৃদ্ধি ও কোন ঘটনা ঘটলে সেটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের পূর্বাপর সময়ে সংঘটিত ব্যাপক নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
৫/ সভা রষ্ট্রপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে অনুরোধ জানায় যে, তিনি যেন দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে এই মর্মে ঐক্যমত্যে পৌঁছতে রাজি করান যে, তাঁরা নির্বাচনের পর সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনে সংখ্যালঘু সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত হেইট ক্রাইম ও স্পীচ আইন, ভারতের মত সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং ইসলামী ফাউন্ডেশনের আদলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, “সংখ্যালঘু” ও “আদিবাসী” স্বীকৃতি, এবং সেপারেট ইলেক্টরেট ব্যবস্থা সংযুক্ত করে একটি টেকসই “সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন” প্রণয়ন করবেন, যার সুবিধার্থে যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদ সরকারকে একটি খসড়া সংখ্যালঘু সুরক্ষা বিল দিতে প্রস্তুত রয়েছে।

৬/ সভার পক্ষ থেকে ড. ইউনুসকে আরও অনুরোধ জানানো হয় যে, তিনি যেন অতীতের তত্বাবধায়ক/অন্তবর্তিকালীন সরকারগুলো দৃষ্টান্ত অনুসরণপূর্বক দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে একটি সত্যিকার অন্তর্ভুক্তিমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন; এই প্রসঙ্গে সভা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, বৈষম্যমূলক আচরন ও সহিংসতার অভিযোগে কেবল একটি বিশেষ দলকে বাদ দিয়ে, অন্যান্য দল যারা ১৯৭১ সালের গণহত্যা, লগাঙে আদিবাসী গণহত্যা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিরোধী দলের ওপর গ্রেনেড হামলা, বা থানা দখল , লুটপাাট, মেট্রো রেলে অগ্লি সংযোগ, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং পুলিশকে জীবন্ত পুড়ে মারা/ লিঞ্চিঙ্রের মত অসংখ্য মানবতা বিরোধী জঘন্য অপরাধে অপরাধী তাদের নিয়ে নির্বাচন করা অযৌক্তিক ও হাস্যকর— সেটা বিশ্বেরে কাছে মোটেও গ্রহনযোগ্য হবে না।
শেষে তপন বৈদ্যের ধ্রুপদী সঙ্গীত ও দুলাল ভৌমিকের লোকগীতি পরিবেশনের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে।